পাছা

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : জুন ২৪, ২০১৮

আগেই বলে নেই, আমার লেখা একটা বাজে শব্দের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। অনেকদিন ধরেই লিখতে চাচ্ছি ঘটনাটা, স্ত্রীর চোখ রাঙানির কারণে লিখতে পারিনি। সব সময় ও বলতো, ‘এসব বাজে কথা না লেখাই ভালো।’ শেষপর্যন্ত ভাবলাম যে, ওই শব্দটাতো আর আমার মুখ দিয়ে বের হয় নাই। সুতরাং জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়ে বলেই ফেলি। আর তাছাড়া রাস্তাঘাটে আমরা যতই প্রমিত থাকি না কেন, বাসায় ঢুকলেই তো শুরু হয়ে যায় অপ্রমিত অনাচার (ভাষার উপর)।

আমি তখন চাকরি করি বাংলাদেশের পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসাবে। একবার সিলেটে গেলাম অফিসিয়াল ট্যুরে। সাথে আছেন আমাদের অফিসের কয়েকজন সেকেন্ড চিফ ইন কম্যান্ড অর্থাৎ মেম্বার ইঞ্জিনিয়ারিং, একজিকিউটিভ ডিরেক্টর, ডিরেক্টর পারসোনেল এবং আমার বস ডেপুটি ডিরেক্টর। বিরাট বিরাট পদবির কর্মকর্তা ওনারা, ওনাদের সামনে কথা বলতেও জিব কাঁপতো। বিশাল ব্যাপার ওনাদের সাথে কোথাও ট্যুর করা। কারণ একেবারে ভি আই পি ট্রিটমেন্ট পাওয়া যেত, উঠতে সালাম, বসতে সালাম, নানাখানা ব্যাপার আর কি!

আমাদের সাথে আরেকজন অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, ভদ্রলোকের নাম ধরেন, এ।  এই এ ভদ্রলোকের মাথার তার একটা ছিঁড়া ছিল বিধায় মাঝে মাঝে জনসমক্ষে নির্দ্বিধায় মুখে যা আসতো, বেফাঁস টাইপের কথা বলে ফেলতেন। ওনার কথা শুনে জনগণ পড়ে যেত লজ্জায়, তাতে ওই ভদ্রলোকের কিছুই আসতো যেত না। কারণ ওনারতো তার ছিঁড়া, কে কী ভাবলো তাতে ওনার কী আসে যায়! সরকারি অফিস বিধায় ওনাকে মানবিক কারণে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় নাই, রেখে দেয়া হয়েছে এবং খুব হাল্কা ও কম কষ্টের কাজগুলি ওনাকে দেয়া হয়। তারপর আবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লোক বিধায় মেম্বার স্যারের নেকনজর ছিল ওনার প্রতি।

যাই হোক, বিকেলে আমাদের মোটিভেশনাল মিটিংয়ে যাওয়ার কথা। মিটিং ৫টায়। সাইটটা একটু দূরে, মিনিট বিশেক লাগে যেতে। স্যাররা ওনাদের রুম থেকে বের হলেন। ওনারা সামনে সামনে হাঁটছেন। আমরা, বিশেষ করে আমার মতো মাজুল অ্যাসিটেন্ট ডিটেক্টররা পিছনে। আমার সাথে সাথে ওই তারছিঁড়া ভদ্রলোকও আছেন। আমরা সবাই গাড়ি পোর্টে এসে দাঁড়িয়েছি গাড়িতে উঠবো বলে। প্রথমেই মেম্বার ইঞ্জিনিয়ারিং স্যারের গাড়ি। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কারপোর্টে কিন্তু ড্রাইভার মজিবর নাই। ডিরেক্টর স্যার ডেপুটি ডিরেক্টর স্যারকে বোল্লেন, দেখেন তো মজিবর কোথায় গেল।

ডেপুটি ডিরেক্টর আমাকে বোল্লেন, দেখেন তো মজিবর কোথায় গেল। আমি আমার পিছনে পিছনে আসা বাবুর্চি আর পিওনকে বোল্লাম, দেখো তো মজিবর কোথায় গেল। বাবুর্চি ও পিওন আর কাউকে বলতে পারলো না। কারণ ওদের নিচে আর কেউ নাই পদবি অনুযায়ী। আমাদের অফিসে কথ্য ছিল যে, সহকারী পরিচালক (আমরা) আর গাড়িচালকের মধ্যে কোনো তফারেন্স নাই।

একেই বলে সরকারি অফিসে ডেলিগেশন অফ অর্ডারস। এই ডেলিগেশন বিষয়টা ফাইলের পর্যায়ে খুব বেশি প্রচলিত ছিল এবং সেখানকার ভাষাটা ছিল, আপনার সদয় অবগতির জন্য পেশ করা হইলো। এই লাইনটা লিখে দিতে পারলেই সব মুশকিল আসান। বড় বসরা চাইতো সব সময় ছোট অর্থাৎ আমাদের দিয়ে কোনো একটা কাজকে ইনিশিয়েট করাতে, তাতে করে ওনারা ওনাদের চামড়া খুব সহজেই বাঁচিয়ে ফেলতে পারতেন। যদি ছোটদের দ্বারা ইনিশিয়েটেড কাজে পরবর্তীতে কোনো ঘাপলা হতো তবে যেকোনো অসুখেরই ওষুধ যেমন আছে তেমন অফিসের মধ্যে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টররাও ছিলেন আমাদের চামড়া বাঁচানোর প্রকল্পে নিয়োজিত। সেরকম একজন ছিলেন আমাদের দহিদ ভাই। প্রথম যখন জয়েন করলাম, আমাকে ডেকে শিখিয়ে দিলেন, যখনি দেখবেন যে কোনো ফাইলে আপনাকে কোনো বড় কাজ ইনিশিয়েট করার জন্য বড় বস বলছে, আপনি ওনার ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী পুরো কাজের বিবরণটা ফাইলে লেখার আগে একটা শব্দ লিখবেন, সেটা হলো, ‘আদিষ্ট হইয়া জানাইতেছি যে’। তারপর পুরো কাজটার বিবরণ লিখে শেষে লিখবেন, ‘আপনার সদয় অনুমোদনের জন্য পেশ করা হইলো’। ব্যস, আপনি সেইভ। বাঁইচা গেলেন। এরপর যদি কিছু হয় তখন বড় বসের বড় বস ওনাকে ধরবে এবং জিজ্ঞাসা করবে, ‘তুমি ক্যামনে অনুমোদন দিলা?’

আপনার কান ঘেইসা গুলি চলে যাবে, মাগার আপনার গায়ে লাগবে না। এরপর থেকে যেকোনো ফাইল আসলেই লিখে দিতাম, ‘অনুমোদনের জন্য পেশ করা হইলো।’ একেই বলে সরকারি অফিসের লাল ফিতার দৌরাত্ম। তবে এধরনের সব সময় যেকোনো কাজে নিজের স্কিন বাঁচানোর বিষয়টা একটা মানুষকে তার অথরিটি বা সামান্যতম সামাজিক অব্লিগেশন থেকে দূরে রাখে এবং অলস করে দেয়। এতে করে পুরো ডিপার্টমেন্টই ব্যাক লগে পড়ে যায়, কাজ হয় না। শুধু হয়, ‘অনুমোদনের জন্য পেশ করা হইলো’র খেলা। প্রতিটা সরকারি অফিসেই এ খেলা চলছে, খেলা চলছে, খেলে চলছে হরদম... একই খেলা চলছে হরদম...

ফিরে আসি আগের ঘটনায়। আমার কাছ থেকে ড্রাইভারকে খুঁজে আনার অর্ডার পেয়ে বাবুর্চি ও পিওন হাত কচলাতে কচলাতে কাচুমাচু হয়ে দৌড় দিল মজিবরকে খুঁজতে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি গাড়ি বারান্দায়। গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে মেম্বার, একজিকিউটিভ ডিরেক্টর ও পার্সোনাল ডিরেক্টর স্যারদের মধ্যে। আমরা মেহনতি আসিস্টেন্ট ডিরেক্টর ও ডেপুটি ডিরেক্টররা বাচ্চাদের মতো চেহারা করে শুনছি ওনাদের কথা। আমাদের ভাবখানা হলো, আমরা কিচ্ছু বুঝি না। ওনারা গলা উদারায় নিয়ে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে গুরুগম্ভীর আলোচনায় নিমগ্ন। দেখতে দেখতে প্রায় ১০ মিনিট চলে গিয়েছে। মেম্বার স্যারকে ১০ মিনিট দাঁড় করে রাখা আর ফারাক্কা বাঁধের বিশাল জলরাশিকে পুরাপুরি আটকে রাখা একই বিষয় আমাদের মতো খেটে খাওয়া খোকনের কাছে। আমি ঘামছি, ডেপুটি ডিরেক্টর ঘামছেন, ডিরেক্টর স্যার একটু বিরক্তি নিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন আর মেম্বার স্যার ও একজিকিউটিভ ডিরেক্টর স্যার তখনও দেশের উন্নয়নে নিমগ্ন। হঠাৎ মেম্বার স্যার ডেপুটি ডিরেক্টর ও আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা নাকি গান লেখো?

বলে রাখা ভালো যে, আমার ডেপুটি ডিরেক্টর স্যারকে আমিই গীতিকার বানিয়েছিলাম। অর্থাৎ ওনার একটা সাধারণ জীবন ছিল। উনি গান লিখতেন না, কালেভদ্রে দুয়েকটা ছড়া বা কবিতা লিখতেন। আমি ওনাকে একদিন বলেছিলাম, ‘স্যার, গান লেখার ট্রাই করেন না কেন?’ ব্যস, সব শেষ, বাকিটা ইতিহাস।

ওনার গান মাঝে মাঝে আমি সুর করতাম। বিনিময়ে উনি আমাকে দিতেন অফিস থেকে যেকোনো সময় বেরিয়ে যাওয়া, অফিসে দেরি করে আসা, মাঝে মধ্যে না আসার স্বাধীনতা। লাইফ ইজ বিউটিফুল ছিল। তবে একটা অসুবিধা ছিল, সেটা হলো গীতিকার হতে পেরে এবং ওনার লেখা গান প্রফেশনাল সিংগারদের মুখে শুনতে পেয়ে ওনার উৎসাহ ও আগ্রহ বেড়ে এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে, প্রতিদিন কম পক্ষে ৪/৫ টা করে গান লিখতেন। মাঝে মাঝে অফিস আসার পথে গাড়িতেই দুইটা ঝেড়ে দিতেন। এদিকে আমি পড়ে যেতাম বিপদে। অতো সুর আমার মধ্যে ছিল না যে, প্রতি বেলায় একটা করে ওনার কথা সুর করবো। চেষ্টা করতাম অফিসে ওনার মুখামুখি না হতে। মাঝে মাঝে উনি ডেকে পাঠাতেন এবং বলতেন, দেখেন আশিক সাহেব, এখনি লিখলাম। আমি বলতাম, বাহ, খুব সুন্দর হইছে স্যার।

ব্যস, উনি সাথে সাথে বলতেন, সুর করে ফেলেন এখনি। এ যেন অফিস অর্ডার। কী করুম, উপায় নাই, ওনার ওই অফিসে বসেই কোনো যন্ত্র ছাড়া সুর করতে শুরু করতাম। উনি আবার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিতেন। পিওনকে বলে দিতেন কেউ আসলে না করে দিতে। কী যে লাগতো, কী কমু! মাঝে মাঝে মনে হইতো, শালা চাকরিই ছাইড়া দিমু তবুও প্রতি বেলায় একটা কইরা গান আমি সুর করতে পারুম না। সুরেরও তো একটা সীমা আছে। সীমাহীন সুরতো আর করা যায় না।

মেম্বার স্যারের প্রশ্নে ফিরে আসি। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা নাকি গান লেখো? ডেপুটি ডিরেক্টর স্যার বল্লেন, জি স্যার, আমি লিখি আর আশিক সুর দেয়। আমার লেখা গান প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রবি চৌধুরী, ডলি শায়ন্তনি গেয়েছেন।

বিরক্তি নিয়ে মেম্বার স্যার বললেন, আজকাল কোনো গান হয় নাকি! সব আজেবাজে কথার গান। এসব কী লিখো তোমরা? দুয়েকটা পুরানো দিনের গান লিখতে পারো না?

আমি ও ডেপুটিডিরেক্টর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকলাম নীরবে।

যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ড্রাইভারকে না পেয়ে ডিরেক্টর স্যারের উশখুশ দেখে আমার প্যান্ট খুলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। এখন পর্যন্ত ড্রাইভারকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মধ্যে আমি হলাম অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর ট্রান্সপোর্ট। আমার মনে হচ্ছিলো, আমার ডিরেক্টরশিপ খুলে পড়ে গিয়েছে, শুধু অ্যাসিস্টেন্ট পদবিটা ঝুলছে, সাথে চাকরিটাও অন দ্য লাইন অর্থাৎ যায় যায় অবস্থা। এর মধ্যে আরও মিনিট পাঁচেক চলে গিয়েছে। হঠাৎ মেম্বার স্যার আমার দিকে চোখ টানটান করে গলা আরও খাদে নিয়ে বললেন, আশিক, তোমার ড্রাইভার কোথায়? কথাটা শুনে মনে হলো আমার চাকরি নাই। আমি রাস্তায় বাদাম বিক্রি করছি। শুধু একটা গান মনে পড়ে গেল, ‘আমি নেই, আমি নেই, ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়, যেই ভাবি আর কোনোখানে আমি নেই, আমি নেই’। এই ‘চাকরি নাই’ টার্মটা আমি এবং আমার কলিগ বন্ধু শওকাত (অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর পার্সোনাল) ইউজ করতাম সব সময়। শওকাত পরে বিসিএস করে চলে যায়। ও এখন কোনো এক জায়গার কাস্টমসের কমিশনার।

পার্সোনাল ডিরেক্টর ছিলেন আমার বসের বস, উনি আমার দিকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললেন, কি হলো আশিক, কিছু একটা ব্যবস্থা করো, ওকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসো। আমি পড়ি মরি করে দৌড় দিলাম স্টাফ কোয়াটারের দিকে। বেশ কয়েকটা জায়গায় ওকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসলাম। ওই তারছিঁড়া অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু একপা নড়েন নাই। ওনার কোনো ভ্রুক্ষেপই নাই ড্রাইভারের ব্যাপারে অথচ উনিও কিন্তু অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ট্রান্সপোর্ট। হঠাৎ দেখলাম দূর থেকে ড্রাইভার বেশ হেলেদুলে পান চিবাতে চিবাতে আসছে। সম্ভবত কম্পাউন্ডের বাইরে কোথাও গিয়েছিল। আমরা কেউ কিছু বলার আগেই ওই আসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার এত জোরে চিৎকার শুরু করে দিলো যে, আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ওনার দেশের বাড়ি যশোর। উনি একেবারে যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় তুই তুকারি করে ড্রাইভারকে চিৎকার করে বকতে বকতে বল্লেন, ‘আলো তুই গাড়ি ফেলে কনে গেছিস? তুই জানিস নে আমাগের মেম্বার সার সাইটে যাবি? তোর পাছা মায়রে লাল করে দেবানে।’

ওনার লাস্ট সেন্টেন্সটা শুনে মনে হলো, আমার চাকরি আসলেই নাই। লজ্জায় তাকাতে পারছি না কারো দিকে। সবাই লজ্জায় শেষ। সবাই সবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। ডিরেক্টর স্যার আমার দিকে চোখ লাল করে তাকাচ্ছেন। কারো মুখে কোনো কথা নাই। এরকম বড় বড় লোকের সামনে ‘পাছা মায়রে লাল করে দেবানে’ শুনতে যে কেমন লাগে, তা একমাত্র আমি জানি। যদিও আমাদের সবার একটা করে পাছা আছে এবং জনসমক্ষে এমন ভাব করি যে, পাছা বলে কোনো কিছুর সাথেই আমরা পরিচিত নই।