
মারিয়া সালামের গদ্য ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির প্রেমপত্র’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০২, ২০২২
আজ বিশ্ব চিঠি লেখা দিবস। সকাল থেকেই নস্টালজিক ফিল করছি। একসময় কত যে চিঠি লিখতাম! বেশিরভাগই ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে মামাকে পত্র লিখ বা কুশল জানতে চেয়ে চাচাকে পত্র লিখ টাইপ চিঠি।
চিঠি মানেই একটা সময় হয়ে গেল প্রেমপত্র। আমাদের সময় প্রেমপত্র চালাচালি একটা দারুণ ঘটনা। আমাদের কাছে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম রোম্যান্টিক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের স্কুল-কলেজে পড়ার সময় প্রেমপত্র বিনিময়।
এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত কম। আমাকে তেমন কেউ সাধারণত প্রেমপত্র দিত না, সাহস পেত না বললেই ভালো বলা হবে। মেয়ে হিসেবে এত কাঠখোট্টা ছিলাম, ওই বয়সে আমার সাথে প্রেম কে করতে চাইবে?
কাজিনদের, বোনদের, বান্ধবীদের কাছে রঙিন খামে অনেক চিঠি আসতো। সেসব চিঠির পাতায় পারফিউমের গন্ধ লেগে থাকত, কোনোটার ভেতরে শুকনা ফুল আর রোম্যান্টিশিজম খুব বেশি হলে চিঠির সাথে বক্সে করে বিদেশি চকোলেট আসতো।
আর চিঠি বিনিময়ও হতো আজব অদ্ভুতভাবে। আমাদের ওদিকে বাড়িগুলো সব গায়ে-গায়ে লাগা। রাতের বেলা এক বাড়ির ছাদ দিয়ে আরেক বাড়ির ছাদ এভাবে কয়েক হাতে ঘুরে চিঠি যেত প্রাপকের কাছে। আমার বোন এরকম চিঠি বিলি চক্রের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিল। সে সুবাদে প্রতিদিন রাতেই আমাদের হাতে অন্তত চার/পাঁচটা প্রেমপত্র আসত বিলি করার জন্য। কোনো কোনো দিন আমরা সেগুলো পড়তাম।
চিঠি বিষয়ক এরকম কত কত ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন। আমি দেখি, মজা নি, হাসাহাসি করি। কিন্তু, জীবনে কোনোদিনই নিজে চিঠি পাব সেটা কল্পনাও করিনি।
এরকম একদিন আমিও চিঠি পেয়ে গেলাম। হাতিঘোড়া টাইপ চিঠি না, ভয়ানক আবেগী আর চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো সিরিয়াস চিঠি। পত্রবাহক আমার মামাতো ভাই। সে বিশাল গল্প।
সেসময় বাড়ির সামনে দুই বন্ধু, ধরে নি নাম-টার ত, খুব ঘুরাঘুরি করত আর দুজনেই আড়চোখে আমাকে দেখত। আমিও দেখতাম, হিহি। একদিন আমার মামাতো ভাই বলল, আপু, টকে তোমার কেমন লাগে? আমি শুধুশুধু কেন কাউকে খারাপ লাগে বলব, আমি বললাম, ভালোই তো।
ব্যস, পরের দিন পেয়ে গেলাম নীলখামে ভরা অসম্ভব সুন্দর এক চিঠি। চিঠি খুলতেই গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। কি সুন্দর হাতের লেখা। হালকা নীল প্যাডে গাড় নীলে লেখা, মৃত্যু এলে মরে যেতে হবে...
চিঠি পড়েই আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু হলো, চিঠি পেয়ে ধুমধরে দুইদিন বসে থাকলাম। কোনো কথা নাই...
তৃতীয় দিন আবার এলো হলুদখামে আরেকটা চিঠি। এভাবে একেরপর এক পাঁচটা চিঠি পেয়ে আমি বেকায়দায় পড়ে গেলাম। বোনরাও বলল, এই চিঠির উত্তর না দিলে মহাপাপ হবে।
সবদিকের চাপে পড়ে অবশেষে দু`লাইল লিখলাম, তোমার লেখা ভালো লেগেছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তুমি ভালোমতো পড়ালেখা করো।
পরের দিন গোলাপি খামে আরেক চিঠি। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে চিঠি খুললাম। চিঠি দেখে আমার মাথায় যাকে বলে ঠাডা পড়ল। মনে হচ্ছে তেলাপোকা হেঁটে গেছে এ চিঠির উপর দিয়ে। হতবাক হয়ে মামাতো ভাইকে বললাম, এটা কি?
ও স্বাভাবিকভাবে দেখে বলল, ট চিঠি দিয়েছে। মানে কি? ট এটা দিলে, এটা কে দিল? আগের চিঠি খুলে দেখালাম। সে মিনমিন করে বলল, ত। মানে, হচ্ছে কি? আমি কারসাথে আসলে প্রেমপ্রেম ভাব নিয়ে ফিল নিচ্ছি? ট না ত ? দ্রুত বল।
ট।
তাহলে, ত চিঠি লিখে দিল কেন?
আসলে হয়েছে কি, কাজিন বিড়বিড় করে বলল, ব্যাপারটা কমপ্লিকেটেড। ট এর লেখা বাজে বলে, সে ত কে দিয়ে লিখিয়ে নিত। কাল রাতে ত বলেছে, সে আর চিঠি লিখবে না। অগত্যা ট নিজেই লিখেছে।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে কাজিনকে বললাম, দুইটাকেই ডেকে আন। দুটাকেই ডাকবি।
ফায়ারব্রিগেডের পিছে একটা চিপা গলির মধ্যে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে। ট এর চোখে পানি। আমি শেষ কথা বললাম, তুই আর একদিন আমাকে চিঠি দিলে তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলব। এখন ভাগ এখান থেকে।
এবার ত এর দিকে ফিরে দেখি সেও কাঁদছে। উফ, তুমি কাঁদছ কেন?
ত ফিসফিস করে বলল, আমি সব সত্য সত্য লিখতাম, তোমাকে ফিল করেই লিখতাম। ওর চিঠির উত্তর দিয়েছ দেখে আমার হিংসা হয়েছিল। তাই আর চিঠি লিখে দিতে রাজি হইনি।
আমি কি বলব, বুঝে পেলাম না। হুংকার দিয়ে বললাম, তোদের দুটাকেই যেন আর কোনোদিন আমাদের বাড়ির সামনে না দেখি। থাপ্পর দিয়ে তোদের দাঁত ফেলে দিব। এরপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি এসে তিনদিনের জ্বরে পড়ে গেলাম।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী