বিষণ্ণতা কমাতে আর্ট ও মিউজিক

মুন্নী ইয়াসমিন

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২১

মানুষ নিজের কষ্টকে যখন প্রকাশ করতে পারে না, মানসিক চাপকে নিজের মধ্যে আবদ্ধ রাখে, তখনই তার মধ্যে বিষাদ বা বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয়। মানুষ কখনো কখনো এই মানসিক চাপকে নিতে পারে না, যা জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত থেকে উদ্ভূত হয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, যেসব শিশুর ১১ বছরের আগে যদি বাবা বা মাকে হারায়, বড় হয়ে তার বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেক বেশি। এছাড়া বড় ধরনের কোনো লোকসান হলে বা খুব কাছের কেউ মারা গেলে, অবসর নিলে, চাকরি থেকে বরখাস্ত হলে, ভালোবাসায় বিচ্ছেদ বা রেজাল্ট আশানুরূপ না হলেও মানুষ বিষাদগ্রস্ত হয়। একজন ব্যক্তি কেন এই বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবে তা নির্ভর করে সে কোন কারণটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তার উপর।

এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে আবদ্ধ আবেগ বা চাপকে নিজের মধ্যে রাখবেন না। একে মুক্ত করে দিন। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুঃখ-বেদনা বা যে কোনো মানসিক আঘাত দেহের মধ্যে বিষাক্ত অণু বা টক্সিন তৈরি করে। এই অণুগুলোকে শরীর থেকে বের করে দেয়া জরুরি। কান্নার মাধ্যমে এই বিষাক্ত অণুগুলোকে শরীর থেকে বের করে দেয়া যায়। মানসিক চাপ মানুষের শরীরে ভারসাম্য নষ্ট করে, আর কান্নার মধ্য দিয়ে সেই ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভবপর হয়। যিনি কাঁদতে পারেন না, মানসিক চাপ তার শরীরেই রয়ে যায়।

যদিও অনেকে কান্নাকে দুর্বলতা মনে করেন, লজ্জাজনক ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করেন। কেউ কেউ কান্নাকে মেয়েলি আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন। পৌরুষদীপ্ত পুরুষ কান্নাকে কোমল ব্যক্তিত্বের আধার মনে করেন। যা সম্পূর্ণ ভুল। কান্না হচ্ছে একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য যা সহানুভূতি ও মমত্বকে আকর্ষণ করে। আর অশ্রু মমত্ব বাড়ায়। তাই মন খুলে কাঁদা উচিত কষ্ট পেলে, আঘাত পেলে। এর তীব্রতা যত বেশি হয়, দুঃখ তত লাঘব হয়। আর যে কাঁদতে পারে, তার কষ্ট তত কম স্থায়ী হয়।

অন্তর্মুখী ব্যক্তিদের দেখা যায়, তারা নিজের কষ্ট বা মনখারাপ করা অবস্থা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে কুণ্ঠাবোধ করে, নিজেদের একটি বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। কারো উপর নির্ভর করতে পারে না, কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। খোলসের মধ্যে রাখে। অথচ তারা যদি নিজেদের কারো সাথে শেয়ার করতে পারেন তবে এই বিষাদ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। বর্তমানে বিষাদ বা অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে আর্ট থেরাপি অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে তার কষ্টগুলোকে দূর করতে পারেন। এটি ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির একটি উপায় বলা যেতে পারে।

বেন স্কেয়ার্জ নামের এক ব্যক্তি যিনি ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, তিনি The man in the box শিরোনামে একটি ছবি আঁকেন। ছবি আঁকার মাধ্যমে তিনি তার তার অবসাদ, আবেগ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে ইত্যাদি অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে থাকেন। তিনি লক্ষ্য করেন, যত বেশি একাগ্রতা নিয়ে তিনি কাজ করে গেছেন ততই তার মধ্য থেকে বিষণ্ণ অনুভূতিগুলো দূরীভূত হয়েছে।

সম্প্রতি বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সঙ্গীত বা মিউজিক বিষণ্ণতা কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক খুবই কার্যকর। দুঃখ বা বিষণ্ণতা জীবনে থাকবেই, কিন্তু একে জমতে দেয়া যাবে না, জমাট বাঁধতে দেয়া যাবে না। কারণ দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতার প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ।

স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞদের দাবি, মিউজিকেই ম্যাজিক। মিউজিক মস্তিষ্কের অকেজো কোষগুলোকে চনমনে, স্বাভাবিক করে তোলে, মনকে ভালো করে দেয়। নিয়মিত ২৫ মিনিট গান শুনলে ব্যাক পেইন কমে যায়। ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা বলেছে, মেজাজ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে মিউজিক। মূলত মস্তিষ্কের ডোপামিনের প্রভাবে এটি ঘটে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ, ডিপ্রেশন, ঘুমে জড়তা বা স্মৃতি লোপের মতো অসুখ সারাতে মিউজিকের বিকল্প নেই।

আমাদের বিশেষ শিশুদের জন্য মিউজিক একটি থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা তাদের অতি চাঞ্চল্য দূর করে। মনোযোগের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়। এমন কি অন্তঃসত্তা মায়েরা যদি নিয়মিত মিউজিক শোনেন তাহলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সুন্দর হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, গান শোনার পর ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ বেড়ে গেছে।