মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ৭

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০২১

সেনাবাহিনীতে এখন সুযোগ সুবিধা বাড়ছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনেও যাবার সুযোগ হচ্ছে। একবার মিশন করে এলে আর্থিক সচ্ছন্দও হবে। এসব বলে হামিদাকে রাজি করাতে চাইছে ওসমান। কিছুদিন পরে আমি অবসরে যাব। শিলা তো চোখে পড়ার মতো সুন্দরীও নয়। এছাড়া বয়স বাড়লে মেয়েদের চেহারায় পরিবর্তন আসে। তখন হয়তো এরকম একটা ছেলে পাওয়াও কষ্টের হবে। সবকিছু ভেবে আমার কিন্তু ভালোই লাগছে, বলেই হামিদার মুখের দিকে তাকায়। হামিদার ভাবলেশহীন মনোভাব দেখে ওসমান বুঝতে পারে, এই প্রস্তাবে হামিদার সায় নেই। ওসমান বলতে থাকে আর ক’টা দিন বাদেই চাকুরি শেষ আমার। এই অবস্থায় মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে ভাল হয়। এছাড়া ক’দিন পরেইতো আবার গ্রামে ফিরতে হবে। এখানে থেকে ওর পড়াশুনা চালাতে হলে অনেক দূরে কলেজে যেতে হবে। এলাকার পরিস্থিতি ভাল না, এরকম যাতায়াতে মেয়েরা নিরাপদ নয়। এছাড়া বিয়ে হয়ে গেলে তো স্বামীর সংসার করেও লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারবে। আমরা না হয় শিলার লেখাপড়ার বিষয়টা নিয়ে পাত্র পক্ষের সাথে কথা বলবো। আর এতে ছেলে পক্ষের সম্মতি থাকলেই না হয় রাজি হবো।

হামিদা আপত্তি জানিয়ে বলে, আমার এই বিয়েতে মত নেই। নিজের জীবন দিয়ে আমি বুঝেছি, এ বিয়ে হলে শিলা আমার ভালো থাকবে না। ওর জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে। শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে মেয়েদের কি অবস্থা হয় সেটা তুমি কি করে বুঝবে। ওসমান আর কথা বাড়ায় না। পরদিন জয়নালকে এই প্রস্তাবে তার সম্মতি নেই জানিয়ে যশোরে চলে যায় ওসমান।  

জয়নাল মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে কিছুটা অপদস্ত বোধ করে। বেশ বড় মুখ করে স্ত্রীর আত্মীয়দের বলেছিল ভাইকে বলে রাজি করাবে। জয়নাল ভেবেছিল মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে হামিদার কাছে ওর কদর বাড়বে, আর বিয়েটা হয়ে গেলে শিলা শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। তখন হামিদাকে বাড়িতে অনেক সময় একা পাবে। একটা সুযোগ হবে হামিদার কাছে আসার। অনেক দিনের ইচ্ছা পূরণের একটা সুযোগ হবে। হামিদার দিকে তাকালে এখনো শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি হয় তার। নানা ছুতায় হামিদার কাছে আসতে চায় জয়নাল। হামিদাকে বলে, শোন শিলার মা, ওসমান তো বিয়েতে রাজি হলো না। আমরা কি তবে অন্য কোন সম্মন্ধ দেখবো? স্কুলে শিক্ষকতা করে এমন একজনের কথাও সেদিন বলছিল হাফিজ মেম্বর। হামিদা বলে ভাইসাব, শিলার পরীক্ষার ফলটা বের হোক, এরপর না হয় দেখবেন।

জয়নাল বলতে থাকে আমি বেশ বুঝতে পেরেছি কেন তুমি ওই ছেলেটার সাথে শিলার বিয়ে দিতে চাওনি। ওসমানকে ছেড়ে থেকে তোমার যে কষ্ট হয়েছে তা তুমি শিলার জীবনে দেখতে চাওনি। হামিদা হেসে বলে আপনি ঠিকই বলেছেন ভাইসাব। এ যুগের মেয়েরা বিয়ের পর স্বামী ছাড়া থাকবে বছরের পর বছর, আর ঘরের খাটুনিতে জীবন পার করে দিবে এটা ভাবা যায় না। জয়নাল হেসে বলে, তোমার কষ্ট আমি বুঝি। আমারওতো তাই। তুমিতো জানোই তোমার ভাবী কতদিন অসুস্থ। হামিদা বুঝতে পারে জয়নাল আসলে কি বুঝাতে চায়। জয়নালের প্রশংসা করে হামিদা বলে, ভাইসাব আপনি অনেক ভাল মানুষ। পুরুষ মানুষেরা এমন খুব কম হয়। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো আরেকটা বিয়ে করে ফেলতো।

এই ভাল মানুষি প্রশংসায় জয়নাল আর এগুতে পারে না। হামিদার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই শেষ কথাগুলো শুনতে পায় শিলা। ঘরের ভেতর মায়ের পাশে জয়নাল জ্যাঠাকে বসে থাকতে দেখে শিলার খুব রাগ হয়। জ্যাঠার প্রতি মায়ের দরদ দেখে ওর পিত্তি জ্বলে যায়। ওর বড় চোখ কটমট করে তাকানো দেখেই হামিদা টের পায় মেয়ে তার প্রতি অসন্তোষ দেখাচ্ছে। এ সময় ডাক পিওন এসে শিলার খোঁজ নেয়। সামিয়ার চিঠি পেয়ে শিলা অন্য ঘরে চলে যায়। জয়নালও ওঠে পড়ে। সামিয়ার লম্বা চিঠি। চিঠিতে ওর ব্যক্তিগত কথা, মায়ের কথা, শিউলির কথা ও রাজশাহীর অন্য বন্ধুদের কথা কোন কিছুই বাদ নেই। মাকে নিয়ে সাদিয়ার এত কথা বারবার পড়ছে শিলা। শেষ দিকে এসে কবে ভর্তি পরীক্ষা হবে তা জানিয়েছে। সাদিয়া চাইছে শিলা যেন রাজশাহীতেই ভর্তি হয় আর পরীক্ষার আগেই যেন ওদের বাসায় চলে আসে।

সামিয়ার চিঠি পড়ে শিলার খুব ভাল লাগছে। সামিয়ার মায়ের ব্যক্তিগত জীবন, ভালবাসা, সামিয়ার জন্য তার ত্যাগ সবকিছুই খালাম্মার প্রতি তার এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে। সামিয়ার মায়ের ছায়ায় নিজের মাকে দেখার চেষ্টা করে। দীর্ঘ দিন স্বামীর অনুপস্থিতি, যৌবনে নিজেকে অবদমিত রেখে ভালবাসার বঞ্চনা মেনে নিয়ে তার মা যেভাবে তাদের আগলে রেখেছে, সংসারে সকলের সুখের আড়ালে নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছে তা ভেবে মায়ের প্রতি গভীর মমতা বোধ করে।           

ওসমানের অবসর জীবন শুরু হয়। বাড়ি ফিরে আসে। আয়নাল তাকে কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকার পরামর্শ দেয়। নিজেদের বেশ কিছু জমি রয়েছে যেখানে আম বাগান করা যায়। অনেকেই এখন বাগান করে ভাল সুবিধা পাচ্ছে। একটা ছো্ট খামার আর বাগান করে দুই ভাই মিলে চালাতে পারলে মন্দ হয় না। সেভাবেই শুরু। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বিশেষ করে হাফিজ মেম্বর আর জয়নাল এটা চাচ্ছিল না। এতদিন ধরে হাফিজ মেম্বর আর জয়নাল মিলে এই জমিগুলো বর্গা চাষ করেছে। তারাও ভাবছিল জমি ইজারা নিয়ে বড় করে বাগান করবে। জয়নাল বাগান করলে তো আর তা হবে না। হাফিজ মেম্বর জয়নালকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে, বিচার-আচারে ডাকে। ওসমান বেশ সম্মানিত বোধ করে। গ্রামের বাজারে চায়ের আড্ডায় বসায়। লোকজনের সামনে ওসমানের নানা প্রশংসা করে। ওসমান ভাই এতদিন গ্রামের বাইরে ছিল, চাকুরি করেছে এখন সুবেদার হিসেবে অবসরে এসেছে। গ্রামের মানুষের আপদে বিপদে তাকে পাওয়া যাবে। থানার লোকারাও সুবেদার ওসমানের কথা শোনে। হাফিজ মেম্বরের এই প্রশংসা শুনে ওসমানের বেশ গর্ব হয়। হাফিজ বুঝতে পারে, ওসমানকে এবার চেয়ারম্যান নির্বাচনে নামাবার টোপ দিলে খাবে।

পরিকল্পনা করে জয়নাল আর হাফিজ মেম্বর ওসমানকে নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার উদ্যোগ নেয়। চায়ের আড্ডায় আগে থেকে ঠিক করে রাখা কিছু লোককে দিয়ে এই প্রস্তাব উঠায়। ঘর ভর্তি লোকের সামনে মফিজ বলতে থাকে মেম্বর সাব জয়নাল ভাই কি বলেন সুবেদার সাব যদি চেয়ারম্যান ইলেকশন করে আপনেরা সমর্থন দিবেন না। কত বছর হইলো আমরার এলাকায় চেয়ারম্যান নাই, সুবেদার সাবের মতো একজন ভাল মানুষ ইলেকশন করলে আমরাও  তার সাথে আছি। হাফিজ মেম্বর সায় দিয়ে বলে মফিজ তুমি একটা ভাল কথা কইছো, জয়নাল ভাই কি বলো বলেই জয়নালের দিকে তাকায় হাফিজ মেম্বর। জয়নাল গলা চড়িয়ে বলে আমার ভাই চাইলে আমরা তো আছিই। দাদা আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিল, এরপর তো আর বংশে কোন যোগ্য লোক হইলোনা, সুবেদার ওসমান চাইলে সবকিছু নিয়া তার পিছে থাকুম। ওসমান কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ঘরভর্তি লোকেরা বলছে এবার তবে আমরা নাইমা পড়ি। ওসমান সবাইকে নিবৃত করে। দাদা সম্মানী লোক ছিলেন, তিনি মানুষের সেবা করেছেন, সেই তুলনায় আমি কোন যোগ্য লোক নই। আপনারা বরং হাফিজ মেম্বরকেই চেয়ারম্যান নির্বাচন করান।

হাফিজ মেম্বর হেসে বলে সুবেদার সাব একজন ভাল মানুষ বলেই সবাই তাকে চাইলেও তিনি আমাকে সমর্থন করছেন। তার কথা রাখতে আমার কোন আপত্তি নেই, তবে এবার তিনি নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হয়ে পরের বারের জন্য যদি আমাকে তৈরি করেন তখন আমি ভরসা পাবো। সবাই আপনাকে চাইছে, আপনি ভেবে দেখেন। আপনি চাইলে আপনাদের বংশে আবার চেয়ারম্যান আসবে। আপনি ছাড়া তো আর কেউ নেই যার পিছনে নামলে চেয়ারম্যান বানানো যাবে। ওসমান চুপ করে থাকে। পরদিন থেকেই গ্রামে সবার মুখে ওসমানের চেয়ারম্যান প্রার্থী হবার খবর ছড়িয়ে পড়ে। বাড়ি ফিরে রাতে সবাইকে বিষয়টি বলে মতামত চায়। আয়নাল গ্রামের মানুষের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে যায়। ভাইকে নির্বাচন থেকে দুরে রাখতে নির্বাচনের নানা মন্দ দিক নিয়ে কথা বলে আয়নাল। এখন নির্বাচন মানেই হলো টাকার খেলা। জোর জবরদস্তি করার জন্য মাস্তান পোষা, যে জন্য ভাল মানুষেরা আর এসবে নেই। আপনার এসবে সায় দেয়া ঠিক হবেনা বলে জানায় আয়নাল। হামিদা, শিলাও আয়নালের কথায় সমর্থন দেয়। ওসমান বলতে থাকে ভাল মানুষেরা সব ছেড়ে দিলে তো সবকিছুই নষ্টদের দখলে যাবে। গ্রামের মানুষ চাইছে, অন্য গ্রামের লোকেরাও আমায় বেশ ইজ্জত করছে এই সময় সবাইকে বিমুখ করা কি ঠিক হবে?

হামিদা ও শিলা স্পষ্ট করে বলে দেয় ওসমান নির্বাচন করলে ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। নির্বাচনের পক্ষে ওসমানের ওপর সামাজিক চাপ বাড়তে থাকে। পরিবারের সকলের অসম্মতিতে এক মনস্তাত্ত্বিক চাপ অনুভব করে ওসমান। বাড়ি বসে বাগান করা আর খামারের চিন্তা থেকে সরে আসে। বাজারে রড-সিমেন্টের দোকান করার ব্যাপারে হাফিজ মেম্বরের পরামর্শ তার মনে ধরে। গ্রামে রাস্তা-ঘাট হয়েছে, পল্লী বিদ্যুৎ এর সংযোগ আসছে। প্রবাসীদের টাকায় ইমারত উঠছে। সব দেখে শুনে রড-সিমেন্ট আর টিভি-ফ্রিজের বড় দোকান করে। পেনশনের টাকা বিনিয়োগ করে। এভাবে হাফিজ মেম্বর ওসমানের ওপর প্রভাব বাড়াতে থাকে। চলবে