প্রেম: সৌন্দর্যের তাড়না নাকি শরীরের উত্তেজনা

হৃদ্য আবদুহু

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০২২

নারী ও পুরুষের মধ্যে যে আকর্ষণ শাদামাটাভাবে মানুষ তাকে প্রেম হিসেবেই বোঝে। কিন্তু প্রেমের ভেতর যে রহস্য ছড়ানো রয়েছে, তার হদিস তারা খুব একটা পায় না। প্রেম কি শরীরের উত্তজনা, নাকি আত্মার কাতরতা? অথবা একইসঙ্গে দুটোই। সুফিকবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি লিখেছেন:

প্রেমিক-প্রেমিকা যারা
রাতদিন তারা করে যাবে দ্রাক্ষাসুধা পান
যতক্ষণ না টেনে ছিঁড়ে বিলোপন করে দিচ্ছে
বোধের ওপর চেপে বসে থাকা অবগুণ্ঠন
আর নিঃশেষে গলে যাচ্ছে
শরম ও বিনয়ের গায়ে গায়ে যত আস্তরণ
অবিরাম, একরোখা, পান করে যাবে তারা

প্রণয়ে মজে যখন মন
দেহটা কি থাকে? মনটাও থাকে কি তখন?
প্রণয়ে গলিত হলে, হৃদয় ও আত্মার অর্থ কী তেমন?

মানুষের দুটো অংশ। একটি শরীর, আরেকটি আত্ম। এ দুটো নিয়েই পৃথিবীর আরসব মানুষের থেকে আড়ালের এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় নারী-পুরুষের। শরীর দৃশ্যমান আর আত্মা অদৃশ্য। শরীরের যে রকম খাদ্য দরকার, আত্মারও সে রকম খাবার দরকার। আত্মার খাবার হচ্ছে সৌন্দর্য। প্রায়ই শোনা যায়, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেকিকের আত্মহত্যা অথবা প্রেমিকার। মানে কী এর? ওই প্রেমিক মেয়েটির ওপর মনের দিক দিয়ে এতটাই নির্ভর হয়ে পড়েছিল যে, তার বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল ওই মেয়েটি। আর তাই ধরাধামে শরীর ফেলে রাখার দরকার সে মনে করেনি।

পুরুষ আসলে নারীর প্রেমে পড়ে না। পড়ে তার সৌন্দর্যের। সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটাতেই তৃষ্ণাকাতর আত্মা মুগ্ধ হয় বিশেষ কোনো নারীকে দেখে। কিন্তু সেই তৃষ্ণা মেটানোর উপায় কি? উপায় হচ্ছে শরীর। পুরুষ তার শরীর নারীশরীরের ভেতর লীন করে দিয়ে আত্মার তৃষ্ণা মেটাতে চায়। নারী তো আসলে রক্তমাংসের একটি কাঠামো। ওই কাঠামোর ভেতর জৈবিক তাড়না আছে। জৈবিক তাড়না পুরুষেরও রয়েছে। দুই শরীরের তাড়না যখন শীর্ষ অনুভূতিতে সাড়া তোলে, তার নামই হয়তো প্রেম। সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতা যে রকম একটি প্রবৃত্তি, কামনাও সে রকম একটি প্রবৃত্তি।

প্রেমিক যখন প্রেমিকাকে চোখের সামনে দ্যাখে, সে মুগ্ধ হয়। বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন। প্রেমিকা যখন দূরে থাকে সে সময় তার মুখখানা প্রেমিক যখন মনের আয়নায় দ্যাখে, কী যে আনন্দ হয় তার! ভালো লাগার শিরশির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে তার বুকের ভেতর।  এর মানে কি? সৌন্দর্যের তাড়না নাকি শরীরের উত্তেজনা? প্রেমিকার যে সৌন্দর্য দেখে প্রেমিকের এই অবস্থা, প্রেমিকা কি সত্যিই সে রকম সুন্দর? তা কিন্তু নয়। যদি তা হতো তাহলে জগতের সব পুরুষই ওই নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতো। আসলে প্রেমিকের অনুভূতি প্রেমিকার অবয়ব নিয়ে যতটা সৌন্দর্য প্রেমিককে দেখাতে পারে, ঠিক ততটাই ওই প্রেমিকার সৌন্দর্য। সহজ কথায়, প্রেমিক তার আত্মার সৌন্দর্যতৃষ্ণা মেটাতে প্রেমিকার ওপর তার সৌন্দর্য-অনুভূতিকে আরোপ করে।

আর এরপর প্রেমিক ভ্রমণ করতে চায় প্রেমিকার ভেতর। সাধারণ পুরুষের দৌড় এই পর্যন্তই। কিন্তু জগতে যারা বিশেষ প্রজ্ঞার অধিকারী মহাপুরুষ, তারা সর্বাংশে প্রেমিকাকে পেতে চান। কেননা, তাদের আত্মোপলব্ধি সাধারণ পুরুষ থেকে অনেক বেশি। আর তাই প্রেমিকার শরীরের ভেতর লীন হয়েও কারো কারো আত্মার তৃষ্ণা মেটে না। কারণ, তিনি জানেন প্রেমিকা শুধুই শরীর নয়, সৌন্দর্যের গন্তব্য। সৌন্দর্যতৃষ্ণার গন্তব্যে পৌঁছতে মহাপুরুষদের তাড়না সাধারণ পুরুষদের থেকে অনেক বেশি। কী রকম সেই তাড়না? প্রেমিকার জন্যে তাদের বুকে যে হাহাকার ঢেউ তুলত, তা কী ভাষায় তারা প্রকাশ করতেন? জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হতে হতে কেউ কেউ বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছেন প্রেমিকার সৌন্দর্যকে। কেন? প্রেম কি তবে জীবনযন্ত্রণার ঊর্ধ্বে কোনো আধ্যাত্মিক সান্ত্বনার প্রলেপ?

আবার দেখি, কেউ কেউ ছুটে বেড়িয়েছেন এক নারী থেকে আরেক নারীর কাছে। শেষমেষ কি তারা পৌঁছতে পেরেছিলেন সৌন্দর্যতৃষ্ণার গন্তব্যে? সৌন্দর্যের প্রতি তাড়না আত্মার কাতরতা হলেও ব্যক্তির যাপিতজীবনকে তা উপেক্ষা করতে পারে না। ফলে মহাপুরুষের প্রতিদিনকার জীবনযাপনেও প্রভাব ফেলেছে প্রেম। প্রেমের প্রশান্তিতে কেউ থিতু হয়েছেন জীবনের উত্থান-পতনে, কেউ পৌঁছেছেন জীবনের মহত্তম উপলব্ধিতে। প্রেমিকার উপেক্ষা পেয়ে কেউ আবার আত্মযন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠেছেন। শরীর ও আত্মার এক আশ্চর্য রহস্য প্রেম। প্রজ্ঞাবান মহাপুরুষেরা তাদের অনুভূতি দিয়ে রহস্যের সেই জগৎ এঁকেছেন তাদের প্রেমময় জীবনে।