মিনহাজুল ইসলামের কলাম ‘ইতিহাস কথন’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২০

আহমদ ছফা বলতেন, ‘যদি কিন্তু দিয়ে ইতিহাস হয় না।’ বিখ্যাত ফরাসি ইতিহাসবিদ মার্ক ব্লখ বলতেন, ‘ইতিহাস চাকার মতো নয়, বরং ফিতার মতো যা অসংখ্য সুতো দিয়ে তৈরি।’ ইতিহাস এক জিনিস আর ইতিহাসকে যখন ডিসকোর্সে রূপান্তর করা হয় সেটা আরেক জিনিস। ডিসকোর্সে পরিণত হওয়ার আগে সেটা ইতিহাস থাকে না, সেটা হয় খবরের কাগজ কিংবা কোনো সাদা প্রতিবেদন, যা এদেশে ইতিহাস রূপে মানুষ গিলে খায়।

ইতিহাস কি এবং কেন পড়তে হয় তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, ইতিহাস ইতিহাসে কখন পরিণত হয়। ইতিহাস ইতিহাসে পরিণত হওয়ার আগপর্যন্ত টনক নড়ে না, যখনই তা ইতিহাসে পরিণত হয় তখন দামামাটা বাজে। ইতিহাস কখনো ‘এটার জন্য এটা, ওটার জন্য ওটা, ওটা হইলে ওটা হতো, এটা হইলে এটা হইতো না’ এসব কন্ডিশন মেটাফিজিক্স নয়। কিংবা কোনো দৈব ফোর্স নাই ইতিহাসের পিছনে। একটা ঘটনা ইতিহাসে পরিণত হয় যখন তার সাথে পলিটিক্স সমাজ সংস্কৃতি ও একটা পরিবর্তনের সংমিশ্রণ থাকে। অর্থাৎ ইতিহাস কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয় না।

প্রশ্ন হলো, ইতিহাসকে অর্থাৎ কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে অস্বীকার করা বা ক্রিটিক করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু ইতিহাসকে যখন ডিসকোর্সে রূপ দেয়া হয় তখন সেটা ক্রিটিকের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। যেমন ব্রিটিশরা তাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোনো সৎ উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করেনি, অথচ এখনকার সময়ের অনেক পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবি, একচোখা পাঠক বলে, ব্রিটিশরা এসে ভারতীয়দের শিক্ষিত করেছে। তাইলে এই যে ডিসকোর্সটা এতদিন ধরে চলে আসছে, এটার ক্রিটিক করা বা পর্যালোচনা করা ইতিহাসের পাঠকের দায়িত্ব। সাহিত্য কিংবা রঙ্গমঞ্চের অভিনেতার পক্ষে তো আর তা সম্ভব নয়।

কোনটা হলে কি হতো বা কোনটা ভুল হইছে, সেটা বা কোনটা সঠিক হইছে, সেটা কোনো ঐতিহাসিক কিংবা ইতিহাস পাঠকের জাজমেন্টের বিষয় নয়। বরং কি হয়েছে এবং তার আউটকাম কিভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে সেটা একজন ঐতিহাসিক এবং ইতিহাস পাঠকের দায় তা বোঝার এবং ব্যাখ্যা করার। ইতিহাস কোনো সাহিত্য, শিল্প বা সুন্দর ইম্প্রেশনিস্ট আর্ট না, যে পড়লাম, আর দেখলাম  তাহলে সেটা খবরের কাগজ কিংবা সাদা প্রতিবেদনই।

ইতিহাস মাত্রই তার আইডিওলজি, উদ্দেশ্য, প্রেক্ষাপট এসব আসবে ক্রিটিক আসবে, পর্যালোচনা হবে, জাস্টিফিকেশন হবে। ইতিহাস কোনো চিত্রকলা না যে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকায় থাকবো আর ‘ওয়ান্ডারফুল’ বলে চলে যাব। কোনো কিছুই ইতিহাসের বাইরে নয়, ইতিহাসকে কাটতে হবে, ছিঁড়তে হবে, ভাঙতে হবে,  ডিসকার্সিভ করতে হবে। গ্যালিলিওর আগপর্যন্ত বিজ্ঞানের ইতিহাস একভাবে লেখা হয়েছিল। গ্যালিলিওরা আসার পর বিজ্ঞানের ইতিহাস আরেকভাবে লেখা হলো।

এখন তাহলে আরিস্ততল টলেমিরা ভুল ছিলেন, সেটা বলা যাবে না? তাদের তত্ত্বের যে ইতিহাস তার আউটকাম মধ্যযুগের ইউরোপে ছিল এটা বলা যাবে না? ইতিহাসের ডমিন্যান্ট এবং সরলীকৃত ডিসকোর্সগুলোয় আঘাত করলেই স্টাইলিশ বুদ্ধিজীবী পাঠক ক্ষেপে যায়। আবার তারাই প্রগতিশীলতার বাণী প্রচার করে। কে ভ্রান্ত আর কে সঠিক সেই আলোচনা করতে বসলেও ইতিহাসকে কাটাছেঁড়া করতে হবে। অনেক দরবেশরূপী জালিমকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, এটা ভুলে গেলে চলবে না।

ভ্রান্ত-সঠিকের বিচারটাও ইতিহাসকেই সামনে রেখেই করতে হয় আফটার অল। যদি ক্রিটিক করা হয় তাহলে ডিসকোর্সকে ক্রিটিক করা শ্রেয়, ডিসকোর্সের সৃষ্টিকারীর শিশ্ন আছে কিনা, কিংবা দাম্ভিকতা বা আত্মনিগ্রহ কেমন তা নিতান্তই অর্থহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক। যেমন কেউ যদি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার করার উদ্দেশ্য হলো ভালো আমলা হওয়া এটা একটা ব্রিটিশ কলোনিয়াল ট্রেন্ড, এখন কারোর সাধ্য থাকলে করুক আমার এই কথার রিফিউট ইতিহাসকে সামনে টেনে, আমি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করবো খোদার কসম।

এখন কেউ ডমিন্যান্ট ডিসকোর্সকে এটাক করে এই ডিসকোর্সের পক্ষে থাকলে, তার ডিসকোর্সকে করুক ক্রিটিক, সে সাদরে গ্রহণ করবে কিন্তু তা না করে কেউ যদি খবরের কাগজকে ইতিহাস মনে করে পড়ে এবং বলে, ওই ইতিহাস পড়ুয়া ভ্রান্ত,  বিভ্রান্তিতে আছে, শিশ্নসূয়াতে ভুগছে— তাহলে তো আর হলো না। এতে তার নিজেরই ফ্রাস্ট্রেশন প্রকাশ পায়, শিশ্নহীনতা কার সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে! প্রত্যেক জাতি সমাজ রাষ্ট্রই অতীতের শিকার। কিন্তু অতীত মানে অতীত নয়, অতীত মানে ভবিষ্যৎও। যে ইতিহাস পড়ে, তার এই ধারণা আছে।