মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : মার্চ ২১, ২০২১

যশোরে এসে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিলেও খুব একটা অসুবিধা হয়নি ওদের। সজীবের এসএসসি’র ফলাফল মোটামুটি হয়েছে বিধায় ও যশোর পলিটেকনিকে ভর্তি হয়। কিছুদিন পরে বাসা ছেড়ে ছাত্রাবাসে চলে যায় সজীব। শিলা সবকিছু ভুলে পড়ছে। ভাল ফলাফল করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। আবার রাজশাহী ফিরতে চায় শিলা। শিউলি, সামিয়াদের কথা ওর খুব মনে পড়ে। সামিয়া নিয়মিত চিঠি লিখে রাজশাহীর সব খবর জানায়। ওর চিঠি যেন প্রেমপত্র হয়ে আসে শিলার কাছে। গতকাল পাওয়া সামিয়ার চিঠির উত্তর দেয়া হয়নি। কি লিখবে শিলা, ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। বারবার শুধু শেষ বাক্যগুলো মনে পড়ছে... ’আজ তোকে ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে করছে, খুব মিস করছি। লটস অব লাভ এন্ড হাগস!’

লেখাপড়ায় ভাল হলেও শিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু যেকোন ভাবেই ও উচ্চশিক্ষা নিতে চায়। লেখা পড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে ওর মতো মেয়েদের এই সমাজে জায়গা কোথায় হবে তা কল্পনা করতে অসুবিধা হয়না শিলার। মায়ের মতো দেখতে হয়নি তা শুনে শুনেই ও বড় হয়েছে। ছোটবেলায় কতজনকেই বলতে শুনেছে এই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক যৌতুক লাগবে। বড় হতে হতে শিলা বুঝেছে সামিয়ার মতো দেখতে সুন্দরী মেয়েদের জন্য ছেলেদের লাইন পড়ে গেলেও তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। শরীরের গঠন, চামড়ার রঙ বিবেচনায় যে সৌন্দর্য নিরূপিত তাতে সাধারণত নারী কতটা যৌন-উদ্দীপক, কতটা যৌন আবেদনময়ী তা প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে ছেলেদের কাছে।

তাই প্রেমিকার সন্ধান কিংবা পাত্রীর সন্ধানে নারীর দৈহিক গড়ন ও ফরসা রঙ ছেলেদের প্রাথমিক বিবেচ্য। ছেলেরা হয়তো বুঝতেই পারে না তাদের এই মনোভাব কতটা বর্ণবাদী আর কামুক! কীভাবে ছেলেদের মাঝে এই ধারণা জন্মেছে, তা ভেবেই হাসি পায় শিলার। সে রাতে চাচার সাথে মিলিত না হলে শিলা বুঝতেই পারতো না তার আবেদন কত গভীর। সমাজের এই প্রবল যৌনবাদী মনোভঙ্গীর বাইরে নিজেকে মর্যাদার আসনে নিতে হলে তাকে নিজের সামাজিক অবস্থান তৈরি করতে হবে এই বোধ শিলার হয়েছে।

শিলার পরীক্ষা শেষে তাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসে হামিদা। ওর দাদার শরীরটা ভাল নেই। শিলার দাদীর চলে যাবার পর থেকেই ওর দাদা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। এখন আর নিজের মতো করে চলাফেরাও করতে পারেনা। শকুন্তলা তার দেখাশুনা করে। আয়নালও স্কুলের সবসময় বাবার কাছেই থাকে। সেদিন দুপুরে হঠাৎ দাদার শরীর খারাপ হতে থাকে। শকুন্তলা খালা মাকে ডাকলে মায়ের সাথে শিলাও দাদার ঘরে যায়। দাদা চোখ খুলতেই পারছিল না। বিড়বিড়   করে কি যেন বলছিলেন। মনে হলো চাচাকে ডাকলেন। মা আর শকুন্তলা খালা হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিতে থাকে। পরিস্থিতি বুঝে শিলা মাকে বলে আয়নালের স্কুলে যায়। আয়নাল তখন ক্লাসে ছিল। শিলার কাছে সব শুনে ক্লাস ছেড়ে কৈলাস ডাক্তারের বাড়িতে ছোটে।

ডাক্তারকে সাথে গিয়ে দ্রুত বাড়ি পৌছায়। বাবার মুখে চামচ দিয়ে পানি তুলে দেয়। শিলা দূর থেকে লক্ষ করে দাদা যেন তৃষিত ছিল এমন করেই পানি খাচ্ছিল। চাচা তিনবার পানি খাইয়ে দেবার পর দাদা যেন নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। মনে হচ্ছে যেন ছেলের হাতে জল খেয়ে তিনি জগতের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন আর বিশ্রাম নিচ্ছেন। ডাক্তার নাড়ি দেখলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। এরপর আস্তে করে বললেন, আয়নাল ভাই কাকা ঘুমিয়ে পড়েছেন। কৈলাস ডাক্তারের চোখে জল। চাচাকে কেঁদে উঠতে দেখে সবাই কেঁদে উঠলেন। শকুন্তলা খালা আর মায়ের বিলাপে বাড়ির বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। পাশের বাড়ি থেকে জয়নাল জ্যাঠা আসে। প্রতিবেশীদের ভিড় বাড়ে। জয়নাল জ্যাঠা আত্মীয়-স্বজনদের খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করে। ওসমান বাড়ি এলেই জানাজা হবে বলে সবাইকে জানিয়ে দেয় জয়নাল।

পারিবারিক এই শোক ওসমান ও আয়নালের জন্য বড় ধাক্কা। আয়নাল নিজের সংসার পাতার আগেই পিতৃমাতৃহীন হলো। আত্মীয় পরিজনের কথায় দুই ভাই বাড়ির অন্যদের সাথে পরামর্শ করে সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি শেষ করে। জমা-জমির ভাগ বাটোয়ারা নিয়েও কথা শুরু হয়। আয়নাল এসবের কিছুই মাথায় তোলে না। ওসমানও এসবের দায়িত্ব আয়নালকেই বুঝিয়ে দিতে চায়। আয়নালকে ডেকে ওসমান বলে, দেখ আমি তো এত বছর ধরে বাড়ির বাইরে আছি। জমা-জমি এসব তুমিই ভাল বুঝো। তুমি যা ভাল বুঝো করো, তোমার ওপর আমার আস্থা আছে। আর আমি তো অবসরেই চলে আসবো। তখন না হয় তোমাকে সহযোগিতা করবো। আয়নাল চুপচাপ শোনে। সবশেষে বলে, আপনি যা চাইবেন তাই হবে। এ যুগে এমন ভাই খুব একটা হয় না। নিজের চাচাতো ভাইদের মাঝেই তো দেখছে কত রেষারেষি-বিবাদ।

পরিবারের সবকিছুই আয়নালের দায়িত্বে রেখে ওসমান যশোরে ফিরে যেতে চায়। হামিদা ও শিলা আরও ক’টা দিন থাকতে চাইলে ওসমান ওদের রেখেই যশোর ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সজীব বাবার সাথে যশোর চলে যায়। পলিটেকনিকের ছাত্রাবাসে অনেকটা মুক্ত জীবন পায় সজীব। রাজনীতির আলাপ আলোচনা শোনে। এভাবেই সখ্যতা গড়ে ওঠে গোপন বিপ্লবী পার্টির সাথে। তাদের গোপন জীবন, সমাজ বদলের স্বপ্ন, শোষক ও নির্যাতকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথাগুলো সজীবকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। কিন্তু পত্রিকায় ওদের নিয়ে নানা নেতিবাচক খবর পড়ে সে দ্বিধান্বিত।

জয়নাল শিলার বিয়ের ব্যপারে কথা বলে হামিদার সাথে। শোন শিলার মা, শিলা তো বড় হচ্ছে ওর জন্য কিছু সম্মন্ধ প্রস্তাব আসছে। তোমরা চাইলে দেখাদেখি হতে পারে। হামিদাকে চুপ থাকতে দেখে জয়নাল বলতে থাকে শিলা তো দেখতে সুশ্রী নয়। এই বয়সে বিয়ে না হলে পরে তো ভাল পাত্র পাওয়া যাবেনা, তাই বলছিলাম কি পাশের গ্রামের একটা ছেলে আছে সেনাবাহিনীতে চাকুরি করে। ছেলেটা আই এ পাশ, তোমার ভাবীর আত্নীয়। ছেলেটাকে আমি চিনি, অত্যন্ত নরম স্বভাবের। তোমাদের মত থাকলে আলাপ করতে পারি। তাদের কোন দাবি দাওয়া নেই, শুধু ভাল বংশের, লেখাপড়ায় ভাল মাধ্যমিক পাশ একটা মেয়ে চায়। ছেলেটা এখন ছুটিতে আছে, চাইলেই দেখতে পারো। ওসমানের সেনাবাহিনীর জীবন থেকে হামিদার শিক্ষা কম হয়নি। তাই এই প্রস্তাবে তার মন থেকে কোন সায় নেই। কিন্তু ভাসুরকে মুখের ওপর না বলে দেয়াটা হামিদার পছন্দ নয়। আপনারা মেয়ের অভিভাবক, বিয়ের ব্যপারে তো আপনারাই কথা বলবেন। তাই বলছি, এ ব্যাপারে আপনি শিলার আব্বার সাথে কথা বলেন। মনে মনে বলে, শিলাকে কোনভাবেই এখন বিয়ে দেয়া চলবে না। মেয়েটা পড়াশুনায় ভাল। ওর পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। কিন্তু ওসমান যদি বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। এসব ভাবতে হামিদার খুব কষ্ট হচ্ছে।

পরের সপ্তায় ওসমান বাড়ি আসে। শিলাকে পাত্রস্ত করতে জয়নালের প্রস্তাব তার অপছন্দ নয়। চলবে