
বাংলা একাডেমি পুরস্কারে আবারো বাংলা ভাষা অসম্মানিত হলো
লুবনা ইয়াসমিনপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২২
বাংলা একাডেমি পুরস্কারের স্বচ্ছতা, কিভাবে জুরিদের নিয়োগ দেয়া হয় এসব নিয়ে প্রশ্ন অনেক দিনের। অভিযোগ আছে, নেপথ্যে অনেক রকম লবিংয়ের মাধ্যমে যোগ্যদের এড়িয়ে অযোগ্যদের এই পুরস্কার দেয়া হয়, ফলে পুরস্কৃত যোগ্যরাও প্রশ্নবিদ্ধ হন। এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয়েছে কবিতায় আসাদ মান্নান ও বিমল গুহ, কথাসাহিত্যে ঝর্না রহমান ও বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রবন্ধ/গবেষণায় হোসেনউদ্দীন হোসেন, অনুবাদে আমিনুর রহমান ও রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, নাটকে সাধনা আহমেদ, শিশুসাহিত্যে রফিকুর রশীদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় পান্না কায়সার, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় হারুন-অর-রশিদ, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশ বিজ্ঞানে শুভাগত চৌধুরী, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণ কাহিনিতে সুফিয়া খাতুন ও হায়দার আকবর খান রনো এবং ফোকলোরে আমিনুর রহমান সুলতান। একই সময় প্রত্যেকটি শাখায় এড়ানো হয়েছে যোগ্যতর প্রবর্তনামূলক কাজ।
যারা পুরস্কৃত হয়েছেন তাদের ভেতর কবিতায়, নাটকে, অনুবাদে সংশ্লিষ্টদের কিছু লেখা আমি পড়েছি, এদের লেখা কোনো ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাহিত্য মানের, কিছু ক্ষেত্রে কিলিয়ে পাকানো অখাদ্য কাঁঠাল। অভিযোগ শুনেছি যে, এসব কিলানো তৎপরতায় এরা অন্যদের সহায়তা নেন। ঢাকার টেলি নাট্যকার প্লাস মঞ্চ নাট্যকারদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, সেবা প্রকাশনীতে যেরকম বিদেশি গল্প অবলম্বনে শেখ আবদুল হাকিমের অনুবাদে কাজী আনোয়ার হোসেন নিজের নাম বসাতেন, সেরকম একটি টেলি-স্ক্রিপ্ট কয়েকজন তৈরি করে একজনের নাম বসানো হয়, মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রেও তা করা হয়। কবিতায় আসাদ মান্নান ও বিমল গুহের কোনো প্রবর্তনামূলক কাজ নেই।
৩০ বছরের প্রবর্তনামূলক কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকারদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এড়ানোর অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি ওমর শামস বাংলা একাডেমির সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। স্বাধীনতার পর পর কবি জসীম উদ্দীনও বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অভিযোগ আছে যে, বাংলা একাডেমি পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’, ফেলোশিপ ও পুরস্কার সবক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। প্রয়াত মহাপরিচালক এবং পরে বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, উনি বহু খণ্ডে যে ফোকলোর সংগ্রহ সম্পাদনা করেছিলেন, তার মূল গবেষণা করেছিল বিভিন্ন জেলার লেখকেরা। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহা পরিচালক এবং বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে যেসব আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, তার থেকে ধারণা করতে অসুবিধা হয় না যে, বাংলা একাডেমিও এসব থেকে মুক্ত নয়।
পুরস্কার, বই মেলা পরিচালনা, গবেষকেরা নিজেদের ঢোল পেটানো এবং অখাদ্য বুদ্ধিবৃত্তিক বাজনা জায়েজ করতে পুরস্কারের নামে আরো অখাদ্য লেখকদের জাতীয় স্বীকৃতি দেবার একটি অপপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বাংলা একাডেমি। কয়েক বছর আগে হুমায়ুন আহমেদের নিয়মিত প্রকাশক প্রভাবশালী `অন্যপ্রকাশ` প্রকাশনী বাংলাদেশ শুল্ক-বিভাগের কর্মকর্তা মারুফুল ইসলামের কবিতার বই প্রকাশ করে, এক সপ্তাহের ভেতর ঢাকা ক্লাবে ও বাংলা একাডেমিতে কথিত মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছিল। অভিযোগ আছে যে, মারুফুল ইসলামের পুরস্কার প্রাপ্তির পেছনে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান ও সে সময়ের একাডেমি মহা পরিচালক শামসুজ্জামান খানের স্বশরীরি আশীর্বাদ কাজ করেছিল। একাডেমি নিয়োগে ঢালাও দলীয়করণের অভিযোগও আছে।
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটি সভায় ‘মুজিব বর্ষ’ বানান ভুল করা হয়েছিল। আমরা ‘বাংলা একাডেমি’ বানান নিয়েছি ওয়াইকিপেডিয়া থেকে। অনেকখানে এখনো ‘একাডেমী’ লেখা হয়। ভাষা ও বানান বিন্যাস ডিজিটাল ইউনিকোডে এসে পড়ায় বিশ্বের অনেক মূল ভাষাতে এখন আর বাচ্চাদের বানানের ব্যাপারে মার্কিং করা হয় না। বাংলা ছাপাছাপির সাথে জড়িত প্রুফ রিডারেরা কবি, লেখকের সহজলভ্য তকমা পাবার জন্য ক্ষেপে ওঠায়, অনেক লেখককে এখন নিজেদের লেখার প্রুফ রিডিং করতে সময় অপচয় করতে হয়। বাংলা ভাষার প্রাথমিক ইউনিকোড প্রয়োগে ব্যার্থ বাংলা একাডেমি তাদের পুরস্কৃতদের বসিয়ে ‘একাডেমি’ না ‘একাডেমী’, ‘জসীম উদ্দীন’ নাকি ‘জসিম উদ্দীন’ বানান হবে তার হিং টিং ছট প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করতে পারে। যা পড়েছি তাতে এদের কাউকে এর চেয়ে বেশি যোগ্য মনে হয়নি।
সেলিনা হোসেন বাংলা একাডেমির সভাপতি নিযুক্তি পেলে আমরা বলেছি যে, এতে একাডেমি ও বাংলা ভাষা সম্মানিত হলো। বাংলা একাডেমি ২০২১ সালে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে যাদের পুরস্কৃত করেছে তাতে বাংলা একাডেমি ও বাংলা ভাষা অসম্মানিত হলো।
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২