মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ৯

প্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০২১

বাড়ি থেকে সব গুছিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে খুলনায় ফিরে আয়নাল। ভাই এর পাশে থাকার ব্যাপারে তার আন্তরিকতা দেখে সজীব ও হামিদা অনেকটা ভারমুক্ত। শোন সজীব, আমি এক মাস ছুটি নিয়েছি, শিক্ষক সমিতি থেকে এক লাখ টাকা ধারও নিয়েছি। আশা করি অর্থের অভাবে চিকিৎসার কোন সমস্যা হবে না। তোরা কোন চিন্তা করিস না। পারলে এই সময়ে মায়ের কাছে থাকিস। তুমি তো ছুটি নিয়ে এসেছো, এর পরও যদি থাকতে হয় তখন না হয় আমি এসে থাকবো। হামিদাও তাই বলে। সজীবের সামনে পরীক্ষা তাই এই সময়ে ছাত্রাবাসে থাকাই হয়তো ভাল হবে।

সজীব বলে, কিছুদিনে মধ্যেই পরীক্ষা শেষ হবে, তখন আমি খুলনায় চলে আসবো।
হামিদা মনে মনে চাইছে সজীব যেন না থাকে।  রাতে সজীব ও হামিদার সাথে সংসারের নানা বিষয়ে আলাপ করে আয়নাল। সজীব খুব শান্তভাবে সব শুনে বলে, শোন চাচা বিষয় সম্পত্তি নিয়ে মার কোন ভাবনা নেই। এসব তুমিই দেখো। আব্বার কিছু হয়ে গেলে তুমি আমার মাকে দেখে রেখো।
আয়নাল বলে, তোরা এখন বড় হয়েছিস, ধীরে ধীরে তোদেরই তো দায়িত্ব নিতে হবে। আর একটা বছর পরেই তো তোর ডিপ্লোমা হয়ে যাবে। চাকরি না করে বাবার ব্যবসাটা যদি দেখিস, তবেই তো এসব নিয়ে আর কোন দুশ্চিন্তা থাকেনা। আর যদি চাকরি করতে চাস তবে মাকেও সাথে নিয়ে যাবি। আমি সংসার বিবাগী মানুষ, সারাদিন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তাই তোদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তোর বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তবে তোর মাকে নিয়ে আমায় জড়িয়ে নানা কথা যে গ্রামের মানুষ বলবে না, এটা কিন্তু বলা যায় না। গ্রামের মানুষ এত সহজ নয়, তাদের অনেকেই আমাদের ভাল দেখতে চায় না। তোর আব্বাকে নানা কিছু বুঝিয়ে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেবার টোপ দিয়ে আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করেছে। তার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত করে তাকে আর্থিক ভাবে দুর্বল করতেই নির্বাচনে তাকে নামাবার ষড়যন্ত্র করছে হাফিজ মেম্বর আর তোর জয়নাল জ্যাঠা।

সজীব সব কিছু বুঝতে পারে। কিন্ত তার তো এসব কিছুতে থাকার ইচ্ছে নেই। সে তো বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। সর্বহারা গরিবের মুক্তি নিয়ে ভাবে। সে তো এসব বিলাসি জীবন চায় না। পার্টির সহযোদ্ধাদের কাছে জেনেছে গ্রামের এসব কায়েমি স্বার্থবাদীদের কথা। কোথাও কোথাও পার্টির নির্দেশে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বেশ কিছু জুলুমকারীদের চরম শাস্তি হয়েছে। অত্যাচারীদের লাশ রাস্তায় পরে থাকতে দেখে অনেকেই স্বস্তি পেয়েছে। চাচার কথা থেকেও তাদের নিজ গ্রামে একই ধরনের মানুষের কথা জানতে পারে। মনে মনে ভাবে তার পরিবারের প্রতি যদি এমন অন্যায় আচরণ হয় তবে নিজেই সে ব্যবস্থা নিবে। কিন্ত দলের ভেতর এ নিয়ে অন্যদের সাথে তার মতবিরোধ আছে। তার মনে হয়, এটা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। দুয়েকজনকে এমন চরম শাস্তি দিয়ে এভাবে সরিয়ে দিলে সাময়িকভাবে হয়তো কিছুদিন সাধারণ মানুষ রেহাই পায়, কিন্ত কিছুদিনের মাঝেই নতুন অত্যাচারী তৈরি হয়ে হয়ে যায়। এছাড়া এরকম শাস্তির ফলে নিরপরাধ হয়েও পরিবারের সদস্যদের ভোগান্তি হয়। শুধু তাই নয়, অনেক সময় খুনের মামলায় সন্দেহের তালিকায় যাদের হেনস্তার শিকার হতে হয়, সেসব পরিবারের ভোগান্তির বিষয়টা বিবেচনায় না আনা নিয়েও পার্টিতে তার ভিন্নমত আছে। কিন্ত পার্টিতে গণতান্ত্রিকভাবে যে সিদ্ধান্ত হয় সেখানে তার বিরোধিতা করা কোন বিপ্লবীর কাজ নয় ভেবে সব কিছুই মেনে নেয় সজীব। চাচার সাথে কথা বলে আজ মনে হচ্ছে তাদের সহযোদ্ধাদের অবস্থান হয়তো ঠিকই আছে। সংসারের এমন পরিস্থিতিতে সজীবের মাঝে দ্বিধা কাজ করে। তবে কি সে পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হবার চিন্তা থেকে দূরে সরে আসবে?

মুহূর্তেই এসব ভাবনা থেকে ফিরে সজীব বলে, চাচা তুমি আমাদের অভিভাবক। সারাজীবন যেভাবে আগলে রেখেছ বাকী জীবনেও তা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকবে।

পরদিন সবাই মিলে হাসপাতালে আসে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে সজীব যশোরে ফিরে যেতে চাচার অনুমতি চায়। আয়নাল সজীবকে বলে, যাবার আগে মাকে বাসায় রেখে যাস, আমি হাসপাতালে আছি।
হামিদা বাধা দিয়ে বলে, আমি এখন বাসায় ফিরে গিয়ে কি করবো, আমিও থাকি হাসপাতালে। এরপর সজীব বিদায় নিয়ে চলে যায় যশোর। হামিদা ও আয়নাল দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে হামিদা বলে, আমাকে একা বাসায় পাঠিয়ে দিতে চাইছিলে কেন?
আসলে এখানে তো এমন কোন কাজ নেই, তাই ভাবলাম তুমি বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করো। তোমার বুঝি বিশ্রামের দরকার নেই। এখানে যেহেতু থাকার দরকার নেই তবে চল দুজনেই বাসায় চলে যাই। আয়নাল হামিদাকে অনুসরণ করে বাইরে আসে। হাসপাতালের গেট থেকেই রিক্সা নিয়ে বাসায় যায়। সারাপথ  রিক্সায় চুপ করে নিস্প্রাণ বসেছিল আয়নাল। হামিদাও কোন কথা বলেনি। ভেতরে ভেতরে নানা কিছু ভেবে চলেছে। আয়নালকে কি আর কাছে পাবে না। এত কাছে পেয়েও কি আয়নাল নিস্পৃহ থাকবে? হামিদা তো আয়নালকে মন থেকে দূরে সরাতে পারেনি। রাজশাহীর যন্ত্রণামিশ্রিত ভাল লাগার স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারেনি হামিদা। সেই আকাঙ্ক্ষা কেবল তীব্রই হয়েছে কিন্ত তার ইচ্ছে পূরণ হয়নি। ভাইজির সাথে ঝোঁকের মাথায় জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা চরম আনন্দময় হয়ে উঠলেও পরবর্তী সময়ে তা আয়নালকে দারুণভাবে বিপর্যস্ত করে। নিজেকে সংযত রাখতে না পারার ক্ষত যে আজও তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কত দিন যে সে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে আর অনিদ্রায় কেটেছে কত রাত তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আয়নালের। চরম আনন্দ যে এভাবে বিষাদে জীবন ভরিয়ে তুলতে পারে, তা আয়নালের কল্পনারও অতীত ছিল। এরপর থেকে আয়নাল কেমন যেন শিথিল ও নিস্পৃহ হয়ে পড়ে।

এক সময় হামিদা ভাবীর সান্নিধ্য পেতে দারুণ আগ্রহী হয়ে উঠলেও সেদিনের পর থেকে তার মন যেন আর প্রেমময় হয়ে ওঠে না। হামিদাকে গভীরভাবে পান করার যে তৃষ্ণা আয়নালের ভেতর দীর্ঘদিন জমে ছিল তা যেন কেমন নিস্তেজ, অসার হয়ে পড়ে। আজ হামিদাকে স্পষ্ট পড়তে পারলেও আয়নাল আর কোনভাবেই কাছে যেতে চাইছে না। ভাইয়ের অসুস্থতার এই সুযোগে এরকম কিছু করা নিয়েও তার ভেতর দ্বিধা কাজ করে। আয়নালের এমন পরিবর্তন হামিদার চোখ এড়াতে পারে না। কিন্তু এ নিয়ে হামিদার কোন অভিমান নেই। গত রাতেই আয়নালকে নিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখেছে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া যে হামিদা বড়ই অস্থির হয়ে উঠছে। এই অস্থিরতা নিয়েই কাটে দুই দিন। আয়নালও কেমন যেন ওসমানের মতোই সংসারের গল্প করছে। সংসার ছাড়া কি নারীর জীবনে আর কিছু থাকতে নেই। জীবনের ভাল লাগার অনুভূতিগুলোকে নিস্পেষিত করে ক্রমাগত ভালবাসাহীন থেকে কতটা মনোযোগ নিয়ে সংসারে কাজে আসতে পারে তা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছে হামিদা। অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে সংসার করতে করতে ক্লান্ত হয়েই তো হামিদা একরকম জোর করেই বাড়ি ছেড়ে ওসমানের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু ওসমান কখনোই তা বুঝতেই পারেনি। ওসমানের কাছে অবজ্ঞা পায়নি তবে উষ্ণতাও পায়নি।

মাঝে মাঝে মনে হতো, হয়তো ওসমানকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতাই সে হারিয়েছে। কিন্তু আয়নালের সংস্পর্শেই তো হামিদা প্রাণ পেয়েছে। যে আয়নাল নিস্প্রাণ হামিদার জীবনে প্রাণের জোয়ার এনে দিয়েছিল সে কেন হঠাৎ এমন রহস্যজনক হয়ে উঠছে। এই রহস্যের জাল ভেদ করেই আয়নালকে সহজ করতে হবে। চলবে