
জীবন শুধুই প্রবঞ্চনা: ডেনিস দিদেরো
ভাষান্তর: হৃদ্য আবদুহুপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২২
ফরাসি দার্শনিক ও শিল্প সমালোচক ডেনিস দিদেরো স্পেনের ল্যাংরেসে ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দিদিয়ের দিদরোট, মা অ্যাঞ্জেলিক ভিগনেরন। ল্যাংরেসের একটি জেসুইট কলেজে দিদেরোর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স অব আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পাদ্রি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে সে ইচ্ছে ছেড়ে প্যারিসে আইন অনুষদে ভর্তি হন। অল্প কয়েকদিন পরই আইন পড়া ছেড়ে তিনি লেখক হবেন বলে মনস্থির করেন। তার এ সিদ্ধান্ত পিতা মেনে নেননি। ফলে বাড়ি ছেড়ে তিনি দশ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটান। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে জ্যঁ জ্যাকুয়া রুশোর সঙ্গে তার সখ্য হয়। প্রথম জীবনে জীবিকা অর্জনের জন্য অনুবাদের কাজ করেন। পরে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শুরু করেন লেখালেখি। এসময় দর্শন বিষয়ক কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। কিন্তু সমালোচকদের তোপের মুখে ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে লেখার অপরাধে তিন মাস তিনি কারাদণ্ড ভোগ করেন। ছাড়া পেয়ে বিশ্বকোষ প্রণয়নে হাত দেন। প্রায় ২০ বছরের কঠোর পরিশ্রম, পরম নিষ্ঠা ও অনন্য মেধার চূড়ান্ত ফসল ২৮ খণ্ডে রচিত বিশ্বকোষ। ফরাসি ভাষায় লেখা এই বিশ্বকোষ বিশ্বের প্রথম ও প্রামাণ্য বিশ্বকোষ। ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখ দার্শনিক এ কাজে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া উপন্যাস, গল্প, শিল্প সমালোচনা, দর্শন ও চিঠিপত্রে ডেনিস দিদেরোর মেধা ও মমনের বিশিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। কর্মজীবনে বেশিরভাগ সময় দিদেরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিলেন। তবে শেষ জীবন কিছুটা সুখে কাটে তার। কারণ, ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথরিন জানতে পারেন, বিশ্বকোষ সম্পাদনার জন্যে দিদেরা তার পারিশ্রমিক পাননি। তখন তিনি দিদেরোকে তার গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করার জন্য নিয়োগ দেন। এবং একসঙ্গে পঞ্চাশ হাজার ফ্র্যাঙ্কের ব্যবস্থা করে দেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই দিদেরো মারা যান। তিনি ছিলেন স্বাধীন সংশয়বাদী চিন্তা প্রকাশে অকুণ্ঠ। মধ্য অষ্টাদশ শতকের গণজীবনের গøানি সম্পর্কে তিনি প্রেমিকা সোফি ভোলাদকে চিঠি লিখতেন। চিন্তা ও আদর্শে ভোলাদ ছিলেন দিদেরোর সহমর্মী। ১৭৫৯ সালের ১ নভেম্বর ভোলাদকে লেখা একটি চিঠি:
প্রিয়তমা,
আজ সকাল থেকে আমি জানলার নিচে কর্মরত শ্রমিকদের কলরব শুনছি। তখনো সূর্য ওঠেনি, অথচ ওদের কাজ শুরু হয়ে গেছে। কোদাল দিয়ে ওরা মাটি কাটছে, ছোট ঠেলাগাড়ি ঠেলছে। খাবার বলতে এক টুকরো বাসি রুটি। নদীর পানিতে ওদের পিপাসা মেটে। মাঝরাতে ঘণ্টাখানেকের জন্যে ওরা মাটিতে শুয়ে ঘুমোয়। আবার একটু পরই শুরু হয়ে যায় ওদের কাজ। ওরা বেশ ফূর্তির মেজাজে থাকে। গানটান গায়। একজন আরেকজনকে নিয়ে চটুল রসিকতা করে, হাসে। রাতে ধোঁয়াটে চুল্লির ধারে খালি গায়ের শিশুসন্তানদের সাথে ওরা মিলিত হয়। ওদের সঙ্গিনীরা কৃষক রমণী, দেখতে কুৎসিত ও নোংরা। শুকনো খড় দিয়ে তৈরি হয় ওদের রাতের বাসর। অথচ ওরা আমার চেয়ে ভালোও নয়, খারাপও নয়।
তুমি বলো, তুমি অনেক আঘাত পেয়েছ। অতীতের চেয়ে বর্তমান কি তোমার কাছে বেশি কঠোর ও ক্লান্তিকর মনে হয়? সারা সকাল আমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। পালিয়ে যাওয়া একটা চিন্তাকে কিছুতেই ধরতে পারছি না। আমার হৃদয় যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন। তার ওপর আবার জীবনের সর্বজনীন দুঃখে অভিভূত। আমার এক বন্ধু ছিল। তার কাছ থেকে কোনো সংবাদই পাচ্ছি না। প্রিয় বান্ধবির কাছ থেকে আমি অনেক দূরে। অথচ তার জন্য আমার হৃদয় পাগলপ্রায়। গ্রামে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ। শহরেও তাই। সব জায়গাতেই দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ। ভাবনাহীন মানুষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবকিছুই যেন উধাও। মন্দ ভালোকে বিতাড়িত করেছে, ভালো মন্দকে। আর জীবন শুধুই প্রবঞ্চনা।
সম্ভবত আগামীকাল অথবা সোমবারে একদিনের জন্য আমরা শহরে যাব। যার জন্যে আমি ব্যাকুল আমার সেই প্রিয় বান্ধবিকে আমি দেখব। আর দেখব অল্প কথা বলা আমার বন্ধুকে, যার কোনো সংবাদই আমি পাই না। কিন্তু পরদিন আবার দুজনকেই হারাবো। তাদের সান্নিধ্যে পাওয়া আনন্দের স্বাদে যতই আমার চিত্ত ভরবে, ততই বিদায়ের লগ্নে ব্যথায় হৃদয় ভাঙবে।
এমনই হয়। সবসময়। তুমি যতই ভুলতে চেষ্টা করবে ততই তোমার চোখে পড়বে একটি দলিত গোপালকুঁড়ি। যাতে ঝরে পড়বে তোমার হৃদয়। আমার প্রিয়তমাকে আমি ভালোবাসি। তার ভালোবাসায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন আমার হৃদয় আর কোনো দিকেই তাকাতে পারে না।
এই জীবনের প্রাঙ্গণে আমি শুধু দুর্দশা আর দুর্ভাগ্য দেখতে পাচ্ছি। এই দুর্ভাগ্যের বিচিত্র চেহারা। শত রূপ ধরে তা আমাকে অভিভূত করে। মাঝে মাঝে এক আধটা দিন পার হয়ে যায়, ওর কোনো চিঠি আমি পাই না। অমনি মন ব্যাকুল হয়ে জিগেশ করে, ‘কী হলো তার? অসুখ করেনি তো?’ দুশ্চিন্তার ছায়াগুলো এভাবেই আমার চারদিকে ঘোরাঘুরি করে, আর আমি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠি।
মানুষের পক্ষে তার ভবিতব্যকে ত্বরান্বিত কিংবা বিলম্বিত করা সম্ভব নয়। অনুভব ও ভালোবাসার ক্ষেত্র যতই প্রসারিত হয়, ব্যক্তিবিশেষের জন্যে ততই তা সংকুচিত হয়ে যায়। ভালোবাসার ধন যদি একটা হয়, তাহলে হৃদয়ের সব অনুরাগ তার ওপর গিয়ে পড়ে। ও যে কৃপণের ধন!
যাক, আমার মনে হচ্ছে, খুব বদহজম হয়েছে আমার। যে কারণে এইসব অস্বাভাবিক জীবনদর্শন! অবশ্য এসবই পেটের গোলযোগের ফল। ভরা পেটেই হোক আর খালি পেটেই হোক, হাসিখুশি থাকি অথবা বিমর্ষ থাকি, প্রিয়তমা, আমার হৃদয়ের ধন, আমি তোমাকে ভালোবাসি সবসময় একই তীব্রতাই। শুধু কখনো কখনো একেক রকম অনুভূতির একেক রং এসে ওতে লাগে।