মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ৮

প্রকাশিত : মার্চ ২৩, ২০২১

শিলার পরীক্ষার ফল বেরোয়। বরাবরের মতোই ভাল ফলাফল হয় তার। এখন শুধুই অপেক্ষা কবে শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। শিলাকে বিশ্ববিদ্যালায়ে পড়তে পাঠাতে ওসমানের কোন আগ্রহ নেই। ওসমান চায় ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে। আর যতদিন কোন ভাল বিয়ের ব্যবস্থা না হয় ততদিন এলাকার কলেজেই ভর্তি করে দিতে। এসব নিয়ে শিলার সাথে বাবার মনোমালিন্য হয়। হাফিজ মেম্বর একটা বিয়ের প্রস্তাব আনে। ছেলেটা আই এ পাশ। ইতালীতে থাকে। ভাল আয়-রোজগার। ওখানে আত্মীয়তা করলে নির্বাচনে ভাল সুবিধা পাওয়া যাবে। নির্বাচনের খরচের জন্য জামাইয়ের সহায়তাও পাবে।

হাফিজ মেম্বরের এতসব কথায় ওসমান মনে মনে সম্মত হলেও এই রকম ছেলেকে বিয়ে করতে শিলা রাজি হবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছে না। ওসমান বিষয়টি নিয়ে হামিদা ও শিলার সাথে কথা বলে। শিলা পরিষ্কার বলে দেয়, প্রবাসী কোনো শ্রমিককে সে বিয়ে করবে না। ওসমান জানায় ছেলেটির নিজের ব্যবসা আছে ওখানে। বিয়ের পর বৌকে নিয়ে যাবে। ইউরোপের একটা দেশে ভাল কাজ করে এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি কেন জানতে চায় ওসমান। ক্ষুব্ধ ওসমান হামিদাকে বলে মেয়েকে ভাল করে বোঝাও। ওই ছেলের সাথেই আমি শিলার বিয়ে দিতে চাই। আগামী সপ্তায় ওদের আসতে বলবো। দেখে পছন্দ হলে কথাবার্তা হবে, এই বলে ওসমান বেরিয়ে যায়।

শিলা তার মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তার অমতে বিয়ে দিতে চাইলে সে নিজের পথ বেছে নেবে। হামিদা শিলার এমন কথায় ভয় পেয়ে যায়। রাতে ওসমানকে জেদ না করে মেয়েকে বুঝতে অনুরোধ করে। শিলা একবার ভাবে আত্মহত্যা করে জীবন শেষ করে দিবে। আবার ভাবে জীবন শেষ করে দিবে কেন? জীবনকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়ে তা উপভোগ করার মাঝেই তো আনন্দ। নিজের সাথে যুদ্ধ করে শিলা সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ছেড়ে রাজশাহী চলে যাবার। ভর্তি পরীক্ষার আগে ওদের এখানে চলে গেলে তো বিপদ এড়ানো যাবে। এছাড়া সামিয়ার সাথে এই বিপদের কথা জানাতে পারলে সহায়তাও পাবে। এসব ভেবেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় শিলা।

প্রাথমিকভাবে দুয়েক দিন বিষয়টা গোপন থাকলেও কয়েকদিনের মাঝেই শিলা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে বলে গুঞ্জন শুরু হয়। ব্যবসায় বকেয়ার চাপের পাশাপাশি শিলার বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার চাপ সামলাতে পারেনি ওসমান। হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরদিন সকালে অজ্ঞান অবস্থায় খুলনায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায় গত রাতেই একটা স্ট্রোক হয়। উচ্চ রক্তচাপ আর উচ্চ ডায়াবেটিক রোগী হওয়ায় তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। দু’দিন নিবিড় পরিচর্যায় থাকার পর পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হয়। আয়নাল স্কুল থেকে ছুটি নেয়। দীর্ঘদিন মনের বিরুদ্ধে ভালবাসা বিহীন ওসমানের ঘর করতে করতে কখন যে ওসমানের প্রতি সকল দরদ উবে গেছে তা এই সময়ে এসে ভালভাবে উপলব্ধি করে হামিদা।

স্বামীর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা আর না ফেরার মাঝে তার যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। শুধুই সামাজিকতা রক্ষায় সে হাসপাতালে থাকছে। সজীবকে খবর দেয়া হয়েছে, জানা গেছে সে ছাত্রাবাসে নেই। পর দিন সজীব হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়। চাচার সাথে কথা বলে জানতে পারে তার বাবার সঙ্কটজনক অবস্থার কথা। শিলার কথা জানতে চাইলে আয়নাল বলে ও তো রাজশাহী গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। সজীবের কাছে খবর আছে শিলা বাড়ি ছেড়ে গেছে। কিন্ত কোথায় গেছে তা জানা নেই। লোকমুখে নানা কথা থাকলেও সজীব চাচার কথাই সত্য বলে ধরে নেয়। সজীবের এক বন্ধুর বাড়ি খুলনায়। বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ নেই। এসময় ওদের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে সজীব। হামিদা ও আয়নাল সজীবের বন্ধুর বাড়িতে ওঠে।

সজীবকে দুদিন মায়ের সাথে থাকতে বলে আয়নাল বাড়ি যেতে চায়। টাকা পয়সা জোগার করে আনতে হবে। এর মাঝেই হাসপাতালে একটা বড় অঙ্কের বিল এসেছে। আরও মাসখানেক এভাবে থাকতে গেলে অনেক টাকার দরকার হবে। সজীবকে ওর মায়ের সাথে রেখে বাড়ি যায় আয়নাল। বাড়িতে এসেই শিলার চিঠি পায়। ভর্তি পরীক্ষায় বেশ ভাল করেছে। সকল বিষয়েই ওর ভর্তির সুযোগ থাকলেও ইংরেজী সাহিত্য পড়তে চেয়ে চাচার মতামত জানতে চেয়েছে। আয়নাল উত্তরে জানায় যা ভাল লাগে সেই বিষয়ে পড়ো। তোমার আব্বা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন। চিন্তা করোনা। ভর্তির টাকা পাঠালাম, ভর্তি শেষে ক্লাস শুরু হবার আগে একবার বাড়ি এসো।

সজীবের সাথে রাতের খাবারের পর অনেক কথা হয়। সজীবের ধারনা ওর বাবা আর সুস্থ হয়ে ফিরতে পারবেন না। মাকে নানাভাবে তা সহজে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে সজীব। চাচা অত্যন্ত ভাল মানুষ। সব সময় আমাদের ভাল চেয়েছে। এই যুগে এমন ভাই ক’জনের আছে। আব্বা সেই দিক থেকে অনেক ভাগ্যবান। সারা জীবন চাচা আর দাদার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সজীবের এমন কথা বার্তায় হামিদার কাছে নিজের ছেলেকে কেমন যেন অচেনা লাগে। সেদিনের ছোট্ট সজীব আজ কত বড় হয়ে গেছে। কেমন যেন অভিভাবকের মতো কথা বলেছে। কথা বার্তা শেষ করে হামিদা ঘুমাতে যায়। বিছানায় গড়াগরি করে ঘুম আসে না। ওসমানের আর ফিরে আসার আশা নেই এটা সবাই জেনে গেছে। এবার তবে বৈধব্যের জীবন।

কেমন হবে সে জীবন। ওসমান বেঁচে থাকা অবস্থায়ও ভাসুর-দেবর কাছে আসতে চেয়েছে। এবার তবে কি হবে? ওসমান বেচে থাকতেও অনেক বছর কেটেছে একা। তখন শ্বশুর -শ্বাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। মাথার ওপর ছায়া ছিল। নিরাপত্তা দেয়াল ছিল। এখন তবে কি হবে? শরীর, সম্পদ সবই কি অরক্ষিত হবে? এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে হামিদা। স্বপ্নে আয়নালকে কাছে পায়। দুজনে মিলে লুডু খেলছে। ঘনিষ্ট হচ্ছে। আয়নালের উষ্ণতায় সারা শরীর ভিজে গেছে। আয়নাল নির্ভয়ে নিজেকে মেলে ধরছে। হামিদার শাড়ির আঁচল সরে গেলে উদোম শরীরে আয়নালের স্পর্শ তীব্রতর হয়। হামিদার শরীরে ঝড় ওঠে। সেদিন হয়নি বলে তুমি এমন অভিমান করেছিলে কেন? কেন আমায় বঞ্চিত করেছ? বলো, আর আমায় ছেড়ে থাকবে না।

সকালের রোদ বিছানায় পড়ে। হামিদার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। একটা চনমনে ভাব। অনেক বেলা হয়েছে বুঝেও বিছানা ছেড়ে ওঠতে মন চাইছে না। মনে মনে আয়নালের মাঝে নিজের সুখ অনুভব করে। রাজশাহী ছেড়ে আসার পর তো আয়নালের মাঝে এমন কোন কিছু সে আর অনুভব করেনি। আয়নাল কি তার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে, নাকি অনুকুল পরিবেশের অভাবে আয়নাল নিজেকে সংযত রেখেছে? এসব ভাবতে ভাবতেই দরজায় সজীবের কন্ঠ শোনা যায়। সজীবের ডাকে বিছানা ছেড়ে ওঠে হামিদা। অনেক বেলা হয়েছে। ওঠো, নাশতা করো। অনেক ক্লান্তির পর মা আজ বেলা করে ঘুমাচ্ছে তা বুঝতে পেরে বাইরে থেকে পরোটা, হালুয়া আর নেহারি নিয়ে এসেছে সজীব। হাত-মুখ ধুয়ে তৃপ্তি করে হোটেলের নাশতা খায় হামিদা।

নেহারির স্বাদ তার বেশ ভাল লাগে। কিন্তু নেহারি খেতে খেতে আয়নালের কথা মনে পড়ে। আয়নালেরও যে নেহারি খুব পছন্দের। চলবে