তুহিন খানের কলাম ‘বিপ্লবের শত্রু-মিত্র’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২১

শাহবাগ বেইচা ইমরান এইচ সরকার তো যা খাওয়ার খাইছেনই। কিন্তু নয়া যামানায় শাহবাগ বেইচা খাওয়ার ধান্দায় আছেন একদমই বিপরীত শিবিরের কতিপয় মানুষ। এরা সাধারণত, যদি এক বর্গে সবাইরে আনতে চাই, `ফ্যাশিস্তবিরোধী` বা `ফ্যাসিবাদবিরোধী` শিবিরের লোক হিশাবেই পরিচিত। উনাদের সাথে আপনার মত না মিললে, আপনারে বলবে শাহবাগী, ফ্যাশিস্ত।

আমার মনে পড়ে, আজ থেকে এক/দুই বছর আগে, আল মাহমুদ আর জামাত প্রসঙ্গে লেখায় একজন আমারে বলছিলেন `ফ্যাশিস্ত`। তো এখন ধরেন, আপনার দাড়ি-টুপি যদি থাকে? তাইলে আপনি `কওমি শাহবাগি`। যদি দাড়ি-টুপি না থাকে, কিন্তু আপনি ইসলামঘনিষ্ঠ অ্যাক্টিভিজম করেন, তাইলে? `ইসলামপন্থী শাহবাগী`। এইভাবে `বিএনপিপন্থী শাহবাগী`, `আওয়ামীপন্থী শাহবাগী`, `আমেরিকাপন্থী শহবাগী`, `রুশপন্থী শাহবাগী`, `তুর্কিপন্থী শাহবাগী`, `সৌদিপন্থী শাহবাগী`সহ আরো বিবিধ কিসিমের শাহবাগী আপনারে বানাইয়াই তারা ছাড়বে।

আপনি ভাবতে পারেন— এইরকম শাহবাগী তো আছেই। থাকতেই পারে। মানে, শাহবাগী শব্দটারে যদি আপনি `পলিটিকাল এক্সট্রিমিস্ট` বা `ঘেন্নাবাদী রাজনীতি`র ভাবশব্দ হিশাবে পড়েন। তো এই চিন্তা মাথায় আসার পরে, একটু ভালোমতো খেয়াল করলেই দেখবেন, এই ধরনের ট্যাগ যারা দেয়, এদের সাথে আলাপ করা কত মুশকিল; কী দুরুহ এদের সাথে এঙ্গেজ করা! `শাহবাগী` শব্দটারে আপনে যদি `ঘেন্নাবাদী` অর্থে পাঠ কইরা থাকেন, তাইলে এর প্রভূত নিদর্শন ও নমুনা আপনে পাবেন এই `কাউন্টার শাহবাগী`দের মধ্যে। ঠিক ব্লগ আমলের শহবাগীদের মতন।

আমরা যারা ব্লগযুগের বিষবাষ্প থিকা একটু দূরে থাইকা থাইকা মানুষ, আমি নিজেদের ভাগ্যবান ভাবি। যেকোনো জীবাণু আর তার কাউন্টার পার্ট— দুইটাই শেষমেশ কীভাবে কীভাবে যে একই জিনিশ হয়া দাঁড়ায়! নিটশের একটা কথা আছে যে, মনস্টারের সাথে যে লড়াই চালায়, তার হামেশা দিল জিন্দা রাখা লাগে, দমে দমে নিজের ভিতরে জাইগা উঠতে চাওয়া মনস্টারটার সাথে যুদ্ধ করা লাগে।

পুরান পরিভাষায় আপনারে আটকাইতে চাবেন এদের অনেকেই। এমন এমন জিনিশ বলবেন, যা আপনি জানেনই না। কিন্তু আসলে আপনি যে ওইটাই— তা এরা আপনারে বিশ্বাস করায়া ছাড়বেন। একসময় আপনিও বিশ্বাস করা শুরু করবেন, আপনি ওইটাই। যেমন, ইসলামপন্থীরা একসময় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা শুরু করছিলেন, তারা আসলে রাজাকারই। এই দেশটা তাদের না। এখন আবার তাদের কেউ কেউ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেন, জীবনে তারা এর বিপক্ষে ছিলেনই না। এইগুলা বিপ্লবপন্থীদের আদি ঝামেলা, নতুন কিছু না।

ওনারা ভাবেন যে, সোসাইটিতে চূড়ান্ত রকমের মেরুকরণ ছাড়া বিপ্লব হবে না। সেজন্য ঘায়েল করা লাগবে। যত বেশি পারা যায়, যারে যারে পারা যায়। জালেমের পক্ষে দ্বিমত কিসের? কেউ কেউ জাস্ট সুবিধাবাদের জন্যেই এগুলায় তাল দেন। কেউ কেউ থাকেন, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, মজলুম, জখমি; ফলে— দারুণভাবে বিপর্যস্ত, আক্রমণাত্মক, হিংসাত্মক। অনেকে আছেন অতীত-ভবিষ্যত হারায়ে দিশাহারা, ফলে হারানোর কিছু নাই আর; ফলত— গড়ারও কিছু নাই। এইরকম নানা ক্যাটাগোরির লোকদের নিয়াই একটা বিল্পবের প্রস্তুতি শুরু হয়।

আপনি যদি সজীব মানুষ হন, আপনার মগজ যদি সক্রিয় থাকে, তাইলে আপনি বুঝবেন— এরা সকলেই বিপ্লবী না। বিপ্লব শব্দটা যে অর্থে আমি বুঝি, সেটা হইল— যে ভুলের কারণে আজ রাজপথে আইসা দাঁড়াইছি, সেই ভুলগুলারে যথাসম্ভব শোধরানো। যে জখমের কারণে আমি আজকে পঙ্গু, সেই জখম থেকে আমার পরের প্রজন্মরে বাঁচানো। দুনিয়াটারে প্রতি ধাক্কায় আরো দুই কদম সামনে আগায়ে নেওয়া, এবং প্রতিবারে এই আগানো জামাতের লোকসংখ্যা একটু একটু করে বাড়ানো, না কমানো। এতটুকুই তো। হযরত আলির (রাযিয়াল্লাহু তা`আলা আনহু) দলেও এই রকম বিপ্লবীরা ছিলেন। একদিকে ছিল খারেজিরা, একদিকে শিয়ারা। এদের মধ্যে ইনসাফ, ন্যায় বা দ্বীনের আইডিয়ার চাইতে বেহুদা জিঘাংসা, ফালতু বকাবাজি, অহেতুক গলাবাজি, ঠগ বেছে গা উজাড় করার মত ট্যাগিংয়ের মানসিকতা এবং আঘাত হানার একদম সঠিক স্থান, কাল ও পাত্র আসলেই চম্পট দিয়ে পিছু হটা— এইসবই ছিল বেশি।

ইতিহাস পড়লে দেখবেন, স্রেফ অর স্রেফ এদের এই ধরনের মানসিকতার কারণেই শেষতক শেরে খোদা হযরত আলি (রাযিয়াল্লাহু তা`আলা আনহু) পরাজিত হইছেন, খেলাফতের সিলসিলা বিঘ্নিত হইছে। বিপ্লবে শত্রু-মিত্র চেনা তো জরুরি বটেই। কিন্তু শত্রু-মিত্র খেলাটাই বিপ্লব না আরকি। শত্রু-মিত্র চেনা আর শত্রু-মিত্র খেলাও এক জিনিশ না। শত্রুর সাথে বসবাসও রাজনীতির বেসিক আইডিয়াই বটে। যাহোক, বিপ্লবীদের শ্রদ্ধা কইরেন সবাই। তবে বিজয়ী বীরদের উন্মুক্ত রাইফেলের সামনে না পড়াই বেটার। কখন কারে তারা গুল্লি মারবেন, বলার উপায় নাই।

বিপ্লবের চাইতেও আপনার জানটা তো দামি জিনিশ, সজীব জিনিশ। বিপ্লবীদের হাত থেকে সেটা হেফাজতে রাইখেন। আর এই যে, যাদের কথা কইলাম, উনাদের একটা নাম দিতে চাই আমি। ভাইবা দেখলাম, এই সময় শাহবাগ বেইচা সবচাইতে বেশি লাভ হইতেছে উনাদেরই। ফলে উনাদের নাম দিলাম `কাউন্টার-শাহবাগী` বা `প্রতি-শাহবাগী`। `শাহবাগী` ব্যাপারটা রেলেভেন্ট থাকল। এইটাই তো চান উনারা, না!