ইবনে হাযম আল আন্দালুসি

ইবনে হাযম আল আন্দালুসি

প্রেম: বিস্মৃতি ও প্রবোধ

ইবনে হাযম আল আন্দালুসি

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩১, ২০২২

মুসলিমরা স্পেন তথা আন্দালুসিয়ায় যে সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলছিলেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছিল পরবর্তীতে ইউরোপের রেনেসাঁর ওপর, সেই সভ্যতার ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট প্রোডাক্ট ছিলেন ইমাম ইবনে হাযম আল আন্দালুসি (৩৮৪-৪৫৬ হি.)। তিনি ছিলেন প্রকৃত পলিম্যাথ; মুসলিম স্পেনের শ্রেষ্ঠ স্কলারদের একজন। কোরআন, হাদিস, ইসলামি আইন, জুরিস্প্রুডেন্স, সাহিত্য, কবিতা, কালাম, গ্রিক দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইতিহাস— কী নিয়া লেখেন নাই উনি!

 

ইবনে হাযমের বাবা ছিলেন স্পেনের তৎকালীন হাজেব মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আবু আমের আল মানসুর (যিনি উমাইয়া খলিফা দ্বিতৗয় হিশামের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন) ও তার ছেলে আল মুজাফফরের উজির। তারা থাকতেন সরকারি কোয়ার্টারে। সেখানেই হেরেমের নারীদের কাছে ইবনে হাযমের পড়ালেখার হাতেখড়ি।

 

সুন্নিদের চার মাজহাবের বাইরেও একটা পঞ্চম মাজহাব হইল `যাহেরি মাজহাব`। যাহেরিরা কোরআন-হাদিসের বাহ্যিক অর্থের ওপর ভিত্তি কইরাই ফিকহ নির্ধারণ করত, এবং সাহাবিদের ফতোয়া, কিয়াস, এসতেহসান— এসব জিনিশরে আইনের উসুল হিশাবে মানত না। দাউদ যাহেরির (১৯৯-২৬৯ হি.) পর ইবনে হাযম ছিলেন যাহেরি স্কুল অব থটের দ্বিতীয় প্রধান তাত্ত্বিক। তার বিপুল পরিমাণ লেখালেখির ফলেই যাহেরি স্কুল অব লিগাল থট পরবর্তীতে আরো প্রমিনেন্ট হয়। চার মাজহাব বা বিধিবদ্ধ আইনি চিন্তার এগেইন্সটে, সেসময় ইবনে হাযমের প্রস্তাবিত ফিকহি প্রস্তাব বেশ রেভ্যুলুশনারিই ছিল বলা লাগবে; প্রতিষ্ঠিত ইসলামি আইন-কানুনের উসুলরে নানাভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন উনি। ফলে, তার ইডিওলজিকাল ও পলিটিকাল অপোনেন্টরা তার অনেক বই পুড়িয়ে ফেলছে সেসময়।

 

আধুনিককালে সালাফিজমের জোয়ারের মধ্যেই ইসলামি আইন নিয়া নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু হওয়ার সিলসিলা ধইরা, ইসলামি অ্যাকাডেমিয়ায় ইবনে হাযম আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ইবনে হাযমের লেখাজোকার পরিমাণ বিপুল। ফিকহ ও হাদিস বিষয়ক লেখাপত্রের বাইরে, তার সবচেয়ে সেলিব্রেটেড বই হইল `তওকুল হামামা`। এই বইয়ের বিষয়বস্তু `প্রেম`। সুফিতত্ত্বে যে প্রেম নিয়া বিশদ আলাপ আছে, সেই প্রেম না; নর-নারীর প্রেমই এই বইয়ের মূল বিষয়। প্রেম কী, প্রেমের আলামত কী কী, কী কী কারণে একজন মানুশ প্রেমে পড়ে, প্রেমে পড়ার পরবর্তী ধাপগুলা কী কী, কীভাবে প্রেমের পরিচর্যা করতে হয় বা কীভাবে প্রেম আস্তে আস্তে মুইছা যায়— এইসব নিয়াই বইটাতে আলাপ করছেন ইবনে হাযম। মূলত, সেকালে অভিজাত সমাজে নর-নারীর মধ্যে প্রচলিত প্রেম-ভালবাসা নিয়া তিনি এক ধরনের দার্শনিক ও সাইকোলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ হাজির করছেন এই বইতে। এটারে `আর্ট অব লাভ` জনরার বই বলা যায়। যদিও, আলাপের ফাঁকে ফাঁকে, লিগাল আসপেক্ট থেকেও প্রেম বিষয়ে দুই একটা অস্পষ্ট মন্তব্য করছেন উনি।

 

যেমন বইয়ের শুরুতেই তিনি লেখছেন, `প্রেমের শুরুটা কমেডি, শেষটা ট্রাজেডি...এটা দ্বীনদারির প্রতিবন্ধক বা শরিয়তে নিষিদ্ধ কোনো ব্যাপার না। কারণ, কলবের চাবি তো খোদার হাতে।` (তওকুল হামামা, পৃ. ৫)

 

বিষয়বস্তুর কারণে তো বটেই, অসামান্য সাহিত্যমূল্যের কারণেও বইটা পশ্চিমা অ্যাকাডেমিয়া ও সাহিত্যজগতে বেশ সেলিব্রেটেড। আরবি সাহিত্যে `আর্ট অব লাভ` বিষয়ক লিটারেচারে একরকম পথ-প্রদর্শক বলা যায় এই বইটারে। বইটাতে প্রেমের নানা দিক আলোচনা করতে গিয়া নিজের ও সমসাময়িক অন্য অনেকের পার্সোনাল লাইফের বেশ ইনটেন্স ও আবেগি স্মৃতিচারণও করছেন ইবনে হাযম। ফলে বইটা একইসাথে সেসময়ের জ্ঞানচর্চা, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার এক ধরনের ঐতিহাসিক দলিলও হয়ে উঠছে। বইটাতে ইবনে হাযমের ভাষা অ্যাকাডেমিকের না, একজন কবির; বইয়ের বিষয়বস্তু শুধু প্রেম-ভালবাসাই না, এসবের সূত্র ধইরা সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্যও।

 

এই বইয়ের `প্রেম: বিস্মৃতি ও প্রবোধ` নামক অধ্যায়ে উনি নিজের টিনএজ লাইফের একটা প্রেমের বেশ বিস্তারিত, জীবন্ত, আবেগঘন ও সাহিত্যিক বর্ণনা দিছেন। আত্মীয়দের মধ্যেই কোন এক নারীর ১৬ বছর বয়সী এক পরিচারিকার প্রেমে পড়েন ইবনে হাযম; তখন তার বয়স ১৪-১৫। এরপর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের কারণে ইবনে হাযমের বাবা চাকরিচ্যুত হন; তাদের ক্ষমতা ও বিত্ত-বৈভবে পড়ে কালের রেদার টান। রাজধানী কর্ডোভা ছেড়ে গ্রামে চইলা যান তারা। এরপর ইবনে হাযমের বয়স যখন ১৮, তখন আবারও এক আত্মীয়ের ফিউরেনালে ওই মেয়ের সাথে তার দেখা হয়।

 

এরপর ইবনে হাযম আবারও রাজধানী ছাড়েন; ইবনে হাযমের পরবর্তী লাইফ ছিল একরকম যাযাবরেরই জীবন। সাত বছর পর, ইবনে হাযমের বয়স যখন ২৫, তখন আবারও কর্ডোভা ফেরেন তিনি; দেখা হয় ওই মেয়ের সাথে। ইবনে হাযম এই পুরা ঘটনার বেশ বিস্তারিত ও নস্টালজিক বর্ণনা দিছেন বইয়ের ওই অধ্যায়ে।

 

এই লেখায় উনি তার প্রেমিকার যে বর্ণনা দিছেন, তা একজন ষোড়শী নারীর রূপ ও মনোজগৎ সম্পর্কে আরবি সাহিত্যের ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট ন্যারেশন। ভাষার উচ্ছ্বলতা, বর্ণনার সততা, ভাবের ব্যাকুলতা, উপলব্ধির গভীরতা, সর্বোপরি একজন ব্যর্থ প্রেমিকের ব্যর্থ প্রেমের তাজা, দগদগে ও কাব্যিক স্মৃতিচারণ— সব মিলে ইবনে হাযমের এই লেখা হয়ে উঠছে প্রেম বিষয়ক একটা দারুণ ছোটগল্প। এত স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্লিপ্ত ও অকপট ভাষায় সেসময়ের আর কোন স্কলার বা কবি মানবজীবনের এই অনিবার্য দিকের অভিজ্ঞতা উন্মোচন করছেন বলে আমার জানা নাই। এই একতরফা প্রেমের স্মৃতি পরবর্তীতে তার জীবন ও মনস্তত্ত্বের উপর কেমন প্রভাব ফেলছিল, তিনি কীভাবে ধীরে ধীরে একজন দৃঢ় মানসিকতার লোক হয়ে উঠলেন, জীবনের ব্যর্থতা ও বেদনারে আত্মস্থ করতে শিখলেন, নারীর রুপ ও মনোজগৎ বিষয়ে তার ফিলোসফি ও চিন্তায় এই ঘটনা কী প্রভাব ফেলছে, তাও তিনি লিখছেন `তওকুল হামামা`র পাতায় পাতায়।

 

এই লেখাটা পাঠকদের জন্য অনুবাদ করছি আমি। লেখায় ব্যবহৃত আব্বাস ইবনে আহনাফ ও ইবনে হাযমের কবিতাগুলার তরজমাও আমার। পড়েন। —তুহিন খান

 

আমাদের ঘরেই বড় হওয়া এক পরিচারিকার প্রতি বেশ প্রেমপূর্ণ আসক্তি জন্মায় আমার। ওই মেয়ের বয়স তখন ষোল। বেহদ সুন্দরী ছিল মেয়েটা; ছিল বুদ্ধিমতী, শুদ্ধ সতী, পাক-পবিত্র, লাজুক আর বেশ নম্র-ভদ্র। ন্যাকামি বা ভাঁড়ামি তার স্বভাবে ছিল না বললেই চলে; কাউরে পাত্তা দেওয়ার ব্যাপারে সে ছিল মারাত্মক সংযত; অনুপম রূপের গরিমা সে ঢাইকা রাখত পর্দার আড়ালে; ছিল সে অপাপবিদ্ধ, মিতবাক আর আনতনয়না। মারাত্মক চৌকান্না, সবরকমের দোষ-ত্রুটি-মুক্ত এই মেয়ে ছিল সদাগম্ভীর, চাপা স্বভাবের, তার উপেক্ষাও ছিল কী যে মিষ্টি! অনাহুত আগন্তুকদের তাড়ায়ে দেওয়ার শৈল্পিক দক্ষতা আয়ত্বে ছিল তার। নিজেরে সে বসাইছিল গৌরবের আসনে; আচরণে-উচ্চারণে ছিল স্থির, শান্ত, অনুত্তেজিত। পুরুষের নানাবিধ নজর এড়ায়ে সচকিত পাখির মতো তার উইড়া যাওয়ার দৃশ্য ছিল দেখার মতো!

 

সহজে পাওয়ার মতো মেয়ে ছিল না সে; তারে পেয়ে যাওয়ার সকল আশাই ছিল দুরাশা; আর এসব দুরাশা কোন পাত্তাই পাইত না তার কাছে। তার চেহারা সবাইরে কাছে টানত; কিন্তু তার চালচলন ও আচার-আচরণে আশেকের দল ব্যর্থ মনে ফিরা আসতে বাধ্য হইত! অন্য মেয়েদের সম্মতি ও উদার সমর্পণের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় ছিল তার অসম্মতি ও প্রত্যাখ্যান। নিজের জীবনটাই সে ব্যাকুলভাবে যাপন করে যেত কেবল; হাসি-মজাকে তার তেমন কোন আগ্রহই ছিল না। তবে উদ (ল্যুট) বাজানোতে সে ছিল খুবই পাকা।

 

তো আমি এই মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লাম; মারাত্মকভাবে তার প্রেমে হাবুডুবু খাইতে লাগলাম। তারপর প্রায় ২ বছর, সাধারণ কথাবার্তার বাইরে তার মুখ থেকে একটামাত্র সম্মতিসূচক শব্দ শোনার আশায় আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা কইরা গেলাম; কিন্তু বলাইবাহুল্য, এর ফলাফল ছিল জিরো।

 

এই মুহূর্তে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়তেছে আমার। অভিজাত লোকদের ঘরে নানা উপলক্ষে এ ধরনের উৎসব হইত। ওই অনুষ্ঠানে আমাদের ও আমার ভাইয়ের (আল্লাহ তার ওপর রহম করুক) ঘরের মহিলারা, আমাদের দাসী ও বাড়ির পরিচারিকারা একত্র হইছিল; সকলেই ছিল বেশ হাসিখুশি আর আমুদে।

 

দিনের শুরুতে বেশ কিছু সময় ঘরেই ছিল তারা; তারপর আমাদের বাড়ির বাগানের ঠিক উপরে, ঘরের একটা গম্বুজে উঠে গেল সবাই। ওখান থেকে পুরা কর্ডোভা শহরটা ভালভাবে দেখা যায়; বাড়িঘরের খোলা দরজা-জানালাগুলা চোখে পড়ে। তারা জানালার ফাঁক দিয়ে এইসব দেখতে লাগল; আমিও তখন তাদের সাথে ছিলাম। আমার মনে পড়ে, ওই মেয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় আমি দ্বিধান্বিত পায়ে দুরুদুরু বুকে, সে যেই জানালার সামনে দাঁড়ায়েছিল, ওই জানালার দিকে আগাইছিলাম। সে আমারে দেখামাত্রই আস্তে করে ওই জানালা ছাইড়া অন্য জানালায় গিয়া দাঁড়াইল। আমি তখন ওই জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইতে চাইলাম; সে আবারও একই কাজ করল— অন্য জানালায় চলে গেল। আমি যে তারে ভালবাসি, এইটা জানত সে; কিন্তু অন্য মহিলারা ব্যাপারটা টের পাইল না। প্রথমত, প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে; আবার, সব জানালার ভিউ একরকম ছিল না; ফলে সকলেই একটু পরপর এক জানালা থেকে আরেক জানালায় যাচ্ছিল—এটাও একটা কারণ।

 

জেনে রেখো বন্ধু, মরুভূমিতে নৈশ-মুসাফির যে দক্ষতা নিয়া পায়ের চিহ্ন বুইঝা বুইঝা পথ চলে, তার চেয়েও দক্ষ আন্দাজে নারীরা পুরুষের মনে লুকানো আসক্তি ধইরা ফ্যালে। যাহোক, একপর্যায়ে মহিলারা সবাই বাগানে নাইমা আসল। বৃদ্ধ ও সম্ভ্রান্ত মহিলারা ওই মেয়ের গান শোনার জন্য তার মালকিনের কাছে অনুরোধ জানাইল; মালকিন তারে গান গাইতে বলল। তখন সে লাজুক হাতে আস্তে আস্তে তার ল্যুটের তারগুলা বাঁধতে লাগল; এরকম লজ্জা ও নম্রতা আমি আর কখনো দেখছি বলে মনে পড়ে না। যদিও সত্য বলতে, যেকোন জিনিশ তার অনুরাগীর চোখে একটু বেশিই সুন্দর। তারপর সে আব্বাস ইবনে আহনাফের সেই বিখ্যাত লাইনগুলা গেয়ে উঠল:

 

অস্তমান সূর্য দেখে বিহ্বল আমার হৃদয়
অস্তাচল যেন তার সাজানো শয়নকক্ষ আজ
মিহিরের ছদ্মবেশে কোন এক বালিকার দেহ
কোমর তো নয়— যেন শুভ্র শাদা কাগজের ভাঁজ

 

মানুশের মত তবে নিশ্চিত, মানুশ সে নয়
পরীও তো নয়। তবু রূপ দেখে লাগে যেন পরী
চেহারা মুক্তো আর শরীর বিরল জেসমিন
কস্তুরি-সুবাসে তার পুরোটাই নুরের তৈয়ারি।

 

যখন সে হেঁটে যায় মসৃণ শরীরী পোশাকে
কাচপাত্রে জমে থাকা শুভ্রতার মত লাগে তাকে।

 

জীবনের কসম! লাগতেছিল, ওর মিজরাব (ল্যুটের পিক) যেন আমার হৃদয়ের তারে একের পর এক টোকা মারতেছে। সেই দিনটা আমি ভুলি নাই; মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই দিনটা আমি ভুলব না। সেদিনই আমি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তারে দেখার ও তার কথা শোনার সুযোগ পাইছিলাম। এই নিয়া কবিতাও ফাঁদছি আমি:

 

যদি সে দূরেই থাকে, প্রত্যাখ্যান করে
তবুও সে ভর্ৎসনার যোগ্য নয়—
চাঁদ কি কারো কাছে থাকে?
হরিণী কি বেশরম হয়?

 

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কবিতা লেখছিলাম এমন:

 

দেখতে দাওনি চেহারার নূর
হওনি আলাপরতা—
মেবি তুমি রোজা রাখছিলা, তাই
বলো নাই কোনো কথা!
গাইছিলা তবু সুখ সুখ মনে
আব্বাসের বয়াত
কী সৌভাগ্য আব্বাস আলির
কেয়া বাত, কেয়া বাত!
আব্বাস যদি দেখতে পারত
তোমার রূপের শোভা
ঘেন্না করত ফাওযরে আর
দুখে হয়ে যেত বোবা।

 

...এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। একদিন হঠাৎ এক আত্মীয়ের জানাযায় মেয়েটারে দেখলাম আমি। বেশ শোরগোল চলতেছিল জায়গাটায়; কান্নারত, চিৎকাররত নারীদের মাতম-আহাজারির মধ্যে দাঁড়ায়ে ছিল সে। বহুদিন আগে অজ্ঞানের অন্ধকারে হারায়ে যাওয়া অনুভূতি তারে দেখে ফের জেগে উঠল; শান্ত হৃদয়ে উঠল পিরিতের ঝড়। তারে দেখে মনে পড়ে গেল বহুকাল আগের সেই বিশ্বস্ততা, পুরান পিরিত, বিগত মহাকাল, তামাদি হয়ে যাওয়া মুহূর্তসকল, কেটে যাওয়া কত মাসের হিশাব, ভাসা ভাসা স্মৃতির চাপ, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া কত রাত আর দিন, যে দিন একেবারেই গেছে, যার কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট নাই। চেপে রাখা দুঃখগুলারে খোঁচায়ে তুলল সে; বেদনার জখমগুলারে করল তাজা আর দগদগে।

 

সেদিন নানা কারণে ব্যথিত ও দুর্দশাগ্রস্ত ছিলাম আমি, তবু মুহূর্তের জন্যেও তারে ভুলতে পারলাম না; উল্টো কষ্ট বেড়ে গেল, অনুরাগের ছাইচাপা আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল, ব্যাপক দুঃখ পাইলাম, আফসোসে পুড়তে থাকলাম ক্রমাগত। হৃদয়ে চাপা পড়া অনুভূতিগুলা বাসনার আর্তনাদে সাড়া দিল, বেদনা-জর্জরিত কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসল কবিতা, তার একটা লাইন ছিল এমন—

 

সসম্মানেই মরে যাওয়া এক লোকের জন্য কাঁদছ?
অথচ এমন কান্নার রোল জিন্দালাশেরই পাওনা
মুর্দার শোকে যে কর মাতম, তারে বলি— হায় হায় রে
জুলুমে শহিদ আমার জন্য কাঁদতে কি কেউ চাও না?

 

...৪০৯ হিজরির শাওয়াল মাসে আমি আবার কর্ডোভায় ফিরলাম। পরিচিত এক নারীর বাসায় এসে আবারও দেখলাম সেই মেয়েরে! তারে আমি ঠিকঠাক চিনতেই পারলাম না, পরে একজন বলল: `এ তো অমুক!` অবাক হয়ে দেখলাম, তার সেই আগের রূপ আর নাই, ত্বকের সজীবতা ম্লান হয়ে গেছে, মুইছা গেছে চেহারার দীপ্তি; চকচকে তরবারি অথবা ভারতীয় আয়নার মত ঝকঝকে সেই লাবণ্যপ্রভা হারায়েই গেছে প্রায়। সেই মুকুল শুকিয়ে গেছে যার দিকে একদা স্থির উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে থেকে, হৃদয়ের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার পথ খুঁজে খুঁজে, হয়রান হয়ে ফেরত আসা লাগত। দেখলাম, বিগত লাবণ্যের স্মারক হয়ে জেগে আছে সেই আগুন রূপের সামান্য কিছু আভা!

 

তার এই দশা হইছে কারণ— সে ঠিকমত নিজের যত্ন নেয় নাই; যখন আমরা ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ছিলাম, তখন সে যে আশ্রয় ও প্রশ্রয়টুকু পাইত, পরে তা আর পায় নাই; আর নানারকম প্রমোদভ্রমণে নিজেরে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হইছে, যা থেকে সে আগে ছিল মুক্ত, সুরক্ষিত।

 

নারী তো এক সুগন্ধী লতা: ঠিকঠাক যত্নের অভাবে সুঘ্রাণ হারায়; নারী তো এক সুশ্রী কাঠামো: ধারাবাহিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হুড়মুড় করে ভাইঙা পড়ে। এজন্যই কেউ একজন বলছেন: পুরুষের সৌন্দর্য অধিকতর সত্য, দৃঢ়, মৌলিক ও শ্রেষ্ঠ। কারণ পুরুষ সাধারণত এমন সব প্রতিকূল জিনিশ মোকাবেলায় সক্ষম, যার সামান্য আঁচ লাগলেই নারীর চেহারা পুরাপুরি বদলে যেতে পারে; যেমন: মধ্যদুপুরের গনগনে রোদ, সাইমুম ঝড়, কুবাতাস, আবহাওয়ার বিবর্তন, গৃহহীন যাযাবর জীবন!

 

যদি আমি ওই মেয়ের একটু কাছে আসতে পারতাম, সে যদি আমারে সামান্য পাত্তাও দিত, তাইলে নিজেরে একজন সুখী মানুশ ভাবতাম আমি; হয়ত খুশিতে মইরাই যাইতাম। কিন্তু তার ক্রমাগত নির্লিপ্ততা আমারে সবর শিখাইছে, নিজেই নিজের সান্ত্বনা খুঁইজা নেওয়ার পথ দেখাইছে। (তওকুল হামামা, `প্রেম: সান্ত্বনা ও প্রবোধ`, পৃ. ১০৯-১১২)