বাংলাদেশের নাট্যচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে যা আশা করি

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২২

বংলাদেশের নাট্যচর্চার জগতে চারজন ব্যক্তি আছেন যাদেরকে আমি খুবই পছন্দ করি। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আমার সমালোচনা অনেক। চারজনই কখনো না কখনো বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই চারজন মানুষ হলেন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, ম. হামিদ আর নাসির উদ্দীন ইউসুফ। চারজনের মধ্যে তিনজনের সঙ্গেই আমার মতাদর্শগত বিরোধের জায়গাটা ব্যাপক। হামিদ ভাইর সঙ্গে মতাদর্শ নিয়ে কখনো সেভাবে কথা হয়নি। মানুষে মানুষে মতাদর্শগত বিরোধ আর ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটা ভিন্ন। সবচেয়ে বেশি আপন জনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মতাদর্শগত বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু সেজন্য ব্যক্তিগত সম্পর্কটা রসাতলে চলে যায় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি রামেন্দুদা, মামুন ভাই, বাচ্চু ভাই আর হামিদ ভাইর সঙ্গে আমার খুবই আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। যখন তাদের কারো করো কদাচিৎ সমালোচনা করি, হয়তো ক্ষেপে যান; কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটা আমি সবসময়ে সযত্নে লালন করি। করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ তাদের সকলের সঙ্গেই আমি কিছুটা না কিছুটা সুন্দর সময় পার করেছি, কাছ থেকে তাদের বহু ভালো গুণাবলির কিছুটা দেখার সুযোগ হয়েছে। মামুন ভাই এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ মানুষ বলেই মনে হয়। তার সঙ্গেই আমার সম্পর্কের টানাপোড়েনটা বেশি ছিল। কিন্তু তিনি চমৎকার একজন বন্ধুবৎসল মানুষ।

মামুন ভাইর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করি। যখন তিনি শেষবার গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান, তিনি আমার একটি সমালোচনায় ক্ষেপে গিয়ে অবলোকন-এর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য পদ বাতিল করে দেন। সদস্যপদ কেড়ে নেবার সকল যুক্তি ছিল তাদের, কারণ অবলোকন তিন বছর ধরে বলতে গেলে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু সে কারণে অবলোকনকে বাদ দেওয়া হয়নি, বাদ দেয়া হয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রোশবশত। কারণ অনেক নিষ্ক্রিয় দল তখনো গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য ছিল। মামুন ভাই ক্ষেপে গিয়ে তখন আমার মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ঠিক সেইরকম সময়ে নৃপেন সাহা ঢাকায় এলে আমার ইস্কাটনের বাসায় থাকতেন। নৃপেনদা একদিন সকালে নাস্তা খেয়ে বললেন, চলো মামুনুর রশীদের ওখানে যাই। যাবার আমার যথেষ্ট ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমাকে দেখে মামুন ভাইর প্রতিক্রিয়া কী হবে জানি না বলে গেলাম না। বরং নৃপেনদাকে বললাম, মামুন ভাইকে গিয়ে বলবেন আজ রাতে মামুন ভাইর আমার বাসায় রাতের নিমন্ত্রণ। নৃপেনদা গিয়ে মামুন ভাইকে তাই বললেন। ঠিক তারপর যা ঘটলো, আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে মামুন ভাইর ফোন এলো। মামুন ভাই জানতে চাইলেন, রাহমান তুমি নাকি আজ রাতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছো? বললাম, হ্যাঁ। মামুন ভাই বললেন, আজকে যে পারব না, আজ একটা অন্য অনুষ্ঠান আছে। বললাম, কাল আসেন। মামুন ভাই রাজি হলেন। মামুন ভাইর মধ্যে এই সহজ ব্যাপারটা বারবার দেখেছি। সকল মান অভিমান ভেঙে আবার দ্রুত বন্ধু হয়ে যেতে পারেন।

মামুন ভাইর সেদিন আমার নিমন্ত্রণে আসতে রাজি হওয়াটা ছিল আমার কাছে বিরাট ব্যাপার। মামুন ভাইর সঙ্গে মতাদর্শগত কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হবে কেন? কখোনই সেটা আমি চাইনি। মামুন ভাই আসতে রাজি হবার সঙ্গে সঙ্গে পরদিন রাতে রামেন্দুদা, বাচ্চু ভাই সহ আরো কয়েকজনকে আমার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলাম। বাচ্চু ভাই সেদিন আসতে পারেননি। অনেকেই এসেছিলেন। বহু রাত পর্যন্ত আমরা আড্ডা দিলাম। সেটা ছিল রমজান মাস, পাঁচ ছয়দিন পর ঈদ। মামুন ভাই বললেন, তিনি ঈদের ছুটিতে শিলং যাচ্ছেন। শুনে খুব খুশি আমি, কারণ আমিও তখন শিলং থাকবো। মামুন ভাইকে বললাম, আমরাও কয়েকজন যাচ্ছি। মামুন ভাই বললেন, খুব ভালো। জমিয়ে আড্ডা হবে শিলংয়ে। শিংলয়ে যাবার পর এক পর্যটন এলাকার ছোট রেষ্টুরেন্টে বন্ধুদের নিয়ে খাচ্ছি, মামুন ভাই হঠাৎ পিছন থেকে এসে দিলেন কষে আমার পিঠে এক চড়। বললেন, ‘রাহমান, তুমি কই আমার সঙ্গে দেখা করলা না কেন?’ বললাম, ‘শিলংয়ের যে হোটেলের ঠিকানা দিয়েছিলেন সেখানে তো ওঠেননি।’ মামুন ভাই জানালেন, সেখানে রুম পাননি। মামুন ভাই বললেন, রাতে তিনি আমার হোটেলে আড্ডা দিতে আসবেন। মামুন ভাই আসবেন বলে সব রকম আয়োজন করে রাখা হয়েছিল। হোটেলে আমার কক্ষটা ছিল বিশাল। মামুন ভাই এলেন ঠিক সন্ধ্যায়। কিন্তু তারপর আড্ডা খাওয়া দাওয়া করতে করতে রাত তিনটা। হোটেলের সকল গেট তখন বন্ধ, বের হবার উপায় নেই। হোটেল কর্তৃক্ষকে বলার পর ভিন্ন একটা ছোট্ট এক গেট দেখিয়ে দিলেন। মামুন ভাইকে সেই রাতে একা না ছেড়ে হোটেল পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছে দিয়ে আসলাম। মামুন ভাইর সঙ্গে এই যে সুন্দর স্মৃতি, মতাদর্শগত বিরোধের কারণে কি সেটা নষ্ট হয়ে যাবে? প্রশ্ন্ই ওঠে না। মামুন ভাই করতে চাইলেও তো আমি হতে দেবো না। জানি, মামুন ভাইও নষ্ট করতে চাইবেন না।

মামুন ভাইর সঙ্গে এরপরে আমার ভয়াবহ বিরোধ হয়েছিল আমার পিএইচডি গবেষণায় মামুন ভাইর নাটকের সমালোচনার জন্য। মামুন ভাইকে শিলংয়ের আড্ডায় বারবার বলেছি, আমার অভিসন্দর্ভে আপনার নাটকের কড়া সমালোচনা আছে। ক্ষেপে যাবেন না। মামুন ভাই বলেছিলেন, কিছু যায় আসে না। কিন্তু অভিসন্দর্ভটা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেলে মামুন ভাই ভয়াবহ রেগে যান। মনে হলো, সম্পর্ক জোড়া লাগার আর সম্ভাবনা নেই। মামুন ভাইর ক্ষোভ প্রকাশকে আমি তখন ইতিবাচকভাবেই নিয়েছিলাম। জানি তিনি আবেগপ্রবণ মানুষ। ঠিক এই ঘটনার সময়ে আমার ভারত যাওয়া দরকার আর তখন ভারতীয় ভিসা পাওয়া ছিল কঠিন। মধ্যরাতে গিয়ে মানুষজন ভীড় করতো, লাইন ধরে দাঁড়াতো ভারতীয় দূতাবাসের সামনে। বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। হঠাৎ মামুন ভাইর কথা মনে হলো। ভাবলাম মামুন ভাইর সাহায্য চাই, ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে তাঁর ভালো যোগাযোগ। কিন্তু মামুন ভাই তখন যেভাবে ক্ষেপে আছেন, ফোন ধরবেন কি না সেটাই ভাবছিলাম। মামুন ভাইকে ফোন দিলাম। মামুন ভাই ফোন ধরলেন। বললাম, মামুন ভাই আমি আপনার শত্রু বটে কিন্তু মহান শত্রু। মামুন ভাই হাসলেন। জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার। মামুন ভাই সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ভিসা পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মামুন ভাই নানাভাবে সেদিন আমাকে এড়াতে পরতেন। এড়াননি। বরং ভিসাটা যাতে ঠিকভাবে পাই তার জনই আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন। ফলে এই মামুন ভাইকে চাইলেই কি আমি ছেড়ে চলে আসতে পারবো। সামান্য অসম্মান করতে পারবো? সারাদিন তাঁর সামনে বসে তাঁর সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু অসম্মান করতে পারবো না।

মামুন ভাই, রামেন্দুদা, বাচ্চু ভাই, হামিদ ভাই সবার সঙ্গেই খুব কম হলেও, আমার সুন্দর একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল এবং আছে। রামেন্দুদাকে কতো এখানে সেখানে সাধারণ পরিবেশে রাতের খাবার দুপুরের খাবার খেতে ডেকেছি, বিনাবাক্য ব্যয়ে চলে এসেছেন। তিনিই এতই সহজভঙ্গির মানুষ। যখন মতিঝিলে ছিলেন কতো সময়ে তার প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি, কফি খেয়েছি। কতোরকম গল্প করেছি। চট্টগ্রামে অভিজিতের নাট্য উৎসবে রামেন্দুদার সঙ্গে সময় কাটানো, সিলেটে গ্রুপ থিয়েটারের সম্মেলন শেষ করে ট্রেনে রামেন্দুদা-জামালউদ্দীন হোসেন ভাইদের সঙ্গে ঢাকায় ফেরা, চমৎকার সেসব স্মৃতি। কারণ ভিন্ন আর একটা মানুষকে তার ভিতর দিয়েই চেনা গিয়েছিল। হামিদ ভাইকে একবার হঠাৎ গুলশানে একটা আড্ডায় ডেকেছিলাম, তিনি এসে ঠিক সময়ে হাজির। মনে আছে সেদিনের সেই ছোট্ট আড্ডার কয়েকজন ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ফারাহ খান মজলিশ, লুভা নাহিদ চৌধুরী আর হামিদ ভাই। বাচ্চু ভাইর সঙ্গে একবার চল্লিশ ঘণ্টা বলতে গেলে টানা ভ্রমণ করেছি আর পুরো সময়টাই তর্ক বিতর্ক করেছি। বাচ্চু ভাই ভ্রমণ শেষে এসে আমাকে লিখেছিলেন, ‘দ্বিমত করবো বলে আমরা একমত হয়েছি’। সকালে একদিন যাত্রা আরম্ভ করে দীর্ঘ ভ্রমণের পর পুঠিয়া থিয়েটারের সভা, রাত একটায় রাতের খাওয়া শেষ করে বগুড়া যাত্রা রাত তিনটা পর্যন্ত সড়ক পথে, কয়েক ঘণ্টা ঘুমের পর পরদিন বগুড়ায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আবার কয়েকটা সভা আবার ভ্রমণ করতে করতে রাতে ঢাকায় ফেরা। বাচ্চু ভাইর সঙ্গে সেই চল্লিশ ঘন্টা এমন আড্ডার আনন্দটাই ছিল আলাদা। নড়াইলে আর একবার বাচ্চু ভাইর সঙ্গে সার্কিট হাউসে রাত তিনটা পর্যন্ত গান শোনা আর আড্ডা। মানুষে মানুষে এই সম্পর্কগুলি অনেক বড়। মতাদর্শকে ছাপিয়ে এই স্মৃতিগুলি জীবনে অনেক বড় হয়ে ওঠে।

চারজনকেই আমি দেখেছি নানাভাবে, ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে। মামুন ভাই সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল তার মধ্যে খানিকটা ভিন্নতর, কারণ আমাদের আত্মীয় দুই বোন সৈয়দ নাদিরা অনু আর রেহানা আপা আরণ্যকে নাটক করতেন। আমার কিছু আত্মীয়ের সঙ্গে মামুন ভাইর ঘনিষ্ঠতা ছিল। সব কিছু বাদ দিলে মামুন ভাই সহ সকলের সঙ্গে সেই সম্পর্কটা ছিল পারস্পরিক সম্মানের। তাঁদের কাছ থেকে যে আমি কখনো অন্যায় সুবিধা চেয়েছি বলতে পারবেন না। নাটকের জগতের নানা কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে আমার হাজারটা সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু দোষগুণ সহ তাঁদের সবাইকেই আমি পছন্দ করি, সম্মান করি। নাটকের একটা চরিত্রে যখন একজন অভিনেতা অভিনয় করেন কীভাবে চরিত্রটাকে প্রথম মূল্যায়ন করেন? চরিত্রটার দুটা দিকে মনোযাগ দেন সবার আগে। একটা চরিত্রের ব্যক্তিগত মনাজগৎ আর ভিন্নটা তার সামাজিক অবস্থান। চরিত্রটির ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গাগুলি আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলিকে বিবেচনায় রাখেন, ভিন্ন দিকে কট্টরভাবে বিচার করতে হয় চরিত্রটির শ্রেণীচরিত্র। ব্যক্তিজীবনেও তাই। পুঁজির দাপটে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সকল মানুষ পূতপবিত্র হবেন এমন আশা করাটাই বাতুলতা। কিন্তু সেই মানুষগুলির অনুভূতির জগতটাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে, শুধুমাত্র মতাদর্শের জায়গা থেকেই তাঁকে দেখতে হবে এটা কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়। ফলে প্রতিটি মানুষের বিচিত্র চিন্তাভাবনার জগতের ঠিকানা পেতে হবে।

চারজন আলোচিত মানুষ সম্পর্কে আমার সমালোচনা আছে থাকবে। যদি তারা আশা করেন, তাদের সবকিছুই আমি প্রশংসা করবো, সামান্য সমালোচনা করবো না, তাহলে তারা ভুল করবেন। কিন্তু তাদের প্রতি আমার সম্মানের জায়গাটাও সত্য। বহু কিছু প্রত্যাশা করবার আছে তাঁদের কাছে। প্রত্যাশা করি বলেই সমালোচনা করি। যদি আমি আপনজনদের বা নিজপক্ষের লোকদেরই সমালোচনা করতে না পারি, তাহলে সেটা হবে আমারই লজ্জা। মহাভারতে গান্ধারী মহৎ চরিত্র হয়ে আছেন, নিজ সন্তানদের সমালোচনা করতে পারার জন্য। নিজ সন্তানদের সকল কুকর্মের বিরুদ্ধে তিনি হয়েছিলেন সোচ্চার, ধৃতরাষ্ট সেখানে কী করলেন? তিনি বললেন, আমি পিতৃস্নেহে অন্ধ। মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে তিনি এই সত্যটিও উচ্চারণ করেছিলেন, ‘অন্ধ আমি ভিতরে বাহিরে’। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের তিরস্কার করলেও, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেননি। গান্ধারীর কিছু করবার ক্ষমতা ছিল না, ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দেয়া ছাড়া। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্তের। গান্ধারীর কথা শুনলে হয়তো সেদিন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঠেকানো যেতো। বহু মানুষের রক্তপাত এড়ানো যেতো। মহাভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেদিন বড় বড় সব মহান মানুষরা কীভাবে সিংহাসনের পক্ষে ছিলেন। নানান মহৎ গুণাবলি নিয়েও তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ন্যায়বিচার করতে পারেননি।

বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় চারজনের কাজের আমি যতোই সমালোচনা করি না কেন, তাঁদের অবদানের জায়গাটা কি সম্পূর্ণ বাতিল করা যাবে? প্রশ্নই আসে না। চারজনের সম্পর্কে নালিশ থাকতে পারে নাট্যচর্চার ধারা নিয়ে। চারজনই তাঁরা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান ছিলেন কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের দায়ে দুদুক তাঁদের কখনো তলব করেনি। সকলের তাঁদের নানা ব্যর্থতার পর তাঁদের অবদানের জায়গাটাও ধ্রুব সত্য। নাট্য আন্দোলনে তাঁদের ব্যর্থতা যেমন আছে, তাঁদের অবদানকে কেউ খাটো করতে পারবে না। গ্রীক দার্শনিক য়্যারিস্টটলের নাটক নিয়ে রচিত ‘পোয়েটিকস’-এর তত্ত্ব শেক্সপিয়ার থেকে ব্রেশট সকলেই বাতিল করে দিয়েছেন, কিন্তু য়্যারিস্টটলকে কি তারপরেও সম্পূর্ণ বাতিল করা যায়? তিনি যা লিখে গেছেন সারাজীবন নাট্যচিন্তকদের তা নিয়ে আলোচনা করে যেতে হবে। সত্যি বলতে ‘পোয়েটিকস’ পাঠ বাদ দিয়ে পূর্ণ নাট্য আলোচনা হতেই পারে না। চারজন সহ আরো কতিপয় বয়স্ক নাট্যব্যক্তিত্বকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী নাট্য-ইতিহাস রচনা করা যাবে না। রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ম হামিদ প্রমুখ বাংলাদেশের নাট্যচর্চার সঙ্কটে যা বলবেন তার গুরুত্ব আজও রয়েছে। কিছু অর্বাচীনদের কথাবার্তাই সেখানে বাতিল হয়ে যাবে। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার আজকের সঙ্কটে রামেন্দুদা, মামুন ভাই, বাচ্চু ভাই, হামিদ ভাই, নূর ভাই প্রমুখ যা বলবেন তার বাইরে গিয়ে কথা বলার সুযোগ কম। বরং আজকে তাঁদের পক্ষে দীর্ঘদিনের নানা অভিজ্ঞতার আলোকে পুরানো ভুলত্রুটি বাদ দিয়ে সঠিক পথ দেখানো সম্ভব। সন্দেহ নেই, তাদের দৃষ্টভঙ্গিটা হতে হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ আর প্রেক্ষাপটটা হতে হবে বৃহত্তর।

স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশের নাট্যচর্চা আরম্ভ করার ক্ষেত্রে ম হামিদ ভাই বা নাট্যচক্রের অবদানের কথা কি ভুলে যাওয়া যাবে? যাবে না। রামেন্দুদা, ফেরদৌসি আপা, আবদুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ নাটকে অভিনয় করতে শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার আগেই। মামুন ভাই প্রথম নিঃসঙ্গভাবে একা একা হেঁটেছেন নাট্যচর্চা করার জন্য। বহু মানুষের কথা এভাবে চলে আসবে। কিন্তু সেসব বলতে আরম্ভ করলে পৃষ্ঠায় কুলাবে না। সকলের লড়াইয়ের জায়গা আছে, ব্যর্থতা আছে। কিন্তু দুর্নীতির ইতিহাস নেই। সংগঠনের টাকা কেলেঙ্কারি করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি কখনো তাঁদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অতীতের সেসব স্মৃতিচারণের চেয়ে বেশি দরকার বর্তমান সঙ্কটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। লুটপাট যদি হয়েই থাকে, সামনে যেন তেমনটা না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে। সঙ্কট নিরসনে অবশ্যই সামনে এগিয়ে আসতে হবে রামেন্দুদা, মামুন ভাই, বাচ্চু ভাই, হামিদ ভাই, নূর ভাই সকলকে। রামেন্দুদা ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন, বাকি  অনেকে তা সমর্থন করেছেন; এটা একটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু ভাবনাটা এখানে এসে থেমে থাকলেই হবে না। পুরো নাট্যর্চচা নিয়ে আরো স্পষ্ট কিছু কথা বলা দরকার আছে। নাটককে কিছুতেই সস্তা বিনোদন করে তোলা চলবে না, কিছুতেই সস্তা শ্লোগানে পরিণত করা যাবে না। যারা নাট্যচর্চার সঙ্গে, নাট্য বিষয়ক পড়াশুনার সঙ্গে আপাদমস্তক যুক্ত থাকবে না, নাট্যাঙ্গনে তাদের মাস্তানী করার রাস্তাটা বন্ধ করতে হবে। নাটক না বুঝে, নাটকে দক্ষতা লাভ না করে, কেউ নাট্যকর্মী হতে পারে না। সস্তা শ্লোগান দেবার জন্য নাট্যকর্মীর দরকার নেই। নাট্যব্যক্তিত্বদের এই জায়গাটায় আসলে দৃঢ় হবে হবে।

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের উল্লেখিত চারজন, যাঁদের বয়স হয় পঁচাত্তরের কাছাকাছি বা পঁচাত্তর ছাড়িয়ে গেছে; জীবনে যা পাবার সব পেয়েছেন তাঁরা। নাট্য আন্দোলনকে এবার নিঃস্বার্থভাবে সঠিক পথ দেখাবার দায়িত্ব নিতে হবে তাঁদেরকে, যাতে পঞ্চাশ বছরের মাথায় সত্যিকারের নাট্যচর্চা করার সঠিক পথটা সৃষ্টি হতে পারে। চারজনের কথা বলছি মানেই বাকিদের বাদ দিয়ে রাখছি তা নয়। সত্যিকারের নাট্যচর্চা যাঁরা চান সকলেই তাঁরা এখানে থাকবেন এটাই তো কাম্য। নূর ভাইর কথা ইতিমধ্যে বলেছি, এমন বহুজন আছেন। লাকী ইনাম আছেন, শিশির দত্ত আছেন, মলয় ভৌমিক আছেন, ঝুনা চৌধুরী আছেন, গোলাম কুদ্দুস আছেন, আহমেদ ইকবাল হায়দার আছেন, বাবুল বিশ্বাস আছেন, মাসুম রেজা আছেন, মোহাম্মদ বারী আছেন, অলোক বসু আছেন। সঙ্গে পাওয়া যাবে উদ্যমী আরো অনেক তরুণ প্রজন্মকে। সকল প্রজন্ম মিলে বহু মানুষ আছেন যাঁরা আজকে যদি এক হন, যদি সৎভাবে চান; নাট্যচর্চা সঠিক পথ খুঁজে পাবেই। দরকার আন্তরিকতার আর উদার দৃষ্টিভঙ্গির। বাংলাদেশের নাটকের বিরাট সম্ভাবনার জায়গা আছে যদি ফাঁকিবাজি, চালবাজি বাদ দিয়ে, সৃষ্টিশীল কাজে নাট্যকর্মীরা মন দেন। নাট্যচর্চায় একুশ শতকে সৃনশীলতার নানা উদাহরণ আছে। মাসুম রেজার নিত্য পুরাণের মতো নাট্যরচনা আর প্রযোজনার ইতিহাস আছে আমাদের, মামুনুর ভাইর দুর্দান্ত নাট্য নির্দেশনা ‘টার্গেট পাল্টুন’ বহুকাল স্মরণে থাকবে, মলয় ভৌমিকের রচিত নাটক ‘হত্যার শিল্পকলা’ মুগ্ধ করে রাখে পাঠককে, সুবচনের প্রযোজনা ‘মহাজনের নাও’ দেখে তন্ময় হয়ে বসে থাকতে হয়, সাইফ সুমনের ‘না-মানুষি জমিন’ এর নির্দেশনা দেখে ধারণা করা গেল নতুনরা নতুন পথ দেখাবে। বাকার বকুল, সুদীপ আর ইউসুফ হাসান নির্দেশনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছে এই সময়কালেই। সম্ভাবনার এই জায়গাগুলি কিছুতেই স্তব্ধ করে দেয়া যায় না।