কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ৫

প্রকাশিত : জুন ১৮, ২০২৫

তৈজসপত্র ভাঙার প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমার সবচেয়ে ছোটো ভাই লিমনের বয়স মাত্র দুই বছর, আব্বা-আম্মার সঙ্গে ঘুমায়। বাসন-কোসন ভাঙার শব্দের সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর কান্নার শব্দ। আমি উঠে দেখি, অন্য তিন ভাই-বোন, শাহনাজ, বিটন ও বিউটি সিনেমার দৃশ্যের মতো আব্বা-আম্মার ঝগড়া দেখছে আর আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওরা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এরপর ওরা তিনজন একসঙ্গে কোরাস সঙ্গীতের মতো কান্না শুরু করে দেয়।

ঝড়-বৃষ্টির দিন। আমাদের বাড়িটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে বর্ষার জল। যে পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে উত্তর বাড্ডা যাওয়ার কাঁচা সড়কটিতে উঠতাম, সেই পথ এখন পানির নিচে। হাঁটুর ওপর অব্দি পানি ভেঙে প্রায় সিকি কিলোমিটার পথ হেঁটে শুকনো রাস্তায় উঠতে হয়। যেভাবে বর্ষার পানি বাড়ছে আর সপ্তাহখানেক পরে নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বেরুনোই যাবে না। আব্বা-আম্মা যখনই ঝগড়া করতেন আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করতাম।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ ছিল দারিদ্র এবং দারিদ্রের কারণ হিসেবে আব্বার নির্বুদ্ধিতাকেই দায়ী করতেন আম্মা এবং প্রায়শই নানার উপদেশ না শোনার ফলেই আজ আমাদের এই দশা, এইসব বলতেন। এতে আব্বা আরো রেগে যেতেন। এক পর্যায়ে ভাঙচুর, দুজনের খাওয়া-দাওয়া, কথা বলা বন্ধ। আব্বা না খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আম্মা আমাকে ডেকে কাছে বসিয়ে প্রতীজ্ঞা করান, আমি যেন কোনো দিন ব্যবসা না করি, যেন দরকার হলে পিয়ন-দারোয়ানের চাকরি করি, তবুও কোনোদিন ব্যবসায়ের নাম মুখে নিতে পারব না।

লক্ষ্য করে দেখেছি, বর্ষার পানি এসে যখন আমাদের বাড়িটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে, যখন বাড়িটি একটি ছোট্ট দ্বীপ হয়ে যায়, আমরা পানিবন্দি হয়ে পড়ি, তখনই আম্মা আব্বার সঙ্গে বেশি বেশি ঝগড়া করেন। এইরকম একটি অজ পাড়াগাঁয়ে বাধ্য হয়ে বসবাস করার জন্য তিনি আব্বাকে দায়ী করেন।

বেলা বাড়ে। বর্ষার পানি রোদের তাপে উত্তপ্ত হয়। এক হাঁটু পানি ভেঙে বন্যাদের বাসায় আসি। বন্যা অনেক আগেই পড়ালেখা থেকে ইস্তফা দিয়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আজ থেকে আমিও কোনো একটা কাজে লেগে যাব। দারিদ্র্যকে জয় করতেই হবে। মৌচাক মোড়ে বন্যাদের মুদির দোকান। ও একটা নৌকা নিয়ে সাঁতারকুল, কাঁঠালদিয়া, ডুমনি, বেরাইদ চলে যায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডিম কিনে আনে। দুই টাকা, আড়াই টাকা ডজন ডিম কিনে এনে ওদের দোকানে চারগুণ দামে বিক্রি করে। এই ব্যবসা করে ওর অনেক টাকা হয়েছে। বন্যা বিপুল উৎসাহ নিয়ে ওর সাফল্যের গল্প শোনায়। কিন্তু আমাকে ব্যবসাটা শেখায় না। আমি ওকে বলি, দোস্ত, আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দে।

যা শালা, তুই পড়ালেখায় ভালো, কবিতা লেখতে পারছ, আগে বেটা বিএ এমএ পাস কর, তারপর চাকরিতে যা।
না, এখনই চাকরি নিমু। তোর চাচাকে বলে রিনা হোটেলে আমার জন্য একটা কাজ জোগাড় করে দে।

বন্যা রাজি হয়। মৌচাকে ওর চাচা রুহুল আমিনের একটি বড় রেস্টুরেন্ট আছে, রিনা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ওর সঙ্গে কয়েকবার গিয়েছি। আমি দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি। রিনা হোটেলের মেসিয়ার জহির মহানন্দে টেবিল মুছে কাস্টমারের জন্য টেবিলে ভাত-তরকারি সাজিয়ে দিচ্ছে।

বন্যা আমাকে ফাঁকি দেয়। আমার মেসিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আমি পড়ালেখা ছেড়ে দেবার যে স্বপ্নটা দেখেছিলাম তা আর বাস্তবায়িত হলো না। এতে আমি খুব ভেঙে পড়ি। কবি নজরুল রুটির দোকানে কাজ করেছেন, আমি রেস্টুরেন্টে কাজ করতে পারলে নজরুলের কাছাকাছি একটা অভিজ্ঞতা হকো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে আবার স্কুলে যেতে হয়।

প্রি-টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে, সামনে টেস্ট। প্রি-টেস্টে খুব খারাপ রেজাল্ট করেছি। কারো কাছ থেকে একটা পুরনো টেস্ট পেপার জোগাড় করে পড়ালেখায় মনোযোগ দিই। টেস্ট পেপারে সকল বোর্ডের গত ১০ বছরের প্রশ্ন এবং উত্তর আছে। আমি অধিকাংশ অংকই বেশ দ্রুত করে ফেলতে পারছি, কিছু অংক জটিল লাগছে, ইংরেজি গ্রামার ভালো বুঝতে পারছি না। আমাদের স্কুলের শিক্ষকেরা ব্যাচ করে করে কোচিং করাচ্ছেন, রেহান স্যার অংকের কোচিং করাচ্ছেন আর কাইয়ুম স্যার করাচ্ছেন ইংরেজির কোচিং।

আম্মাকে বলি, রুবেল স্যার নেই, আমাকে কোচিং করতে হবে। আম্মা বলেন, কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে যাও। আমি জানি আম্মা ভর্তি হয়ে যাও বললেন বটে কিন্তু মাসের শেষে টাকাটা কোত্থেকে দেবেন এই দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হবে না।

এক মাস রেহান স্যারের কোচিং করে আমি দশম শ্রেণির অংকের মাস্টার হয়ে যাই। স্যারকে ১০০ টাকা ফি দিয়ে অংকের কোচিং থেকে গুডবাই করতে চাইলে স্যার বলেন, অত তাড়া কে রে? আরো দুই মাস পড়।

রেহান স্যারের বাড়ি চান্দিনা। কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। শুধু তাই না, অনেক বাংলা শব্দও তিনি ভুল বলেন। যেমন দুষ্টামি শব্দটা তিনি বলতে পারেন না, বলেন, দুষ্টানি। আমাদের সব সময় বলেন, এই পোলাপাইন দুষ্টানি করিস না। আমরা পেছনে এটা নিয়ে হাসাহাসি করতাম, স্যার তা জানতেন, এবং হাসতে হাসতে বলতেন, খালি দুষ্টানি, না?

আমি বলি, স্যার আব্বার অবস্থা খুব খারাপ। টাকা নেই। আমাকে এখন ইংরেজির কোচিং করতে হবে।
তর টেকা লাগদো না। তুই ফ্রি পড়বি।

আমি স্যারের কথা শুনি নাই, সময়েরও একটা ব্যাপার আছে। বাসা থেকে দুই কিলোমিটার পায়ে হেঁটে দুইবার দুই স্যারের কাছে যাওয়া কঠিন ব্যাপার। তা ছাড়া সারাদিন পড়ালেখায় ব্যয় করলে কবিতা লিখব কখন, খেলব কখন?

কাইয়ুম স্যারের কাছে আমাকে দুই মাস পড়তে হলো। তিনি থাকতেন দক্ষিণ বাড্ডায়। এক মাস পড়ি টেস্টের আগে, এক মাস এসএসসি পরীক্ষার আগে, ফেব্রুয়ারি মাসে। শেষ মাসের ১০০ টাকা জোগাড় করা খুব কষ্টকর হয়ে গেল। যেদিন কোচিংয়ের শেষ দিন, সবাইকে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন, সেদিন স্যারকে টাকাটা দিতে না পেরে আমি লজ্জায় মরে যাই।

বাসায় এসে আম্মার সঙ্গে রাগারাগি করি। আম্মা তার অপারগতায় খুব কান্নাকাটি করেন। পরদিন সকালে তার জমানো সব টাকা এবং খুচরো পয়সা একসঙ্গে করে আশি টাকার কিছু বেশি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, যাও, কাইয়ুম স্যারকে দিয়ে আসো। বলবা বাকিটা পরীক্ষায় পরে গিয়ে দিয়ে আসবা। আমি ইতস্তত করছি, এটা কি চাল-ডালের বিল যে কিছুটা বাকি রাখেন, পরে দিব? আম্মা বলেন, শিক্ষক মানুষ, কিছু মনে করবেন না।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণ বাড্ডায়, স্যারের বাসায় যাই। একটা টিনশেড বাড়িতে দুইটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন স্যার। স্ত্রী এবং ছোটো একটা বাচ্চা। এক ঘরে আমাদের পড়ান অন্য ঘরে তারা ঘুমান। আমি দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়াই, টোকা দেবার আগেই শুনি স্যার তার স্ত্রীকে বলছেন, পোলাপান পড়ে চলে যায় টাকা দেয় না, আমি কী করতে পারি বলো? আমি এতে আরো বেশি বিচলিত হই। কী করবো বুঝতে পারি না। অগত্যা দরোজার কড়া নাড়ি।

স্যার দরোজা খুলে খুব উচ্ছ্বসিত একটা হাসি দিয়ে আমাকে তাদের শোবার ঘরে নিয়ে বসান। আমি বিছানার ওপর বসে পকেট থেকে খুচরো পয়সাসহ আশি টাকার সামান্য কিছু বেশি, সব স্যারের হাতে তুলে দেই, বলি, আম্মার কাছে এই ছিল, বাকিটা...আমি বাক্যটা শেষ করতে পারি না। স্যার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। খুচরো পয়সাগুলো ফেরত দিয়ে বলেন, বাকি আর কী-রে, আমি কী শুধু টাকার জন্য পড়াই, তোরা আমার কেউ না?

তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, ছেলেটা অনেক দূর থেকে এসেছে, ঘরে কী আছে, ওকে খেতে দাও। স্যার নিজে পাটি বিছিয়ে দিয়ে আমার পাশে বসেন। ভাবি পুঁটি মাছ দিয়ে কচুরমুখির তরকারি আর ভাত বেড়ে দেন। আমি খেতে খেতে আনন্দে কাঁদছিলাম, কাইয়ুম স্যার আমার পিঠে হাত বুলাচ্ছিলেন।

আজও, যখনই কচুরমুখির তরকারি দিয়ে ভাত খাই সেই সকালের দৃশ্যটিই কেবল চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চলবে