কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : জুন ২০, ২০২৫

মাতৃকূলে আমার প্রজন্মে আমিই প্রথম সন্তান। বর্ধিত পরিবারের প্রথম সন্তান এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, আম্মা একটা উৎসব উৎসব আমেজ অনুভব করছেন। এর আরও একটি বড় কারণ হয়তো এই যে, দারিদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার প্রতি আমার অনীহা, এই দুটোর সঙ্গে যুদ্ধ করে পরীক্ষার হল অব্দি আমাকে পৌঁছানোর যাবতীয় কৃতিত্ব প্রায় আম্মার একার, এটি তার যুদ্ধজয়ের সাফল্য। তিনি ঠিক করেন, পরীক্ষা উপলক্ষে আমাকে কিছু নতুন কাপড় কিনে দেবেন।

গুলিস্তানের বঙ্গবাজার তখন বেশ জমে উঠেছে। ঢাকার নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের কাছে বঙ্গবাজার বেশ প্রিয়। নব্বইয়ের দশক থেকে গার্মেন্টসের বাতিল হওয়া শিপমেন্টের নতুন কাপড়ে এইসব মার্কেট সয়লাব হয়ে গেলেও তখন পাওয়া যেত বিদেশ থেকে আসা পুরনো, অর্ধপুরনো কাপড়। আমাদের কাছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি যেমন নতুন, তেমনি বিদেশ থেকে আসা অর্ধ পুরনো পোশাকও নতুনের মর্যাদাই পেত।

আব্বা-আম্মাকে রাজি করায় কাপড় কেনার জন্য বঙ্গবাজারে যেতে। আম্মাকে খুব কমই দেখেছি কাপড়-চোপড় কেনার জন্য মার্কেটে যেতেন। অবশ্য তখনকার দিনে, আমাদের মতো পরিবারের ছেলে-মেয়েদের ভাগ্যে, ঈদের সময় ছাড়া নতুন কাপড় কেনার কোনো ব্যাপার ছিলও না। শার্ট বা প্যান্ট ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে পরতাম, অপেক্ষা করতাম কখন ঈদ আসবে, তখন ছেঁড়া জামা বা প্যান্টের রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া যাবে, সেটিই ঈদের জামা, সেটিই সারা বছর পরারও জামা।

শুধু গেঞ্জি ছিঁড়ে গেলে তা সেলাই করা হতো না। গেঞ্জিতে ফুটো হয়ে গেলে বেশ কিছু ফুটোসহই অনেক দিন পরতাম। মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে সেইসব ফুটো বড় করতাম যাতে তাড়াতাড়ি নতুন গেঞ্জি পাওয়া যায়।

বঙ্গবাজারে গিয়ে অনেকগুলো প্যান্ট ট্রায়াল দিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। কোনোটাই ফিট হচ্ছে না। অবশেষে একটা ছাই রঙের প্যান্ট দারুণ ফিট করলো কিন্তু সমস্যা হলো সামনের দিকে, কোমরের কাছে, অতিমাত্রায় ব্লিচ দেওয়ার কারণে রঙটা জ্বলে শাদা হয়ে গেছে। আম্মা বলেন, এটা তো পুরনো প্যান্ট, রঙ জ্বলে গেছে, এটা নিও না। আমি বলি আম্মা, অসুবিধা নেই, এই অংশটা তো বেল্টের নিচে ঢাকা থাকবে। সেই অ্যাশ কালারের প্যান্ট, দুটো শার্ট  আর একটি চামড়ার নতুন বেল্ট কিনে বাড়ি ফিরি।

বঙ্গবাজারে আমার একটি মজার স্মৃতি আছে, সেটি ঘটেছে কিছুদিন আগে, রোজার মধ্যে। ঘটনাটি ঠিক বঙ্গবাজারে ঘটেনি, ঘটেছে গুলিস্তান সিনেমা হলের উল্টোদিকের ফুটপাতে।

সামনে ঈদ। আমি ও আমার বন্ধু নজরুল গুলিস্তানে যাই চামড়ার স্যান্ডেল কেনার জন্য। ফুটপাতে টুকরি পেতে নানান রকম স্যান্ডেল সাজিয়ে বসে আছে হকাররা। নজরুল ও আমি দুজন দু’জোড়া স্যান্ডেল কিনে ফেলি। প্রতি জোড়া স্যান্ডেলের দাম ১৬ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে একজন ভ্রাম্যমান মুচি এসে বলেন, একদিনও পিনবার পারবেন না।  খুইলা খুইলা পড়ব।  দেন রিপিট মাইরা দেই। তাইলে দুই বছরেও কিচ্ছু অইবো না।

আমরা তার কথা বিশ্বাস করি। লোকটি ঠাস ঠাস করে সেন্ডেলগুলোতে অনেকগুলো রিপিট মেরে বলেন, আপনেগো বিল অইছে ৬৪ টেকা। আমরা দুজন তো ঘামতে শুরু করি। দুই জোড়া সেন্ডেলের দাম ৩২ টাকা আর তাতে কয়েকটা পিন মেরে দিয়ে চাইছে ৬৪  টাকা! লোকটাকে নানান ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। শেষমেষ তাকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা পর্যন্ত দিতে চাইলাম কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। সেন্ডেলগুলো তার বাক্সে তুলে সে হাঁটতে শুরু করে দিল। তখন আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।

কাছেই পুলিশ ফাঁড়ি। দেখি পুলিশ কোনো সাহায্য করে কিনা। লোকটিকে বলি, ভাই, আমাদের কাছে তো অত টাকা নেই, আপনি আমাদের বিশ মিনিট সময় দেন, নবাবপুর রোডের আরাফাত হোটেলের মালিক আমার দাদা, ওখানে গিয়ে টাকা নিয়ে আসছি। কথাটা আমি হয়তো খুব বিশ্বাসযোগ্য করে বলতে পেরেছিলাম, লোকটি বিশ্বাস করে। নজরুলকে বলি, তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমি আসছি।

এক দৌড়ে সোজা পুলিশ ফাঁড়িতে চলে যাই। গিয়ে দেখি ইউনিফর্ম পরা দুজন পুলিশ ঘুমাচ্ছে, একজন সিভিল পোশাক পরা লোক বসে আছে। আমি ঘুমন্ত পুলিশদের একজনকে ডেকে তুলে সব ঘটনা খুলে বলি কিন্তু তিনি আমাকে পাত্তা দেন না, বলেন, যা পারো দিয়ে মিটিয়ে ফেলো। আমি প্রায় কেঁদে ফেলি, বলি কিছুতেই মিটাতে পারছি না বলেই তো আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি। পুলিশের কাজ কি বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা না? পুলিশ আমার ওপর ক্ষেপে যায়, বলে, যাও তো বিরক্ত করো না।

ঠিক তখনই সিভিল পোশাকের লোকটি লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। ওদের দুজনকে একটা হাঁক দিয়ে বলেন, চলো, ঘটনাটা দেখি। একজন উঠে একটা লাঠি নিয়ে বের হন, অন্যজন বলেন, ফাঁড়ি খালি রাইখা কেমনে যামু, আমি থাকি।

ওরা দুজন আমার সঙ্গে হাঁটতে থাকেন। গুলিস্তান সিনেমা হলের কাছে এসে আমি পুলিশদের বলি, আপনারা এখানে দাঁড়ান, আমি গিয়ে ওকে ধরি। আপনাদের দেখলে ও পালিয়ে যেতে পারে। আমি রাস্তা ক্রস করে এপারে এলে মুচি আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, টেকা আনছেন? এতক্ষণ লাগলো ক্যা? আমি বলি, হ আনছি। বলেই ওকে জাপ্টে ধরি। আমার এইরকম আচরণ দেখে নজরুল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি ওকে জাপ্টে ধরতেই পুলিশ দুজন ছুটে আসেন। এসেই ওকে বেদম পেটাতে শুরু করেন।

মুচি লোকটি ওর বাক্স ফেলে দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আমি তখন পুলিশদের অনুরোধ করতে লাগলাম, ওকে যেন আর না মারে। যে দশ টাকা আমরা ওকে অফার করেছিলাম সেই টাকাটা ওর গায়ের ওপর ফেলে দিয়ে সেন্ডেলগুলো নিয়ে দ্রুত কেটে পড়ি।

আমাদের মেট্রিক পরীক্ষার সেন্টার নির্ধারিত হয় খিলগাঁ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। সবাই জিজ্ঞেস করে, তোমার সিট পড়ছে কই? আমি বলি, খিলগাঁ। এ-পাড়া থেকে জঙ্গুইলা বাড়ির তপন, ভাওয়ালিয়া বাড়ির বাহার, সাহেবের টেকের হামিদ সাহেবের ছেলে লিটন, আমরা এই চারজন পরীক্ষার্থী। দুইটা রিক্সা নিয়ে চারজন সেন্টারে যাই। প্রথম দিন বাংলা দুই পেপার পরীক্ষা। প্রথম পত্র সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা, দ্বিতীয় পত্র দুপুর দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা। তখন মনে হত এটিই নিয়ম, এটিই স্বাভাবিক কিন্তু এখন মনে হয় ওই বয়সের ছেলেমেয়েদের ৬ ঘন্টা পরীক্ষা দেবার মত শাস্তিটা কি না দিলেই পারত না শিক্ষা বিভাগ? পরীক্ষার নামে এটা একটা নির্যাতন।

প্রথম পত্র পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছি, স্রোতের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি একটি মাঠের দিকে। কেন যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। হঠাৎ বাঁ দিকে স্কুলের মূল গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখি অভিভাবকদের একটি জটলা এবং এই ভিড়ের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন, উজ্জ্বল, ফর্শা মুখশ্রীর এক পুরুষ, হাজার মানুষের ভিড়েও দৃষ্টি তার ওপর পড়বেই। আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠি। এবং ছুটতে ছুটতে গেইটের দিকে যাই। অভিভাবকদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আব্বা আমাকে টেনে গেইটের বাইরে নিয়ে যান। প্রচুর খাবার নিয়ে আব্বা এসেছেন। এতো খাবার যে চার/পাঁচজন খেতে পারব।

আমার কাছে এটি অতি আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা। কারণ আব্বা কখনোই আমার কোনো স্কুলে যাননি। আমার লেখাপড়ার যাবতীয় বিষয় দেখাশুনা করেন আম্মা। আমি খুব চাইতাম আব্বা যেন স্কুলে যান, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন কিন্তু তা কখনোই ঘটেনি। আব্বা ছিলেন একজন বাদশাহী চাল চলনের মানুষ। তিনি শুধু নিজের ছেলেমেয়ে, পরিবার পরিজন বা আত্মীয় বন্ধুদেরই না, অচেনা মানুষকেও দুহাত উজাড় করে দান করেন। আমরা যেমন পকেটে ১০০ টাকা থাকলে নিজের জন্য ৯০ টাকা রেখে ১০ টাকা দান করি আব্বা তা করেন না, পুরো ১০০ টাকাই অন্যকে দিয়ে দেন।

যে কোনো যাত্রায়, আয়োজনে আব্বা পাশে থাকলে মনে হত বিশ্ব জয় করতে পারি। আব্বা শুধু যে ভীষণ দয়ালু মানুষ তাই নয় একজন অকুতোভয় মানুষও। ভয় বলে যে একটা বিষয় আছে এটিই তার অভিধানে নেই। আম্মা তার এই দুঃসাহসকে কটাক্ষ করে বলতেন `নির্বোধ`।

আমাকে পাশে বসিয়ে আব্বা খাওয়ালেন, অনেক আদর করলেন। আমি আব্বাকে বিদায় দিয়ে বাকি খাবারগুলো নিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকি এবং বন্ধুদের খেতে দিই। স্কুলের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নিজেকে খুব আত্মবিশ্বাসী এবং সুখী মনে হচ্ছিল। আব্বা ঠিক সময়েই আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে একজন দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। আমি জানি, বাসায় ফিরে যখন এই ঘটনা আম্মাকে বলবো আম্মাও দারুণ খুশি হবেন। আমি নিশ্চিত জানি আব্বা যে এখানে এসেছেন তা তিনি মোটেও আম্মাকে বলেননি। এইরকম সারপ্রাইজ দিতেই তিনি পছন্দ করেন। চলবে