
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত
তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসপ্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২০
জহরলাল নেহেরু এবং চরম হিন্দুত্ববাদী নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের (সন্ত্রাসী নরেন্দ্র মোদীর দীক্ষাগুরু) পরিষ্কার বক্তব্য ছিল, `বাংলা` এবং `পাঞ্জাব` নামে ভারত বা পাকিস্তানের বাইরে তৃতীয় বা চতুর্থ কোনও দেশ সৃষ্টি হতে পারবে না। আর তৎকালীন বৃটিশ কর্মকর্তাদের উপর তাদের প্রভাব ছিল অকল্পনীয়। বৃটিশ সরকার নেহেরু-পেটেলকে অখুশি করে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে।
কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীদের দাবি ছিল, ভারতবর্ষকে ভেঙে দুটি আলাদা দেশ গঠন করতে হবে। একটা হবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য ভারত এবং অপরটি হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য পাকিস্তান। ফয়সালাটা ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু এতে বাঁধ সাধে `বাংলা` এবং `পাঞ্জাব`। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরাই বাংলাকেও পাকিস্তানের অধিভুক্ত করার আন্দোলনে নামে। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে যখন বলা হয়, বাংলাও পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হতে চায়, তাতে অনাপত্তি জানান তিনি। তার বক্তব্য ছিল, বাংলা যদি পাকিস্তানে যোগ দিতে চায়, এতে আমার কোনও আপত্তি নেই।
মহাত্মা গান্ধি প্রথম প্রথম সিরিয়াসভাবে ভারত ভাগের বিরুদ্ধে থাকলেও পরবর্তীতে সম্মত হন। অপরদিকে তুমুল বিরোধিতা করেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। যিনি পাকিস্তানে নয়, ভারতের পক্ষাবলম্বন করেন। বৃটিশরা এক পর্যায়ে পাকিস্তান ও ভারতের পাশাপাশি বাংলা ও পাঞ্জাব নামের আরও দুটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করলেও জহর লাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বেঁকে বসেন। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য, হয় সম্পূর্ণ বাংলা বা পাঞ্জাব ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিবে, নয় বাংলা এবং পাঞ্জাবকে বিভক্ত হতে হবে। এক ভাগে যাবে পাকিস্তানে অপরভাগ ভারতে। কিন্তু আলাদাভাবে নতুন কোনও দেশ মেনে নেয়া হবে না।
যাই হোক, অবশেষে নেহেরু-প্যাটেলদেরই জয় হলো। ভেঙে ফেলা হলো বাংলাকে। ভেঙে ফেলা হলো পাঞ্জাবকে। সেদিন শুধু ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কারণে বাংলাকেই কেটে দুভাগ করা হয়নি; পাঞ্জাবও দু`টুকরো, আজও অবধি। কিন্তু সবচে মজার বিষয় ছিল, পাঞ্জাব বা বাংলাকে ভাগ করা হবে এটা যদিও সবাই জেনে গিয়েছিল কিন্তু কিভাবে ভাগ করা হবে এবং বাংলার রাজধানী কোলকাতা কোন ভাগে পড়বে এ বিষয়টি নিয়ে কারোরই কোনও ধারণা পর্যন্ত ছিল না। বাংলার তৎকালীন নেতৃবৃন্দের ধারণা ছিল, পাকিস্তানাধীন বাংলার রাজধানী হবে কোলকাতা।
কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগস্টে যেদিন ঘোষণা ও ভৌগলিক সীমানা চূড়ান্ত হলো এবং এ অঞ্চলের মুসলিম নেতৃবৃন্দ কোলকাতায় দাঁড়িয়ে জানতে পারলেন, তাদের কোলকাতা ত্যাগ করতে হবে; তখনই তারা বুঝতে পারলেন, তারা ঠকেছেন। তার আগে তারা বুঝতেই পারেননি যে, কোলকাতা তাদের দাবির মধ্যেই ছিল না। নেতারা গাট্টি-বস্তা স্ত্রী-পুত্র পরিবার নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন নতুন প্রাদেশিক রাজ্যে।
ভারতীয় নেতারা কোনো দিনই চাননি যে, ভারত-পাকিস্তানের বাইরে তৃতীয় কোনও দেশ গঠিত হোক। কিন্তু সেই ভারতীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপেই তৃতীয় দেশটি জন্ম নিল। পাকিস্তানের জন্ম না হলে এবং বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ সেদিন পাকিস্তানে যোগ না দিতে চাইলে `বাংলাদেশ` কোনো দিনই স্বাধীন দেশ হিসাবে গঠিত হতে পারতো না। আর সেদিন যদি বাংলা বিভক্ত না হয়ে ভারতে যোগ দিতো, তাহলো `বাংলাদেশ` কারো চিন্তায়ই আসতো না।
সে যাই হোক, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেল এবং আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানকে গালাগালি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইলো। যেভাবেই হোক, ১৯৭১ সালে এসে ভারত ঠিকই `ভারত-পাকিস্তানের বাইরে` আলাদা নতুন দেশ `বাংলাদেশ`কে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। যদিও তারা কোনো দিনই সেটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি; আজও না।
স্বাধীন দেশ হায়দ্রাবাদকে ভারত জবরদখল করে নিজের অংগভূত করেছে, কূটচাল চেলে সিকিমকে দখল করেছে, কাশ্মিরের স্বার্বভৌমত্ব বাতিল করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে কোনও কালেও `বাংলাদেশ` নামের কোনও দেশ এই পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেত না। আর তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে।