পল্লবী সেনগুপ্ত গদ্য ‘ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১১, ২০২২

সেদিন টিভিতে একটা সিনেমা দেখছিলাম। হিন্দিতে ডাবিং করা অচেনা কোনো একটা ভাষার সিনেমা। কোনো কাজ করতে ইচ্ছা করছিলো না। তাই অচেনা অজানা সিনেমাই দেখছিলাম।

সিনেমার প্লট এক কথায় খুবই সাধারণ। নায়ক খুব ভোলা ভালা ছেলে। সবাইকে কথায় কথায় বিশ্বাস করে। কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। সেইজন্য নায়ককে সবাই খুব ফালতু, অযোগ্য ভাবে। কেউ তাকে সম্মান দেয় না। অনেকেই ভালো ব্যবহারও করে না। কেউ কেউ তো আবার তার বন্ধু হয়েও তাকে ঠকিয়ে দিতে চেষ্টা করে। নায়ককে নিয়ে খিল্লি করে। তার যে কোনো উন্নতির চেষ্টাকে ছোট করে। তার জীবনে বাধা সৃষ্টি করে।

এই নিয়েই সিনেমার ফার্স্ট হাফ। সেকেন্ড হাফে দেখানো হয় নায়কের ক্ষতি করতে চাওয়া, তার পিছনে লাগা, তার সাথে অভদ্রতা করা লোকগুলোর সাথে নানা নেগেটিভ ঘটনা ঘটতে থাকে। তারা নিজেরাই নানাভাবে নাস্তানাবুদ হয়। কিন্তু এসবের কোনো কারণ কেউ খুঁজে পায় না।

সিনেমার ক্ল্যাইম্যাক্সে দেখা যায়, ওই বোকাসোকা নায়ক আসলে সকলের আড়ালে, সবার থেকে লুকিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করছিল। নানা রকম রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য ক্ষমতা সে লাভ করে নিজের চেষ্টায়। কিন্তু ইচ্ছে করেই সেটা প্রকাশ্যে আনেনি। যারা এতদিন তাকে দুর্বল ভেবে আঘাত করে গেছে, তাদেরই ওই নায়ক উচিত শিক্ষা দিচ্ছিল আড়ালে থেকেই।

খুব পাতি গল্প হয়তো। ভীষণ সিনেমাটিক। অতিরিক্ত মেলোড্রামা। তবে এসবের পরেও সেদিন ওই সিনেমা একটা নতুন জিনিস ভাবালো। আজকাল বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু অন্য কারোর ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করে। কারোর কেয়ারিং নেচারকে ন্যাকামি আর নিচু গলায় কথা বলাকে বোকামি মনে করে।

আর যাদের ব্যবহার এরকম হয় তাদের নিয়ে খিল্লি করা, তাদের দাবিয়ে দেওয়া, তাদের মেরুদণ্ডহীন ধরে নিয়ে অসম্মান আর অভদ্রতা করাই বর্তমানে অনেকে স্মার্ট হবার মাপকাঠি মনে করে। কিন্তু বোকা বা ন্যাকা ধরে নিয়ে কাউকে ক্রমাগত অপমান করতে থাকাটা কখনো কখনো কিন্তু ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ক্রমাগত অপমান আর তাচ্ছিল্য পেতে পেতে যে কারোরই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তখন কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করবেই।

ওই সিনেমার নায়কের মতো কখন যে সে নিজের শক্তি বাড়িয়ে প্রত্যাঘাত করবে অজান্তেই তা হয়তো তাকে অবজ্ঞা করা পাবলিকরা টেরও পাবে না। কে যে কখন ছোট থেকে বড় হবে তা কেউ বলতে পারে না। তাই কাউকে দুর্বল ঠাউরে নিয়ে তাকে তাচ্ছিল্য করাটা আদতে বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।

যারা নিজেদের কোমল ব্যবহার আর বিশ্বাসী মনের জন্য বারবার ভুগেছেন, অবহেলিত হয়েছেন, তাদের বলছি, কেউ চিরস্থায়ী দুর্বল নয়। দুর্বলই সময়ের সাথে সাথে একদিন সবল হয়ে ওঠে। হয়তো সময় লাগে। কিন্তু যেদিন সেই সময়টা আসে সেদিন আর ওই আঘাত পাওয়া মানুষগুলোকে প্রত্যাঘাত করা থেকে কেউ আটকাতে পারে না। এক্ষেত্রে দরকার শুধুই ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা।

জানি জীবনটা সিনেমা নয়। জীবনটা অনেক বেশি কঠিন। তাই সিনেমার নায়ক যেটা অবলীলায় করে ফেলে সেটা সাধারণ মানুষ পারে না। তবে এটাও ঠিক যে, জীবন সিনেমা না হলেও সিনেমা জীবনের গল্প থেকেই তৈরি হয়। তাই সেলুলয়েডের নায়ক যেটা এক বছরে পারে, সাধারণ আমি আপনি সেটা এক বছরে না পারলেও পাঁচ বছরে নিশ্চই পারবো, যদি চেষ্টাটা জারি থাকে।