
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১
প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০২৫
শীতের বিকেল। নীলাভ কুয়াশায় আটকে আছে গোধূলির শেষ আলো। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাস। সদ্য নির্মিত বিশ্বরোড সংলগ্ন উত্তর বাড্ডার চান মিয়া হাজির বাজার। ছ`ফুট উচ্চতার এক লোক ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলছেন। তার পরনে আকাশি রঙের স্যুট। এমন পোশাক ও দেহের মানুষ আমরা এই অঞ্চলে দেখে অভ্যস্ত নই। তাকে ঘিরে একটা কৌতূহলী ভিড়। যারা একটু দূরে, অপ্রয়োজনে ঘোরাফেরা করছিলেন, তারা লোকটির প্রতি একটা অজানা আকর্ষণ বোধ করছেন।
ভিড় বাড়ছে। আমিও ভিড়ের মধ্যে উঁকি দেই। লোকটি কী কারণে জানি না, আমাকে দেখেই কথা থামিয়ে দেন, আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, এই যে বালক, এদিকে এসো। বলেই তিনি আমার বাহুটা খপ করে ধরে ফেলেন। টেনে কিছুটা নিজের দিকে নিয়ে যান। উৎসুক ভিড়ের চোখ এখন আমার দিকে। অনেকেই চেনেন আমাকে, তারা আরো অধিক উৎসাহ নিয়ে নতুন কোনো তামাশা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন।
লোকটি সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, সুবোধ বালক, তোমার নাম কী? আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র, ক’দিন পরে মেট্রিক পাশ করে কলেজে যাব। অচেনা কেউ প্রথম দর্শনেই তুমি করে বলছে, এটা মেনে নিতে পারলাম না। লোকটির বয়স তো চল্লিশ হবেই, কিছুটা বেশিও হতে পারে। আমি খুব নরম অথচ দৃঢ় গলায় বলি, আমার নাম বাদল, তোমার নাম কী? আমার এইরকম বেয়াদবি লোকটি গায়েই মাখলো না, সুন্দর করে জবাব দিল, আমার নাম সাখাওয়াত।
কী অদ্ভুত কাণ্ড, সেই থেকে সাখাওয়াত আমার একজন বন্ধু হয়ে গেল। তবে এরপরে আমি আর কোনোদিন তাকে তুমি করে বলিনি, সাখাওয়াত ভাই বলে ডেকেছি এবং তিনিও আমাকে তুমি করে বলেননি, দেখা হলেই বলতেন, আমার তরুণ বন্ধু, কেমন আছেন? নানান বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। রাজনীতি নিয়েই কথা বলতেন বেশি।
বাড্ডা তখন এক পশ্চাৎপদ শহরতলি। বঙ্গভবন কিংবা সেনানিবাসে কী হচ্ছে তার খবর খুব কমই পৌঁছাতো এই জনপদের মানুষের কাছে। সাখাওয়াত সাহেবকে যেন এই এলাকার মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতার যত গোপন কথা আছে তা জানাবার জন্যই কেউ পাঠিয়েছেন। তিনি কিন্তু কথাগুলো চায়ের দোকানে বসে ছোটোখাটো আড্ডায় কজন বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে বলতেন না। বলতেন প্রকাশ্যে, বিশ্বরোড আর সাতারকুল রোডের সংযোগস্থলের ওপর দাঁড়িয়ে, এবং প্রায়শই তা সন্ধ্যার আগে আগে, গোধূলি লগ্নে।
আমার একটা নেশা হয়ে যায়। রোজ তার কথা শোনার জন্য ওই জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শুধু আমি একাই নই, এই নেশায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন আরো অনেকেই। প্রায় বছরখানেকের কাছাকাছি হয়ে গেছে ধানের শীষের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে একজন পুতুল রাষ্ট্রপতি আফম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে বসানো হয়েছে। মূল ক্ষমতা সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে। সাখাওয়াত সাহেব রোজই বলতেন, যে কোনো দিন এরশাদ নিজেকেই রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করবেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে দিলেও নিজে প্রেসিডেন্টের পদে বসার জন্য অপেক্ষা করেন প্রায় পৌণে দুই বছর। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তারই মনোনীত ও আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আফম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির আসনে বসে পড়েন।
এরশাদ রাষ্ট্রপতি হবার প্রায় ১ বছর আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে সাখাওয়াত সাহেব আমাদের এই কথাটি বলতেন। তখন তার কথার অর্থ না বুঝলেও এখন কিছুটা অনুমান করতে পারি। হঠাৎ অমন দীর্ঘদেহী লোকটি কোত্থেকে এই এলাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন? কেন তিনি প্রকাশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক আলাপ করতেন? তখন তো মার্শাল ল ছিল। অথচ তিনি কথা বলতেন নির্ভয়ে। তাহলে কি তিনি কোনো সংস্থার হয়ে একটি গোপন দায়িত্ব পালন করছিলেন?
বোঝার চেষ্টা করছিলেন ঢাকা শহরের খুব কাছে দ্রুত বর্ধনশীল এই জনপদের মানুষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরশাদকে গ্রহণ করবে কী-না? এই রকম আরো অনেক সাখাওয়াত কি তখন ঢাকা শহরের বিভিন্ন লোকালয়ে এইসব কথা বলে বলে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পথ সুগম করেছিলেন বা জনমত যাচাই করছিলেন? হতে পারে।
আমার কিন্তু সাখাওয়াত সাহেবকে ভালোই লাগত। প্রায় আড়াই গুণ বয়সী একজন মানুষ আমাকে দিয়েছিলেন বন্ধুর মর্যাদা, হয়ত এ-কারণেই তাকে ভালো লাগত। আমার একজন সহপাঠী মিজানুর রহমান চৌধুরী থাকত বাড্ডার আদর্শ নগরে। সাখাওয়াতকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই ভিড়ে একদিন মিজানও যোগ দেয় এবং আমাকে বলে, লোকটা তো দারুণ জ্ঞানী। আমার মতো মিজানেরও জ্ঞানী মানুষদের প্রতি একটা বাড়তি আগ্রহ ছিল।
উত্তর বাড্ডার সাখাওয়াত অধ্যায় যেভাবে হঠাৎ শুরু হয়েছিল, আবার ঠিক তেমনি হঠাৎই শেষ হয়ে গেল, খুব নীরবে। হঠাৎ গোধূলির লাল আলোতে সাখাওয়াতের আগমন বন্ধ হয়ে গেল এবং এরপর আর কেউ কোনোদিন সাখাওয়াতকে দেখেনি। চলবে