
প্রচলিত ওয়াজ আসলে ইসলামের অবমাননা
মোহাম্মদ সাদিক আজিজপ্রকাশিত : নভেম্বর ২৮, ২০২১
বর্তমানে দেশের গ্রামঞ্চল ও শহরে প্রচলিত ওয়াজ মাহফিলগুলোতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। এতে অবশ্যি লাভের লাভ কিছুই হয় না, তবে ওয়াজির পকেট একটু ভারি হয়। একটি মাহফিলের আয়োজন করতে এক বছর আগে থেকেই শুরু হয় টেনশন। এক বছর আগে থেকে ঢাকার বক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। তাদেরকে পটাতে পাঠানো হয় নানা হাদিয়া। এরপরও তাদের সিডিওয়েল ঠিকঠাক পাওয়া যায় না।
প্রতিটি জায়গায় মাহফিলের জন্য চাঁদা তোলা শুরু হয় মাহফিলের কয়েক মাস আগে থেকেই। আর যদি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক সভা হয় তাহলে তো কথাই নেই। হাফেজি পড়া ছাত্রদেরকে রাস্তায় রাস্তায় টাকা কালেকশনের জন্য মাইক দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়। এইভাবে এতদিনের কষ্টের টাকা বড় বড় শায়েখ এক ঘণ্টা চিল্লায়ে, পাবলিকের রাতের ঘুম হারাম করে, শব্দদূষণ ঘটিয়ে আরামসে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে হাসিমুখে ঢাকায় ফেরেন।
এটা সুস্পষ্টভাবে ইসলামের অবমাননা। প্রকৃত ইসলাম এখানে কোত্থাও নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে ইতিকাফ-কালে সাহাবিদেরকে উচ্চস্বরে ক্বিরাআত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন, জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় প্রতিপালকের সাথে চুপিসারে আলাপে রত আছো। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিও না এবং পরস্পরের সামনে ক্বিরাআতে বা সালাতে আওয়ায উঁচু করো না। (সুনান আবূ দাঊদ, সালাত অধ্যায়, হাদিস ১৩৩২)
আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেছেন, তুমি প্রতি জুমআয় লোকদের হাদিস শোনাবে। যদি এতে তুমি ক্লান্ত না হও তবে সপ্তাহে দু’বার। আরও অধিক করতে চাও তবে তিনবার। আরও অধিক নসিহত করে কুরআনের প্রতি মানুষের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করো না। লোকেরা তাদের কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় তুমি তাদের কাছে এসে তাদের নির্দেশ দেবে, আমি যেন এমন অবস্থায় তোমাকে না পাই। কারণ এতে তাদের কথায় বিঘ্ন সৃষ্টি হবে এবং তারা বিরক্ত হবে। বরং তুমি এ সময় নীরব থাকবে। যদি তারা আগ্রহ নিয়ে তোমাকে নসিহত দিতে বলে তাহলে তুমি তাদের নসিহত দেবে। (বুখারি, অধ্যায় দুয়াসমূহ, হাদিস ৬৩৩৭)
তো বুজুর্গানে দ্বীন, বোঝা গেল তো প্রচলিত ওয়াজে মাইকে কানফাটানো চিৎকার আর থেকে থেকে ওয়াজির কোঁতন কতটা ইসলামিক আর কতটা অনৈসলামিক? একটি অনৈসলামিক কাজে এই যে লাখ লাখ টাকা খচর করা, এটাও ইসলামি আদর্শবিরোধী কাজ। অথচ এই টাকায় মানুষের ও সমাজের হিতকর অনেক কাজ করা যায়, যা আমরা করি না। অথচ মানুষের মঙ্গলের জন্য এই টাকা খরচ করলে তা হবে সদগায়ে জারিয়া। যা আপনার মৃত্যুর পরও জারি থাকবে।
মাহফিল আয়োজনের এই লাখ টাকায় কি কি করা যায়, এবার সে বিষয়ে একটু ধারণা করা যাক।
১. গ্রামাঞ্চলে ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প।
২. ফ্রি চক্ষু সেবা।
৩. সুদ ধ্বংস করে কার্জ হাসানা প্রজেক্ট।
৪. গভীর নরকূপ স্থাপন (গ্রীষ্মে যেখানে পানির জন্য হাহাকার হয়ে ওঠে)।
৫. রাস্তা মেরামত।
৬. যে পরিবার টাকার জন্য মেয়ে বিবাহ দিতে পারছে না।
৭. অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা।
৮. অসচ্ছল ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রি পাঠদান কেন্দ্র।
ইত্যাদি ইত্যাদি...
ট্রেডিশনাল মাহফিল বিকল্প প্রস্তাবনা:
১. জুমার খুৎবায় বিষয়ভিত্তিক আলোচনা।
২. সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা, কুনুতে নাজেলা পাঠ।
৩. অঞ্চলভিত্তিক মাসে বা তিন মাসে একবার বিশেষ আলিম দিয়ে, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব ও আলোচনা।
৪. মহিলাদের জন্য সাপ্তাহিক প্রশ্ন-উত্তর পর্ব ও মাসআলা মাসায়েল বৈঠক আয়োজন করা।
৫. যুবক এবং মুরব্বিদের মসজিদভিত্তিক কোরআন ও মৌলিক বিষয় কোর্স পরিচালনা।
৬. মসজিদ ও অঞ্চলভিত্তিক জ্ঞানের জন্য লাইব্রেরি তৈরি করা।
বর্তমানে প্রচলিত ওয়াজ মাহফিল আসলে টুপি-দাঁড়িঅলা কিছু মানুষের মৌসুমি বাণিজ্য। প্রশ্ন জাগে, শীত এলেই কেন এই ওয়াজ বাণিজ্য শুরু হয়? ইসলাম প্রচার কি শুধু শীতকালেই করতে হয়, গরমে কি ইসলামের ছুটি থাকে? অথচ আমরা জানি, ইসলাম এমনই এক জীবনব্যবস্থা যেখানে একজন মানুষের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ে ইসলাম নির্দেশ দ্যায়। ইসলাম কোনো বিশেষ ঋতুতে প্রচার করতে হবে, আর বাকি সময় চুপচাপ থাকতে হবে, এমন কোনো নির্দেশনা কোরআন কিংবা হাদিস থেকে আমরা পাইনি।
দেশের লাখ লাখ মূর্খ মুসলমান প্রচলিত ওয়াজিদেরকে ইসলামের আলিম মনে কোরে তাদের বলা কথাবার্তাকেই ইসলামি জ্ঞান হিশেবে মেনে নিচ্ছে। এ অবস্থায় প্রকৃত ইসলামি আদর্শ হারিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মুসলমান বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। এরই ফলে মুসলমানদের ভেতর বাড়ছে নানা দল-উপদল।
আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, এসব ওয়াজি ছাড়াও দেশে অনেক প্রকৃত আলিম রয়েছেন যারা শতভাগ প্রকৃত ইসলামি আদর্শ প্রচারে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। আমরা যেন তাদের খুঁকে বের করি, এবং তাদের কাছ থেকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করি।