চলচ্চিত্রের অমরত্ব: সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির বিবর্তন

পর্ব ২

রাজীব জবরজং

প্রকাশিত : মে ১৬, ২০২৫

ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান: চলচ্চিত্র সংরক্ষণের ভিত্তি স্থাপন
চলচ্চিত্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অগ্রণী ভূমিকা অনস্বীকার্য। আইরিস ব্যারি, যিনি লন্ডন ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা । ১৯৩৫ সালে মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট moma সিনেমায় সাংস্কৃতিক মূল্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ফিল্ম লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে। মোমার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের সংগ্রহে আছে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্র এবং ১৫ লাখের বেশি স্থিরচিত্র। সিনেমাথিক ফ্রঁসেজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অঁরি ল্যাংলাও ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সিনেমার ইতিহাসে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও চলচ্চিত্র সংরক্ষণ আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি। যিনি চলচ্চিত্রের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

১৯৩৫ সালে ন্যাশনাল ফিল্ম লাইব্রেরির (পরবর্তীতে বিএফআই ন্যাশনাল আর্কাইভ) প্রথম কিউরেটর আর্নেস্ট লিন্ডগ্রেন চলচ্চিত্র সংরক্ষণ চর্চার বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার হাতেই প্রতিষ্ঠা হয় ফিল্ম আর্কাইভের মূলনীতি। জেমস কার্ড ১৯৪৭ সালে জর্জ ইস্টম্যান মিউজিয়াম ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম আর্কাইভগুলির মধ্যে একটি। ডেভিড শেপার্ড তার সংস্থা ফিল্ম প্রিজারভেশন অ্যাসোসিয়েটসের মাধ্যমে অসংখ্য নির্বাক চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যা তাকে তার বিশদ কাজের জন্য বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতিও এনে দিয়েছিল।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মার্টিন স্করসেসি ১৯৯০ সালে দ্য ফিল্ম ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। যা বিশ্বব্যাপী আর্কাইভ ও স্টুডিওগুলির সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ১০০০টিরও বেশি বিপন্ন চলচ্চিত্রের পুনরুদ্ধার ও চলচ্চিত্র সংরক্ষণের পক্ষে ভূমিকা পালন করে। এই সকল ব্যক্তিবর্গের আবেগ, নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতা চলচ্চিত্র সংরক্ষণের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা, ভিত্তিগত প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং সিনেম্যাটিক ঐতিহ্য রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে রেখেছে এক অপরিসীম অবদান। বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফিল্ম আর্কাইভের রয়েছে অনন্য ঐতিহাসিক অবদান।

১৯৩৫ সালে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট (মোমা) প্রথম দিকের ফিল্ম কোম্পানিগুলির মূল নেগেটিভ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ  করে। ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএফআই ন্যাশনাল আর্কাইভ সময়ের সাথে বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সংগ্রহশালা হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত। যা ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ঐতিহ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার কাজের জন্য নিবেদিত। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সিনেমাথিক ফ্রঁসেজ বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র নথি ও চলচ্চিত্র-সম্পর্কিত বৃহত্তম আর্কাইভগুলির মধ্যে অন্যতম। লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস সিনেমার প্রথম দিন থেকেই ফিল্ম সংরক্ষণে পালন করে সক্রিয় ভূমিকা।

বিশেষ করে কপিরাইট নিবন্ধনের জন্য জমা দেওয়া কাগজের প্রিন্টসমূহের সংরক্ষণ ছিল প্রথম দিককার গুরুত্বপূর্ণও কাজ। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউসিএলএ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্কাইভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্র সংগ্রহশালা। হলিউডের প্রধানতম স্টুডিওসমূহ ও স্বাধীন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে চলচ্চিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান প্রতিনয়ত রেখে যাচ্ছে দুর্দান্ত ভূমিকা।

১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জর্জ ইস্টম্যান মিউজিয়ামের রয়েছে ফিল্ম ও ফটোগ্রাফিক সামগ্রীর উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ। ৯০ দশকের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় এল. জেফ্রি সেলজনিক স্কুল অফ ফিল্ম প্রিজারভেশন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ফিল্ম সংরক্ষণ শিক্ষার অসাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা। এছাড়া একাডেমি ফিল্ম আর্কাইভ, একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স ও দ্য ফিল্ম ফাউন্ডেশনসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্রের ইতিহাস সংরক্ষণে মনোযোগী হয়ে রাখছে গুরুত্বপূর্ণও ভূমিকা।

ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া (এনএফআইএ) ভারতের বৃহত্তম ফিল্ম আর্কাইভ। ভারতীয় সিনেমার সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে এনএফআই’এর প্রয়াস ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ। এই সংরক্ষণাগার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশ্বব্যাপী সিনেমার বিচিত্র ইতিহাস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও তথপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক নথি হিসেবে চলচ্চিত্র পাঠে রেখে চলেছে উল্লেখযোগ্য অবদান।

১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম আর্কাইভস (এফআইএএফ) ঐতিহাসিকভাবে চলচ্চিত্রের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলিকে একত্রিত করার উদ্যোগ নেয়। যা ছিল চলচ্চিত্র সংরক্ষণে নীতিশাস্ত্রের নিয়মাবলি, ব্যবহারিক মান নির্ধারণ ও বিশ্বব্যাপী আর্কাইভগুলির মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধিতে অবিসংবাদিত উদ্যোগ।

ইউনেস্কো ১৯৮০ সালে চলচ্চিত্রকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যা বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ফিল্ম প্রিজারভেশন বোর্ড (এনএফপিবি) সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা নান্দনিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রগুলিকে সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৫টি নির্বাচিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন।

মার্টিন স্করসেসিসহ কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দ্য ফিল্ম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিপন্নপ্রায় চলচ্চিত্রসমূহের পুনরুদ্ধারকল্পে এবং বিশ্বব্যাপী আর্কাইভ ও স্টুডিওসমূহের সহযোগিতায় চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য তহবিল ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

ডিজিটাল বিপ্লব: চলচ্চিত্র সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের নতুন দিগন্ত
আধুনিক প্রযুক্তির উচ্চ-রেজ্যুলিউশনের ডিজিটাল স্ক্যানারগুলো 4K, 8K এবং এমনকি তারও বেশি রেজ্যুলিউশনে ফিল্ম থেকে ডেটা সংগ্রহ করতে সক্ষম। প্রযুক্তির এই ধারাবাহিকতার প্রেক্ষিতে অরিজিনাল ফিল্ম থেকে বিপুল পরিমাণে বিশদ তথ্য সংরক্ষণ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। ডিজিটাল ওয়ার্কফ্লো সংরক্ষণবাদীদের ঐতিহ্যবাহী ফটোকেমিক্যাল পদ্ধতির তুলনায় প্রায়শই অনেক বেশি নির্ভুলতার সাথে স্ক্র্যাচ, ময়লা, কাটাছেঁড়া ও রঙের ভারসাম্যহীনতাসহ বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত ক্ষতির বিপরীতে ফ্রেম-বাই-ফ্রেম সংশোধন করতে সক্ষম।

আশির দশকের শেষভাগে ডিজিটাল ইন্টারমিডিয়েট (ডিআই) আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণে নিয়ে এসেছিল নতুন সম্ভাবনা। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে পোস্ট-প্রোডাকশনের জন্য ফিল্মকে ডিজিটাল ফরম্যাটে স্ক্যান করা এবং উচ্চ-মানের ডিজিটাল মাস্টার তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে ফিল্মে থাকা তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং এমনকি তার মূল প্রকাশের গুণমানকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদী ডেটা হ্যান্ডলিং এবং মূল নান্দনিকতার সম্ভাব্য পরিবর্তন সম্পর্কিত জটিলতাও তৈরি করে।

বিশেষায়িত সফ্টওয়্যার ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন সরঞ্জামের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের পুনরুদ্ধার কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব।  যেমন ফিল্ম থেকে ময়লা এবং স্ক্র্যাচ অপসারণ, রঙের সংশোধন এবং গ্রেডিং, স্টাবিলাইজেশন এবং এমনকি অনুপস্থিত বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ফ্রেমগুলির ডিজিটাল পুনর্গঠন ।

এসমস্ত চলমান প্রযুক্তি সাথে হাল আমলে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যালগরিদমসমূহের ক্রমবর্ধমান বাস্তবতায় ক্ষয়িষ্ণু প্রায় চলচ্চিত্রের পুনরুদ্ধারে এআই রাখতে পারে  দারুণ ভূমিকা। ফিল্ম পুনরুদ্ধার ওয়ার্কফ্লোতে এআই-এর সংযুক্তি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা  এবং ফিল্মের তথ্য ও গুণমান বজায় রাখতে হতে পারে এক অপার সম্ভাবনার নাম । তবে মূল বিষয়বস্তুর পরিবর্তন কিংবা এআই’ এর   উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারে নৈতিক বিবেচনাও ভাবনার বিষয়।