মারিয়া সালামের কলাম ‘মসজিদ কেবল প্রার্থনা করার স্থান নয়’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২০

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, যে নিজের অর্থে আল্লাহর ঘর( মসজিদ) তৈরি করবে, আল্লাহ বেহেস্তে তার জন্য ঘর বানিয়ে দিবেন। সনদ: ওমর বিন খাত্তাব।
 
নবীর এই বাণী থেকেই বুঝা যায় ইসলাম ধর্মে মসজিদের গুরুত্ব কতটা অপরিসীম। তার প্রধান কারণ, মসজিদ কেবলমাত্র প্রার্থনা করার স্থান নয়। রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবেও মসজিদের গুরুত্ব রয়েছে, যা আমরা হয় ভুলে গিয়েছি নতুবা গুরুত্বহীন করে তুলতে চেষ্টা করছি।
 
নবীর সময়ে মসজিদ কেবলমাত্র নামাজ পড়ার জন্য তৈরি করা হয় নি, সেটা ছিল জনসমাগমের একটা স্থান। বড় বড় রাজনৈতিক এবং সামাজিক সিদ্ধান্তগুলো আলোচনার ভিত্তিতে মসজিদেই নেয়া হতো। আবার মসজিদ ছিল শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক দিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।
 
আবার মসজিদই ছিল বিপন্ন মানুষের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ের জায়গা। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় মুসলিমদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গেলেই দেখা যাবে, মসজিদগুলো ছিল জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু, গবেষণাগার। সেই গুরুত্ব বিচারে একেক মসজিদের কার্যকারিতা একেকরকম ছিল। এবং এই কাজের ধরণের ভিত্তিতেই নির্ণয় করা হতো কোন মসজিদের স্থাপত্যকলা, অবস্থান বা আয়তন কেমন ধরণের হবে।
 
সোজা কথা হচ্ছে, কোন মসজিদ কেমন হবে বা আয়তনে কত বড় হবে না ছোট হবে, সেটা নির্ধারিত হওয়া উচিত তার প্রয়োজনীয়তার উপরে ভিত্তি করে। সেখানে লোক দেখানো জাঁকজমকের স্থান ইসলামে নাই।
 
প্রিয় নবী বলেছিলেন, মানুষ যখন তাদের প্রার্থনাগৃহগুলো জাঁকজমকপূর্ণ করে গড়ে তুলবে, এরচেয়ে বড় শয়তানি কর্মকাণ্ড আর হতে পারে না। সনদ: ওমর বিন খাত্তাব।
 
তিনি আরো বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা মসজিদগুলোকে এতটা উঁচু করে বানানো শুরু করবে, যেমনটা করেছে অন্য ধর্মের লোকেরা। সনদ: ইবন আব্বাস।
 
ইবন আব্বাসের আরেকটা সনদে আছে নবী বলেছেন, মানুষের আমল যখন কমজোরি হয়ে আসবে, তাদের মসজিদগুলো তারা ততটাই জাঁকজমকপূর্ণভাবে তৈরি করতে থাকবে।
 
এত কথা লেখার কারণ, গতকাল নারায়ণগঞ্জ তল্লা মসজিদের সবগুলো এসি একসাথে বিস্ফোরিত হয়ে বহু মুসল্লি হতাহত হয়েছেন, যে ক্ষতি অপূরণীয়। অনেকেই বলছেন, মসজিদে এসির কি প্রয়োজন?
 
বর্তমান সময় বিবেচনায়, এসি আর কোন বিলাসী দ্রব্য নয়, এটা প্রয়োজন। এটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক যে মসজিদ যদি কেবল নামাজ আদায়ের স্থান হয়ে থেকে যায়, প্রকৃত আল্লাহ্‌র ঘর না হয়, সেখানে এসির কি দরকার?
 
মানুষ নামাজ আদায় করে যে যার কাজে বের হয়ে যাবে, হাদিসে যেমনটা আছে। এই পাঁচ মিনিটের জন্য এসির কি প্রয়োজন? এসির প্রয়োজন তখনই হবে যখন মসজিদে ক্লান্ত ভিক্ষুক বা পথচারী গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবে। বা ক্লান্ত কোন মজুর বা রিক্সাচালক কাজের ফাঁকে গিয়ে একটু জিরিয়ে নিবে। অথবা, বিপন্ন কোন মানুষ আশ্রয় নিবে। বা মসজিদকেন্দ্রিক কোন বড় আলোচনার আয়োজন হবে, যেখানে জ্ঞানীগুণী লোকেরা তর্কবিতর্ক করবেন আর অন্যরা তা শুনে নিজেদের শুধরে নিবে।
 
কিন্তু, আমাদের দেশে কোথাও কি মসজিদের এরকম কার্যকারিতা আছে? তুরস্কের ব্লু বা নীল মসজিদের কথা সবার জানা। সেখানে গিয়ে প্রথমেই অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, নারীপুরুষ সবাই যা যার মতো করে ইসলামি আলোচনা করছেন মসজিদের ভেতরেই বা একাকী কেউ প্রার্থনা করছেন, কেউ কুরআন পড়ছেন।
 
মসজিদ খুলে দেয়া আছে সবার জন্য। শিশুরা হৈচৈ করে খেলা করছে বা দৌড়াদৌড়ি করছে মসজিদ প্রাঙ্গণেই। আল্লাহর ঘর তো বান্দাদের জন্য খোলা, আমাদের দেশের মতো নয়। আমাদের এখানে নামাজের সময় ছাড়া মসজিদের দরজা মানুষের জন্য খোলা থাকে না কখনওই।
 
আমাদের মসজিদকেন্দ্রিক যেসব মাদ্রাসা রয়েছে সেখানে গরীবের সন্তানরা খেয়ে না খেয়ে পড়ালেখা করে, এই গরমে অনেক ছাত্র ফ্যানের বাতাসেও ঘুমাতে পারে না। আবার অনেক মাদ্রাসায় ছোটছোট শিশুরা দিনের পর দিন কেবল মুড়ি খেয়ে পার করে দেয়। সেই অবস্থায় মসজিদের জাঁকজমক কিভাবে একজন মুসলমান মেনে নেন, আমার মাথায় আসে না।
 
এসবের চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এসি লাগিয়ে আমি যদি মুসল্লিদের কিছুটা আরাম দিতে চাই, তাহলে সেখানে তাদের নিরাপত্তার দায়ভার আমি কেন নিব না? কেন আমি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা রাখব? এর উত্তর আমাকে কে দিবেন?
 
প্রার্থনা করার সময় যারা আহত হয়েছেন আমি তাদের সবার সুস্থতা কামনা করছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রকৃত জ্ঞান দান করুণ। আমিন।