মহাবিশ্ব ও কোরআন একে অপরের আয়না

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : এপ্রিল ০২, ২০২০

দ্বীনি জগতে অনেক ব্যাখ্যাই অনড় বা অটল নয়। কারণ পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে নতুন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে ব্যক্তি যখন ধর্মীয় টেক্সটের মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন স্বতস্ফূর্তভাবেই ব্যাখ্যার বিবিধতা গড়ে ওঠে। শুধু ইসলামের ঐশী বয়ানগুলোর ক্ষেত্রেই নয়, জাগতিক অনেক জ্ঞান ও শাস্ত্রই নতুন জ্ঞানের আলোকে পুনর্ব্যাখ্যাত হয়ে থাকে। মানবীয় জ্ঞান তো স্থির কিছু নয়, কিন্তু ধর্মীয় যে টেক্সট, তার লেখ্যরূপ স্থির। তার ঐশিতার দাবিই এটি যে, নানা যুগের জ্ঞানগত অবস্থা অনুযায়ী তা নানামাত্রায় বোধগম্য হতে থাকবে, সময়ের প্রবাহে তা অর্থের বা তাৎপর্যের পাপড়ি ক্রমাগত মেলে দিতে থাকবে। পরিবর্তিত বাস্তবতা— তা হোক সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক বা জ্ঞানগত— কিতাবের অন্যতর অর্থ ও বিবিধ তাৎপর্য ও ইশারা বুঝতে সহায়তা করে। বস্তুগত ও জ্ঞানীয় বাস্তবতা `আয়াত`-এর নব নব অর্থকে উন্মোচন করতে থাকবে। কিতাব যেহেতু অনাগত কালের জন্যেও, তাই অবশ্যই এর ভেতরে আছে অর্থের সম্প্রসারণশীলতা, আছে নতুন কালের জন্যে অপেক্ষমাণ নতুন নতুন ইলম ও হিকমাহ।

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, “আমি দিকচক্রবালে দেখাতে থাকব আমার নিদর্শনগুলো এবং তোমাদের সত্তায়ও। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণিত না হয়, ইহা সত্য।” (সূরা হামীম সিজদা/ফুসিলাত, আয়াত ৫২-৫৩)  অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের অর্থ ক্রমউন্মোচনশীল। মানুষের ভাষিক সীমাবদ্ধতা আছে, আছে জ্ঞানগত সসীমতা। তাই মানুষ তার যুগের অঞ্জলি দিয়ে অর্থের কালামুল্লাহর মহাসাগর থেকে তুলে আনে যেটুকু জল, সেটুকুকেই চূড়ান্ত আর স্থির ভাবা কোরআনের অসীমতাকে সীমাবদ্ধ করবার বাতুলতামাত্র। রাসুলের (সা.) বাণীর তাৎপর্যও তা-ই। কেননা রাসুল (সা.) ‘প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না।’  (সূরা নাজম- ৩)। রাসুল যা বলেন, তাও প্রত্যাদিষ্ট। এই যে শত শত বছর ধরে হাজার খানেক তফসির রচিত হলো, রচিত হলো হাদিসের এত এত `শরাহ`, এটাই প্রমাণ করে ওহির জ্ঞানের চলিষ্ণুতা, তাৎপর্যের মুক্তক্রীড়া। আপাত অর্থের বাইরেও তাৎপর্যের যে গভীর জগৎ, সত্যিকার ঐশী কিতাবের ক্ষেত্রে তা থাকে সাধারণত ভবিষ্যতের গর্ভে। যা `বর্তমান`এও ঝলক দিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে।

অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে গভীর লেখা আছে ব্যাখ্যাশাস্ত্র বিষয়ে অন্যতম আকরগ্রন্থ The aims of Interpretation এর লেখক আমেরিকান তাত্ত্বিক ইডি হার্শ্চের। তিনি জানান, There is a land of meanings beyond present and past human consciousness— the land of future। খোদায়ি কালামের ক্ষেত্রে কথাটি আরো বেশি সত্য।

বিশ্বপ্রকৃতি, মানবসমাজ ও সভ্যতার গতিধারা, নিজ জৈবিক ও পরমার্থিক সত্তার অনুধাবন আর ‘কিতাব’ অনুধাবন সমার্থক যেনবা। ঐশী কিতাব ও মানুষের সমাজ ও সত্তাসমেত এই মহাবিশ্ব— একে অপরের প্রত্যয়নকারী। মহাবিশ্ব ও কোরআন একে অপরের আয়না। কারণ যেটাকে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা বলি, সেটা আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং আল্লাহর কোনও বাণী, নবির কোনও কওল বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার বিরোধী হওয়ার সুযোগ নেই। যদি বিরোধ দেখা দেয় তবে বুঝতে হবে, হয় আমাদের আয়াতের তাৎপর্য বুঝতে ভুল হয়েছে, না-হয় বৈজ্ঞানিক সূত্রকে আরো কয়েকধাপ এগুতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হলে। ভবিষ্যৎ অবশ্যই যেকোনো আপাত অসামঞ্জস্যকে সামঞ্জস্যে নিয়ে আসবে, এটা মুমিনের বিশ্বাস।

তাই হোক ‘পুজি’ গ্রন্থ, হোক ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ বা ‘অব গ্রামাটোলজি’ বইখানা বা হোক মানবীয় সৃজনশীলতা ও প্রচেষ্টার অন্যকোনো উৎপাদন— তা খোদায়ী বাণীর অর্থের ইঙ্গিত বুঝতে সহায়ক হতে পারে অনেক সময়। মানুষের সর্বকালের জ্ঞানীয় অর্জন দিয়ে কোরআন-হাদিসের অসীম গভীর প্রজ্ঞার কিছুটা আঁচ সম্ভব। এটাই ঐশীগ্রন্থের দাবি।

প্রজ্ঞাবান তাকাবে জগৎ ও মহাবিশ্ব নামক এই আয়াতের ( আয়াত মানে চিহ্ন) দিকে; সে নিদর্শন পরম্পরার পাঠ নেবে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠায়। সে ঐশী কিতাব পাঠ করবে ‘মানুষের’ চর্চা, সম্ভাবনা ও পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানের আলোকে। তারপরও রয়ে যাবে অনেক বাকি, অনেক অজানা। সসীমতা ও অপূর্ণাঙ্গতা মানুষের নিয়তি, তকদির।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক