বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসম্মততা: বর্ণমালা ও বানানে

পর্ব ২

চৈতন্য চন্দ্র দাস

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩১, ২০১৮

উপর্যুক্ত কারণেই আমার মনে হয়, ভাষা নদীর মতো প্রবহমান এবং পরিবর্তনশীল হলেও নদীশাসনের মতো কিছুটা নিয়মনীতির প্রক্ষেপণ ভাষার উপরও চালানো যায়। তবে অবশ্যই তা অন্ধভাবে নয়। ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রবণতা বুঝে, প্রয়োজন হলেই যেকোনো ভাষিক উপকরণে তথা বর্ণে, শব্দে, বাক্যে এবং অর্থে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এতে ভাষার কোনো ক্ষতি হয় না। বরঞ্চ ভাষাতে গতিশীলতা আসে এবং ভাষা চির-আধুনিক হওয়ার পথ পায়। অনেকটা আমাদের পোশাকের বা ফ্যাশানের পরিবর্তনের মতো, যা চিরকাল এক থাকে না। ক্রমশ বদলায় এবং অবশ্যই প্রতিবারই আধুনিক হয়। বস্তুত, এতেই ভাষা প্রাণবতী থাকে, চিরন্তনতা প্রাপ্ত হয়।
বিশ্বের তাবৎ ভাষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি ভাষাতেই বানানে আর উচ্চারণে প্রভেদ রয়েছে। ফরাসি ভাষায় এ প্রভাব সর্বাধিক। তবে স্পেনীয়, পোর্তুগিজ, ডেনিশ, সেমেটিক, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সোয়াহিলি ইত্যাদি ভাষাতেও এরূপ বৈশিষ্ট্য অধিক হারে পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃত, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা বিশ্বের সবচে প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য। বাংলা ভাষা যেহেতু সংস্কৃত ভাষার গঠন-কাঠামো এবং ব্যাকরণিক দিক অনুসরণ করেছে, সেহেতু একেবারে শুরু থেকেই সমৃদ্ধির দিকে এর অবস্থিতি। পরবর্তী সময়ে ইংরেজি ও পোর্তুগিজ ব্যাকরণের কিছু অনুসরণ করায় বাংলা ভাষার গঠন কাঠামো এখন অনেক বেশি পরিশীলিত ও বিজ্ঞানসম্মত। ভাষার সমৃদ্ধি ও বৈজ্ঞানিকতা নির্ভর করে প্রধানত নিম্নলিখিত চারটি বিষয়ের উপর।
ক. ব্যাকরণিক পরিপূর্ণতা
খ. শব্দ ভাণ্ডারের পর্যাপ্ততা
গ. বর্ণমালার সম্পূর্ণতা এবং  বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা
ঘ. শব্দের বানানের আর উচ্চারণের নৈকট্য

পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা প্রায় চার হাজার। বাংলা ভাষাই বিশ্বের একমাত্র ভাষা, যেখানে উপরিউক্ত চারটি বৈশিষ্ট্যই প্রায় সর্বাংশে পরিলক্ষিত হয়। বাংলা বর্ণমালা সম্পর্কিত নিচের আলোচনাটি লক্ষ্য করা যাক:
‘ক’ থেকে ‘ম’ পর্যন্ত পঁচিশটি বর্ণকে যতটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সাজানো হয়েছে তা সংস্কৃত এবং এর থেকে আগত ভাষাসগুলো ছাড়া বিশ্বের আর কোনো ভাষায় দেখা যায় না। এ পঁচিশটি বর্ণকে ‘বর্গীয় বর্ণ’ বলা হয়। এ বর্ণগুলো উচ্চারণে যে কোনো দুটো বাকপ্রত্যঙ্গ ব্যবহৃত হয় বলে এদেরকে ‘স্পর্শ বা স্পৃষ্ট’ বর্ণও বলা হয়। এখন বাংলা বর্ণমালায় এ বর্ণগুলোর শৃঙ্খলালক্ষ্য করা যাক:
বর্গের নাম    প্রথম বর্ণ    দ্বিতীয় বর্ণ    তৃতীয় বর্ণ    চতুর্থ বর্ণ    পঞ্চম বর্ণ
ক বর্গ    ক    খ    গ    ঘ    ঙ
চ বর্গ    চ    ছ    জ    ঝ    ঞ
ট বর্গ    ট    ঠ    ড    ঢ    ণ
ত বর্গ    ত    থ    দ    ধ    ন
প বর্গ    প    ফ    ব    ভ    ম

এ ছকটি থেকে খুব সহজে বাংলা বর্ণমালার নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্যগুলো জানা সম্ভব হয়।

১.  প্রতিটি বর্গের নামকরণ হয়েছে প্রতিটি বর্গের প্রথম বর্গের নামে এবং প্রতিটি বর্গ সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত।
২.  প্রতিটি বর্গের প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম বর্ণ অল্পপ্রাণ।
৩.  প্রতিটি বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণ মহাপ্রাণ।
৪.  প্রতিটি বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ অঘোষ।
৫.  প্রতিটি বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ ঘোষ।
৬.  প্রতিটি বর্গের পঞ্চম বর্ণ নাসিক্য।
৭. প্রথম বর্গের সবগুলো ধ্বনিই কণ্ঠ্য ধ্বনি।
৮. দ্বিতীয় বর্গের সবগুলো ধ্বনিই ঘৃষ্ট ধ্বনি।
৯. তৃতীয় বর্গের সবগুলো ধ্বনিই দন্তমূলীয় ধ্বনি।
১০. চতুর্থ বর্গের সবগুলো ধ্বনিই দন্ত্য ধ্বনি।
১১. পঞ্চম বর্গের সবগুলো ধ্বনিই দ্বিওষ্ঠ্য ধ্বনি।
১২. চমৎকৃত হতে হয় যখন আমরা লক্ষ্য করি যে, বানানের ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর বর্ণসজ্জা বাংলা বর্ণমালায় রয়েছে। এরূপ বর্ণসজ্জা সংস্কৃতানুগ কয়েকটি ভাষা ছাড়া বিশ্বের আর কোনো ভাষায় নেই। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সকল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে-  
ক.  ক বর্গের সাথে নাসিক্য বর্ণ যুক্ত করবার প্রয়োজন হলে কেবল সেই বর্গের নাসিক্য বর্ণটি অর্থাৎ ‘ঙ’ যুক্ত করতে হয়। যথা- পঙ্ক, শঙ্খ, সঙ্গ, সঙ্ঘ প্রভৃতি।
খ.  চ বর্গের সাথে নাসিক্য বর্ণ যুক্ত করবার প্রয়োজন হলে কেবল সেই বর্গের নাসিক্য বর্ণটি অর্থাৎ ‘ঞ’ যুক্ত করতে হয়। যথা- পঞ্চাশ, বাঞ্ছা, গঞ্জনা, ঝঞ্ঝা প্রভৃতি।
গ.  ট বর্গের সাথে নাসিক্য বর্ণ যুক্ত করবার প্রয়োজন হলে সাধারণত সেই বর্গের নাসিক্য বর্ণটি অর্থাৎ ‘ণ’ যুক্ত করতে হয়। যথা- ঘণ্টা, কণ্ঠ, দণ্ড, ঢেণ্ডনপা, ক্ষুণ্ণ প্রভৃতি।
ঘ.  ত বর্গের সাথে নাসিক্য বর্ণ যুক্ত করবার প্রয়োজন হলে কেবল সেই বর্গের নাসিক্য বর্ণটি অর্থাৎ ‘ন’ যুক্ত করতে হয়। যথা- অন্ত, পান্থ, দ্বন্দ্ব, বন্ধু, অন্ন প্রভৃতি।
ঙ.  প বর্গের সাথে নাসিক্য বর্ণ যুক্ত করবার প্রয়োজন হলে কেবল সেই বর্গের নাসিক্য বর্ণটি অর্থাৎ ‘ম’ যুক্ত করতে হয়। যথা- কম্পন,লম্ফ, অবলম্বন, আরম্ভ, পণ্ডিতম্মন্য প্রভৃতি।

চলবে...

 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর