বক্তা মিযানুর রহমান আযহারি ও কিছু কথা

শরিফ সাইদুর

প্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০১৯

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেরা কাব্যগ্রন্থের একটি `জিঞ্জীর`। আমার খুব প্রিয় একটি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু কাব্যগ্রন্থটির তেমন আলোচনা আমি শুনিনি। সে গ্রন্থের অন্যতম সেরা কবিতা হচ্ছে `উমরা ফারুক`। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক রা. কে নিয়ে অসাধারণ এক কবিতা, পড়লেই চোখে পানি এসে যায়।

কবিতায় একটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, ওমর ফারুক তার পুত্র আবু শাহমাকে মদপান করার কারণে বেত্রাঘাত করেন, এতেই শাহমার মৃত্যু হয়৷ এই ঘটনাটা একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এদেশে, বলা যায় প্রসিদ্ধ ভুল। সে প্রচলিত ভুল ঘটনাকেই নজরুল গ্রহণ করেছিলেন। ঘটনাটা যে ভুল তা আমিও জানতাম না। একদিন একজন এক কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ওমর ফারুকের প্রহারে আবু শাহমার মৃত্যু হয়নি। তখন আমার ভুল ধারণা দূর হয়।

ওয়াজ নসিহত শুনি না বেশ কয়েক বছর। একসময় খুব পাগল ছিলাম ওয়াজের ও বক্তাদের। ট্রাক, সিএনজি, বাসে করে দূর দূরান্তে যেতাম। পরে মনে বোধ আসলো, অধিকাংশ বক্তাই কণ্ঠ ব্যাবসায়ী। উমর ফারুক জীবিত থাকলে এই আওয়াজ অত্যাচারীদের লাঠি দিয়ে পেটাতেন।

ওয়াজ শুনা বন্ধ করলেও পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি, তারিক জামিলসহ আরও কয়েকজনের অনেক বয়ান ডাউনলোড করে শুনেছি। আর দেশীয় বক্তাদের মাঝে গতবছর মাওলানা হাসান জামিল গ্রামে এসেছিলেন, উনার বয়ান শুনেছি, আর সুযোগ পেলে মুফতি আমজাদ হোসেনের খুতবা শুনি।

একদিন ছেলেদের মাঝে মিযানুর রহমান আযহারি নামের এক বক্তার প্রশংসা শুনি। যেহেতু ওয়াজ শুনিনা তাই ভ্রুক্ষেপ করিনি। একদিন টিভিতে সে উনার ওয়াজ শুনলাম, ভালোই লাগলো। কিন্তু ইংরেজির আধিক্যে বেশিক্ষণ শুনতে পারিনি। কারণ ইংরেজির মধ্যে ইংরেজি বুঝলেও বাংলার মধ্যে ইংরেজি আমি বুঝি না।

তবে জামায়াত ঘরানার বক্তাদের মাঝে স্মার্ট মনে হয়েছে। এবং তারেক মনোয়ার, আব্দুল্লাহ আল আমিনের মতো গলা ব্যবসায়ীদের চেয়ে উঁচু মানসিকতার মনে হয়েছে। তারপর সিক্স প্যাক এক বিতর্ক আসে। আমি বিস্তারিত কিছুই জানতে চাইনি, কোন লেখাও পড়িনি। কিন্তু উল্লেখিত ভিডিওতে আবু শাহমাকে নিয়ে উনার আলোচনা দেখে মনে হলো, যেই কদু সেই লাউ। তাহলে কি উনি বড়লোকের গিয়াসুদ্দিন তাহরি!

"আবু শাহমা ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কে নিয়ে বিশিষ্ট দ্বায়ী মিজানুর রহমান আল আজহারী সাহেবের খেয়ানতি ও চরম বেয়াদবীর জবাবে মরহুম আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর আফাল্লাহু আনহু যা লিখেছেন। হজরত উমার (রা) ও তাঁর পুত্র আবু শাহমাকে নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি ভুল ও বানোয়াট ঘটনা:
প্রচলিত ঘটনা-
হযরত উমার (রা) তাঁর নিজ পুত্র আবু শাহমাকে মদ্যপান ও ব্যাভিচার করার অপরাধে নিজ হাতে ১০০ দোররা বা বেত্রাঘাত করেন এবং সেখানেই সাথে সাথে তাঁর পুত্র মারা যায়। এই ব্যাভিচার এর বিস্তারিত ঘটনা, স্বীকারোক্তি, শাস্তি, পিতা-পুত্রের কথাবার্তা নিয়ে লম্বা কাহিনী এমনবভাবে প্রচলিত যে তা শুনলে চোখে পানি চলে আসে।
এর সাথে প্রশ্ন জাগে-
১. হজরত উমার (রা) এর ছেলে মদ্যপান ও ব্যাভিচার এর মত এমন খারাপ কাজ করেন কিভাবে?
২. তাহলে কি হজরত উমার (রা) তার পরিবারকে ইসলামের শিক্ষা দেননি?
কিন্তু সকল মুহাদ্দিসগন একমত যে এটা একটা ভিত্তিহীন, মিথ্যা বানানো গল্প। ইবনুল জাওযী বলেন, “সাধারন শ্রোতাদেরকে কাঁদানোর জন্য জাহিল ওয়ায়েযগন এগুলো বানিয়েছে”।

এবার আসি আসল ঘটনা কি ছিল। হযরত উমার (রা) এর পুত্র আবু শাহমার পূর্ণনাম হল আব্দুল রাহমান আবু শাহমা। তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীর হয়ে মিশরে যুদ্ধ করে জয়লাভ করার পর সেখানেই অবস্থান করেন। একদিন তিনি তাঁর বন্ধুকে নিয়ে নাবীয (খেজুর ভিজিয়ে তৈরি করা শরবত) পান করেন। কোন কারনে এই খেজুরের শরবতে মাদকতা এসে গিয়েছিল, ফলে তাদের মাঝেও অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও মাতলামি চলে আসে। পরদিন তিনি তাঁর বন্ধুকে নিয়ে মিশরের প্রশাসক হজরত আমর বিন আল আস (রা) কে বিস্তারিত সব ঘটনা খুলে বলেন এবং নিজ মদ্যপানের অপরাধে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী এর শাস্তি চান। তখন আমর (রা) তাকে ও উক্কবা (রা) কে তাঁর নিজ ঘরের মধ্যেই বেত্রাঘাত করেন।

পরে উমার (রা) এই ঘটনা জানতে পেরে পত্র মারফত আমর (রা) কে তিরস্কার করেন এবং বলেন সাধারণ মুসলিম জনগণকে যেভাবে জনসম্মুখে শাস্তি দেওয়া হয়, তেমনি আমার পুত্রকেও সেভাবে শাস্তি প্রদান করা উচিত ছিল। তিনি আবু শাহমাকে একটি উটে করে মদিনায় ফেরত পাঠাতে বলেন।

কোন কোন মতে আছে, তিনি মদিনায় আসার পথেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মদিনায় পোঁছানোর পর হজরত উমার (রা) নিজে পুনরায় জনসম্মুখে তাকে বেত্রাঘাতের শাস্তি প্রদান করেন। এর কিছুদিন বা কিছু সপ্তাহ পর আবু শাহামা ইন্তেকাল করেন। এরপর তাঁকে জান্নাতুল বাকীতে কবর দেওয়া হয়। এখান থেকে দেখা যায়-
১. আবু শাহমা হযরত উমার (রা) এর বেত্রাঘাতে তাৎক্ষনিক মারা যাননি।
২. আবু শাহমা ইচ্ছা করে মদ্যপান করেননি। এটা মদ ছিল না, কিন্তু মাদকতা তৈরি করেছিল।
৩. যদি মদপানের জন্যই তাকে দ্বিতীয়বার শাস্তি দেওয়া হত, তাহলে উমার (রা) শুধু তাঁর পুত্র আবু শাহমাকেই নয়, উক্কবা (রা) কেও শাস্তি দিতেন, যেহেতু দুজনই এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন। আসলে, শুধু আবু শাহমাকে শাস্তি দেওয়াটা ছিল মদপানের শাস্তি নয়, এটা ছিল পিতা হিসেবে পুত্রকে শাসন।
রেফারেন্স: হাদিসের নামে জালিয়াতি, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ ১৪৮