অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

মায়া আর স্বার্থহীন মমতার উঞ্চ চাদর

কাউসার মাহমুদ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২২

তার যাবতীয় স্মৃতি একটি ক্ষীণ, অস্পষ্ট দাগের মতো আমার মানসপটে স্থির নিষ্প্রতিভ। মনে হয়, সমস্ত জীবনে সাকুল্যে অল্প কয়েকবার দেখেছি তাকে৷ তথাপি, শৈশবে সেই যে তাকে তার অতিক্রান্ত বয়সের ভারে নুব্জ সন্ধ্যামণি গাছের মতো ছোটোটি দেখেছি, তারপর আমাদের চোখে আর কোনোদিনই তিনি সুঠাম বলবান নারীদের মতো অমন চটপটে কর্মতৎপর হয়ে উঠেননি। যেন আমাদের ছোটো ফুপুটি সমগ্র জীবন ধরেই একপ্রকার অবগুণ্ঠিত ছিলেন। সংসারধর্মের সমূহ জটিলতা ও দুর্বোধ্যতা থেকে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। ঠিক যেন অবুঝ সে পল্লীবধূ; যার ছড়ানো গার্হস্থ জীবনে রাজ্যের শশব্যস্ততা। কিন্তু একমুহূর্ত তার দীর্ঘ ঘোমটাটি স্থানান্তরিত হলে ভীত হয়ে ওঠেন। ঘরে বাইরে যেকোনো পরপুরুষ বা অপরিচিত মানুষের সম্মুখে অকৃত্রিম জড়তা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। আমাদের ছোটো ফুপু ছিলেন ঠিক তাই—বা তারও অধিক আরও সলজ্জ আরও ধার্মিক আরও অপ্রস্তুত অপ্রতিভ। তার আটপৌরে জীবনে ব্যসন বলতে ছিল অবসরে পান চিবানো আর যাঁতি দিয়ে চুপচাপ সুপুরি কাটা। এসবের বাইরে খিঁচুনিগ্রস্থ নাতিটিকে নিয়েই ছিল তার যতসব আহ্লাদ, আনন্দময়তা। ভয় ও উৎকণ্ঠা। তাই নিম্নমধ্যবিত্ত বিপৎপাত এই দীর্ঘ সংসার জীবনে সম্পূর্ণ সবকিছু ছাপিয়ে এই একটিমাত্র নাতিকে ঘিরেই যেন তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে আবর্ত হয়েছিল। কোনোদিন তিনি তাকে তার দুচোখের আড়াল করেননি। কিন্তু যেদিনই তার এই নাতিটি তাকে বিদায় জানালো—তারপর স্পষ্টভাবেই যেন এই সংসারজলধি থেকে তিনি তার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যেখানে ইতোপূর্বে অশীতিপর বৃদ্ধ স্বামীর মৃত্যুও বোধকরি তাকে অতটা অসহায় ও দুঃখিত করে তোলেনি।

বরিশালের মৃধার হাঁট উপজেলায় বহুযুগ, বহুবছর আগে ছোটো ফুপুর বিয়ে হয়েছিল। কবে, কোন তিথিতে যে তিনি বিবাহিত হয়েছিলেন—এর কোনো নির্দিষ্ট হিসেব আমার জানা নেই। মনে পড়ে শৈশবে দাদুর সঙ্গে ফুপুর শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিলাম একদিন। আমার বয়স তখন কত আর! দুই তিন বা চার-ই হবে। সে কী ঝড় সেদিন। বিপ্রতীপ ঝড়ো হাওয়ার বিরুদ্ধে একহারা আমি এক শিশু কোনোরকম ছাতাটি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম—কিন্ত হায়! এক ছটাক ওজনের শিশুটিকে মুহুর্তে বাতাসের একটি ছাট এসে কয়েক হাত উড়িয়ে নিয়ে গেল! দাদু তখন বিপন্নপ্রায়, দিশেহারা। ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। ভয়ে, কান্নায় সেই যে তার বুকের ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম; তারপর সেদিনের কোনো স্মৃতিই মনে নেই আর।

তবু এত বৎসর পরে এসে যখন অতীত বাগডোরে স্মৃতি হাতড়াই—সেখানে বহুকালস্থায়ী কিছু মমতার উচাটন ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাই না। ছোটো ফুপুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎে জীবনভরই আমাদের দীর্ঘ দূরত্ব ছিল। এই দুরত্বের সবটুকুই ছিল বসবাসের জায়গা ভিন্নতা। কিন্তু গ্রামীণ নিরুত্তেজ এই নারীটি তার ভাইপো সকলের জন্য বুকের ভেতরে সর্বদাই বুঝি একটি স্নেহের সমুদ্র পুষতেন। যা দুপুরের অবসন্ন ছায়ার মতো নিস্তেজ, নির্জীব আর শান্ত। কিন্তু যখনই বহু বছর পরপর আমাদের সাক্ষাৎ হতো, সহসা বাণ ডেকে উঠত তাতে। সুপুরি পাতা ঘেরা তার নিস্তব্ধ মলিন বাড়িটায় পা রাখতেই একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেন। তারপর গলাজুড়ে সেই যে কান্না তার—যেন বহুকাল বয়ে চলা একটি সুপ্ত বেদনা থেকেই ক্ষণকালের জন্য  প্রাণময়ী হয়ে উঠেছেন তিনি। যেন হঠাৎই ছোট্ট সন্ধ্যামণি থকে  অশ্বথের মতো ছায়াঘন হয়ে উঠেছে তার শীর্ণ বাহুদ্বয়। চোখের পলকে তাতে জড়িয়ে নেন আমাদের।  সেখানে আমরা তার কান্নার স্তিমিত স্বরটি অনুসরণ করে ধীরে তার কাঁধে আমাদের মাথা রাখি। এভাবে তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে কাঁদেন আর তার গণ্ডদেশ বেয়ে নেমে আসা পরিস্রুত একটি জলধারা আমাদের হৃদয়কে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোথায়? কোন অতলান্ত হ্রদে—জানা নেই। যে ক`টাদিন আমরা তার কাছে কাটাতাম, পুরোটাজুড়েই থাকত এক অব্যক্ত অনুরাগ, মায়া ও ভালোবাসার বর্ণিল স্পন্দন। আমাদের যে কোনো আকাঙ্ক্ষা ও সবকিছুর প্রতি তার এত ব্যস্ততা, এত তড়িঘড়ি থাকত যে, মনে হতো এই সরলপ্রাণ নারীটি কোনোদিনই তার রক্তের বন্ধন ছেড়ে দূরে থাকতে চাননি, চান না। তাই এখনও ভাবি, এই ধরিত্রীজুড়ে যে কজন নারীর কাছে অকৃত্রিম স্নেহ, অনুরক্তি অনুভব করেছি; আমাদের ছোটো ফুপু তারই একজন।

বাবার পিঠাপিঠি বোন ছিলেন ছোটো ফুপু। পিঠাপিঠি বলতে চার ভাইবোনের মাঝে ক্রমানুসারে সবশেষে বাবা এবং তারই বড় ছিলেন ছোটো ফুপু। ফলে মায়ের কাছে শুনেছি বাবার সঙ্গে ফুপুর স্বভাবচরিত্র ও চেহারায় মিলটা ছিল সর্বৈব। যেমন, বাবার মতো ফুপুরও জনমভর রোগ বাওয়া শরীর। তেমনই অকৃপণ আর অবাস্তব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কখনোই দুটো পয়সা জমিয়ে নিজে খরচ করেননি৷ সংসারে যা-কিছু আসত-যেত এ নিয়ে কোনোরূপ সঙ্কোচ, দ্বিধা বা জড়তা তার ছিলো না। মোটকথা, একটা অস্পষ্ট দারিদ্র্য যে সবসময়ই তার জীবনজুড়ে অলঙ্ঘ্য নিয়তির মতো ঝুলে ছিল—বিষয়টা কোনোদিনই উপলব্ধি করতেন না তিনি। হয়তো করতেন কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না। যেন এমন যে, মাঝেসাঝে প্রকট দারিদ্র্যতার ভেতরও তিনি তার বংশীয় তালুকদারি পদবিটির কথা বিস্মৃত হন না। ফলে তার আচার-আচরণে স্বভাবজাত আড়ষ্টতার মাঝেও ফুটে থাকত একটা অকৃত্রিম গরিমা। প্রকৃতার্থে যা ছিল নিছকই অপরিণামদর্শীতা। এতে করে যা হলো, আমৃত্যু তিনি তার সেই মাটি লেপা ছায়াঘেরা ঘর, সংকীর্ণ হেঁশেল আর শান্ত পুকুরের চৌহদ্দির ভেতরই নিজেকে সন্তুষ্ট রাখলেন। অথচ, তার স্বামী মানে আমাদের ছোটো ফুপা ছিলেন যাচ্ছেতাই বদমেজাজি। মাকুন্দা। দেখলে সর্বদাই তার থেকে পালিয়ে বাঁচতাম। অবশ্য পরবর্তীতে ফুপা আমূল পাল্টে গিয়েছিলেন। আমাদের সঙ্গে আদর করে কথা বলতেন। হাসতেন, হাসাতেন। কিন্ত যত যাইহোক বৃদ্ধ বয়স পর্যন্তও গালিগালাজ তার মুখে সচল ছিল। মেজাজ কিছুটা চড়তেই, বরিশালের ভাষায় অনবরত `হালার ফো হালা` বলে একগাল খিস্তি উড়াতেন। তখন বাড়িতে কোনো আগন্তুক, অতিথি থাকলে ফুপু চুপসে যেতেন। আচলে মুখ গুঁজে বলতেন, `দেহো জ্বালা। এহনও আভণ্ড কইতেয়াছে এই বেডায়।`

অথচ সবসময়ই ছায়াচ্ছন্ন এই নারীটির সরল আশ্রয় থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। আসলে বঞ্চিত আর কি! মানুষের যাপনের যে বৈচিত্র্যময় ভিন্নতা ও ব্যস্তময় বেঁচে থাকা—তাতে ঐকান্তিক ইচ্ছেগুলো বয়স ও সময়ের সাথে সাথে বরাবরই পলকা হয়ে আসে। ঈষৎ মৃদুমন্দ বাতাসের দোলাতেও যা হড়হড় করে গড়িয়ে পড়ে। কেননা এই যে, সহসাই ফুপুর জন্য হৃদয় ব্যকুল হয়ে উঠেছে, এমন করুণভাবে ইতোপূর্বে কখনো কি তাকে উপলব্ধি করেছি? নিশ্চয় না। এতগুলো বৎসর গেল, সুদূর বরিশাল থেকে দূরভাষে কতবার ফুপু কেঁদেকুটে আমাদের ডাকলেন। কই যাইনি তো। যাবো যাচ্ছি করে কত কী পেরিয়ে গেল। আমরা বড় হলাম। ফুপু তার বৃদ্ধে উপনীত হলেন। তার দীর্ঘ ঘন কেশদাম পাতলা হয়ে এলো। শরীর শুকিয়ে কৃশতনু হলেন। তারপর ধীরেধীরে তার ভ্রু দুটিও কুঞ্চিত হল। এখন আমাদের প্রিয় সন্ধ্যামণি ফুপুটি কেবলই অস্থিসদৃশ হাড়জিরজিরে শরীরে একটি চড়ুইয়ের মতো ছোটো হয়ে এসেছেন। তবু তিনি আমাদের ডাকেন। কিন্তু আমরা এমনই জনাকীর্ণ যে, তা থেকে নিরুপদ্রব সুস্থির কোথাও যাওয়ারই অবকাশ হচ্ছে না। যেন বহুকালব্যাপী ব্যস্ততা আমাদের। তাতে এমনই নিমজ্জিত হলাম; যা থেকে উত্তরণের উপায় নেই। যদিও ব্যস্ততা বলতে কিছুই না। এসব ছিল কেবলই আত্মনিমগ্নতা। শুধুই আপনাকে নিয়ে ভাবা। এখানে বলে রাখি,  নিশ্চয় তা ভালো খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার জন্য নয়। বরং আমাদের ফুপুটি কোনোক্রমেই তার স্বামীর ভিটে পরিত্যাগ করে, খিঁচুনিগ্রস্থ আঠাশ-তিরিশ বছরের যুবক হতচেতন নাতিটিকে ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। তিনি না চাইলে কি হবে! ঠিকই একদিন চৈত্রের নিমসন্ধ্যেবেলা তার অশীতিপর বৃদ্ধ স্বামি লোকান্তরিত হলেন। আমাদের অদূরদর্শী, পতিব্রতা ফুপুটি পেলেন তার জীবনের প্রথম নির্মম আঘাত।

তারপর যদিও তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পিপীলিকার মত নিঃশব্দে সংসারে হাঁটাচলা করেন। কিন্তু এখনও যেন তার বেঁচে থাকা, তার নিস্তেজ চলাফেরা ও কণ্ঠাস্থিতে আঁটকে থাকা সেই মিনমিনে স্বরটি কারও জন্য মুখ্য। অনিবার্য। যা স্পষ্টতই তার কোনো সন্তান, আত্মীয়, ভাইবোন বা পৃথিবীর অন্য কারও জন্য নয়। তা কেবল এবং সর্বাংশেই ছিল তার একমাত্র খিঁচুনিগ্রস্থ বোকা নাতিটাকে ঘিরে। এমন যে তিনিই তার পিতামাতা হয়ে উঠেছিলেন। মোটকথা প্রায় তিরিশটা বছর ধরে যক্ষ্মের ধনের মতো যেভাবে তিনি তার এ নাতিটাকে আগলে রেখেছিলেন—তা এক পরমাশ্চর্যই বটে। শুধুই কি আশ্চর্য! তার এ অসীম আত্মত্যাগ ও পরমেশ্বরী চরিত্রের কথা সারা অঞ্চলজুড়েই বিস্তৃত হয়ে উঠলো৷ আর তা এমনই যে, লোকেরা তার নির্বুদ্ধ নাতিটিকে তার পরিচয়েই জানলো। কেউ বলতো না মাছুম অমুকের ছেলে। বলতো, মাছুম—মানসুরা নানীর নাতি।

মনে আছে, একবার বেড়াতে গেলে মাছুমের বাবা মানে আমার দুলাভাই, আমাকে ও মাছুমকে নিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদীতে মাছ ধরতে যায়। তখন ভরা ভর্ষা। প্রমত্ত নদীর পোয়াতি পেটে জল আর জল। ভীত হয়ে নৌকার মাঝে গুটি মেরে বসে ছিলাম আমি। আর গলুইয়ের দু`ধারে তারা পিতাপুত্র; সুদক্ষ জেলেদের মত  নদীতে জাল ফেলে চলছিল। এরমাঝে অকস্মাৎ কোনো একটি ঘটনায় চমকে উঠে মাছুমকে ধরতেই ও যেন বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়। চেয়ে দেখি ওর হাত-পা জমে গেছে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। খিঁচুনি উঠেছে। এই দেখে মুহূর্তে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে আমার। যেহেতু সেদিনই প্রথম—সাক্ষাৎ মাছুমের এই নিদারুণ অবস্থাটি দেখি, তাই অব্যক্ত এক ভয়ে বিমূঢ় হবার জোগাড়। অবশ্য মিনিট দুয়েক যেতেই সবকিছু পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। কেননা ওর বাবা শান্তভাবে ওপাশ থেকে এসে ওকে ধরতেই খিঁচুনিটা কমে আসে। হাত-পা ঝেড়ে ধীরেধীরে আবার সে কাজে যোগ দেয়। আমার সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠার চেষ্টা করে। যেন মুহূর্তকাল আগে ঘটে যাওয়া এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি। না তার পিতাকে কোনোরূপ উদ্বিগ্ন করেছে। সেদিন কোনোরকম বাড়ি ফিরে প্রথমে মায়ের কাছে মাছুমের ব্যপারে জিজ্ঞেস করি। এরপর ফুপুই সবিস্তারে বলেন, যেকোনো কিছুর হঠাৎ স্পর্শ বা শব্দেই মাছুৃমের এই হাল হয়। হতে পারে তা একটি শুষ্ক, ক্ষীণ ঝরে পড়া ডাল ভাঙার শব্দ। কি`বা জলের ওপরে কোনো দুষ্ট ছেলের ঢিল বা আকাশে দৈবাৎ বজ্রাঘাত।

যাহোক, এতকিছুর পরও সমস্ত জীবন ধরে ফুপু তার নাতিটিকে পাখির ছানার মতো নিজের কাছে আগলে রেখেছিলেন। কোনোদিন একমুহূর্তের জন্য দুচোখের আড়াল করেননি। সেই শৈশব থেকে আঠাশ বছর অবধি মাছুমকে নিজে পুকুরঘাটে নিয়ে যেতেন। নিজ হাতে গোসল করিয়ে হাত ধরে ঘরে ফিরতেন। মূলত মাছুমের আহারবিহারসহ যাবতীয় সবকিছুর ওপরই যেন ফুপু তার আপন সত্তাকে নিয়োজিত করেছিলেন। ফলে অনিবার্যভাবে কেমন যেন তার নাতিটিই তার জীবনের প্রধান ও একমাত্র উপলক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্ত হায়! অদৃষ্টের এ কী নির্মম লিখন! স্বামীর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে না উঠতেই, বছরের ব্যবধানে প্রভূ তার নাতিটিকেও উঠিয়ে নিলেন। জানা গেল, একাকী গোসল করতে গিয়ে জলে ডুবে মাছুমের মৃত্যু হলো। আর সহসাই ঘটে যাওয়া এই মৃত্যুটি ফুপুকে চিরদিনের জন্য নির্বাক করে দিয়ে গেল।

এরপর আমাদের ছোটো ফুপু কোনোদিনই হাসেননি। দিনভর কাঁদতেন। রাত হলে অস্ফুট স্বরে নাতির জন্য শোক করতেন। শেষবার যখন অনেক বলেকয়ে আমাদের বাড়ি আনলাম—তখনও অনবরত সে কান্না আর বিষাদ স্মৃতিকাতরতা বাড়ির সকলকেই ব্যথিত করে তুললো। ভাবলাম, হয়তো কিছুদিন থাকলে ঠিক হবে। কিন্তু না, কিছুই ঠিক হয়নি। তিনি থাকেনও নি। কয়েকটা দিন যেতেই নিজের ভিটেমাটি, স্বামী ও নাতির কবরের জন্য  উদ্বাহু হয়ে উঠলেন। আমরা তাকে তার নিবিড় ছায়াঘন গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে আসলাম। তিনি গেলেন ঠিক। কিন্তু আর কোনোদিন আমাদের কাছে না ফেরার মনস্থ করে। কেননা এরপর অল্প ক’দিনের মধ্যেই আমাদের ছোটো ফুপু তার নাতির শোকে অনন্তের পথে পাড়ি জমালেন। হয়তো সেই স্বর্গের পথে, যেখানে তার নাতি তার অধীর আগ্রহে বসে আছে। সেইসাথে আমাদের জন্য রেখে গেলেন উৎসর্গিত সমস্ত একটি জীবন। যেখানে আছে কেবলই মায়া আর স্বার্থহীন মমতার উঞ্চ চাদর...।

লেখক: কবি ও অনুবাদক