মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৫২

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মে ১০, ২০২১

দূরগ্রামের এক কলেজছাত্রী ইনবক্সে লিখলেন, ‘দাদা, আমার একজন প্রাইভেট মাস্টার আছে। প্রতিদিন আমাকে বাংলা-ইংরেজি ইত্যাদি পড়াতে আসে। কিন্তু তিনি ওসব না পড়িয়ে আমাকে কেবল ওয়াজ করেন। কবরে কী হবে, হাশরের ময়দানের কী হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাস্তিকরা কীভাবে ওঁৎ পেতে আছে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদি-নাসারারা কীভাবে ষড়যন্ত্র করছে―এসব কথা বলেন কেবল। বিষয় ধরে পড়াতে বললেই তিনি মাইন্ড করেন। কী করি বলুন তো?’

আমি তাকে লিখলাম, ‘বোন, আপাতত কিছুই করার নেই। কারণ আপনি এখনো পরনির্ভরশীল। ভালো করে লেখাপড়া করুন। ইন্টার পাস করে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করুন। স্বাবলম্বী হোন। তখন এভাবে কেউ ওয়াজ করতে আসবে না। এলেও আপনি তখন না শুনলেও চলবে। প্রতিবাদও করতে পারবেন। আপাতত পড়ালেখা চালিয়ে যান। প্রাইভেট মাস্টারের ওয়াজ শুনে যান। আপাতত আর কোনো উপায় নেই।’

পরদিন তরুণী আবার লিখলেন, ‘আমাদের এলাকার লাইব্রেরীগুলোতে তো তেমন বই নাই। বলতে গেলে কোনো বইই নাই। ক্লাস টেনে থাকতে আমাকে আমার কাকু ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ ওয়ান’ নামে একটা বই এনে দিয়েছিল পড়ার জন্য। বইটা পড়ে হুমায়ুন আজাদ স্যারের ‘আমার অবিশ্বাস’, অভিজিৎ রায়ের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, মুক্তমনা ব্লগ―এসব সম্পর্কে জেনেছি। ‘আরজ আলী সমীপে’ বইটা পড়ে আরজ আলী মাতুব্বর সম্পর্কে জেনেছি। ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ বইটা অনেক উপকার করল আমার। এটা না পড়লে হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়ের বইপত্রের হদিস হয়ত আমি কোনোদিনই পেতাম না। তাঁদের বইগুলো না পড়লে আমি অনেক কিছু থেকে বঞ্ছিত থেকে যেতাম। আমার মতো অনেক ছাত্রছাত্রীর এমন উপকার হয়েছে।’

তার এই কথাগুলো শুনে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। কোনো এক ভিখেরি রাস্তার পাশে বসে ভিক্ষা করছে। শ্রীরামের কাছে মিনতি জানাচ্ছে, ‘আধেক পয়সা দেরে দেলা হরে রাম।’ বিস্তর লোকজন অনেক আধুলি দিল তাকে। ভিখেরি এবার বলতে লাগল, ‘একটা পয়সা দেরে দেলা হরে রাম।’ বিস্তর লোকজন এক পয়সা করে দিল। একটা সময় পয়সার স্তুপ জমে গেল। পয়সার বস্তাগুলো এখন সে বাড়ি নেবে কেমন করে? নেওয়ার জন্য লাগবে একটা ঘোড়া। এবার সে বলতে লাগল, ‘একটা ঘোড়া দেরে দেলা হরে রাম।’ অনেক বার বলার পর হঠাৎ তার সামনে দেখতে পেল একটি ঘোড়ার বাচ্চা। কী করে এখন সে? চেয়েছে শক্তিসামর্থবান ঘোড়া, অথচ রাম দিল কিনা ঘোড়ার বাচ্চা! এবার সে রামের উদ্দেশে বলল, ‘উল্টা সমঝেরে রে দেলা হরে রাম।’

গল্প শেষ। কী বোঝা গেল? বোঝা গেল যে, উত্তাল স্রোতের নদীতে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করা হলে হিতে বিপরীত হয়। উল্টা হয়। নদী ভাঙতে থাকে। নদী আরো বিস্তার লাভ করে। জনপদ ভাসিয়ে। একইভাবে সূর্যকেও ঢেকে দেওয়া যায় না। যারা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে তারা বোকা। ধর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে ধর্মকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন হুমায়ুন আজাদ বা অভিজিৎ রায়, তার কাউন্টার ধর্ম দিয়ে হবে না, অন্য কিছু লাগবে। আরজ আলী মাতুব্বর যেসব প্রশ্ন রেখে গেছেন, কিংবা হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবাল, অভিজিৎ রায় প্রমুখ যে আলো জ্বালিয়েছেন, সেই প্রশ্নের কাছে, সেই আলোর কাছে কোনো না কোনোভাবে প্রজন্ম আসবেই, আসতেই থাকবে। কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না। রোধ করতে গেলে ‘উল্টা সমঝেরে রে দেলা হরে রাম’ কাণ্ড ঘটবে। চলবে

১০ মে ২০২১