মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ১০

প্রকাশিত : মার্চ ২৫, ২০২১

আয়নাল পরদিন একাই হাসপতালে যায়। হামিদা বাসায় থেকে রান্নবান্না আর ঘর গোছানোর কাজ করে। পছন্দের সব খাবার রান্না করে। ঘন দুধের মালাই চা এর ব্যবস্থাও করে। দুপুরে বাসায় ফিরে আসে আয়নাল। দ্রুত স্নান সেরে খেতে আসার তাড়া দেয় হামিদা। স্নান সেরে বের হয়ে খালি গায়ে বারান্দায় ভেজা কাপড় নাড়তে যায় আয়নাল। দূর থেকে হামিদা আয়নালের প্রশস্ত রোমশ উন্নত বুক থেকে চোখ ফেরাতে পারেনা। কল্পনায় এই বুকে মুখ রাখে। চুমু খায়। আবেগে ভাসে। আয়নাল খেতে বসলে গভীর মমতায় একটার পর একটা পদ তুলে দিয়ে যত্ন করে খাওয়ায়। অনেকটা জোর করেই খায় আয়নাল। অনেক দিন পর এত বেশি খেয়ে তার বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করছে। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে।

হামিদার স্পর্শ অনুভব করে। উষ্ণতায় বরফ গলতে থাকে। হামিদাকে স্বপ্ন দেখে পড়ন্ত বিকেলে ঘুম ভাঙে আয়নালের। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। এরপর নিজেকে গুছিয়ে স্নানঘরে ঢুকে। আয়নালের ঘুম ভেঙেছে টের পেয়ে হামিদা রান্নাঘরে ঢুকে। চায়ের পানি গরম করতে দেয়। আয়নাল হাত মুখ ধুয়ে বের হতেই ধুমায়িত মালাই চা দেখে। হামিদার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। হামিদা আয়নালের চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখে মনে মনে বেশ খুশি হয়। আজ হামিদাও মালাই চা নিয়েছে। চা খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে আয়নাল। হামিদা আয়নালের পেছনে এসে দাঁড়ায়। আয়নাল টের পায় না। হামিদা ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে পিঠের ওপর স্তনের পরশ দেয়।

আয়নালকে নিথর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হামিদা বলে, কি দেখছো এমন করে? পাশে এসে দাঁড়ালাম সেই কখন, মনে হয় টেরই পাচ্ছ না।
আয়নাল বলে, এভাবেই প্রতিটা দিন চলে যায়, জীবনও নিঃশেষ হয়ে আসে, তা-ই ভাবছিলাম। প্রতিদিন তো ভোর হয়, নতুন আলো নিয়ে সূর্য আবার জীবনের বার্তা নিয়ে আসে। জীবনকে ভালবাসতে, উপভোগ করতে শেখায় তা তোমায় টানে না বুঝি?
টানে তো অবশ্যই, গভীরভাবেই টানে। কিন্ত জীবন কেমন যেন জটিল হয়ে ওঠে। জীবনকে সহজ করে ভাবতে পারলেই একে আনন্দময় আর উপভোগ্য লাগবে। তাই বলছি জটিল করে না ভেবে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নাও। এতকিছুর মাঝেওতো আমি সব কিছুই সহজভাবে নেবার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি ভাল থাকবার। কিন্তু তুমিও যদি এমন করে নিজেকে গুটিয়ে রাখো তবে কিভাবে আর ভাল থাকবো বলো।

আয়নাল চুপ করে থাকে। হামিদা আরও ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। পেছন থেকে আয়নালের কাধে থুতনি রেখে গাছে জড়িয়ে থাকা লতার মতো কোমর থেকে পেট পর্যন্ত জড়িয়ে থাকে। হামিদার উষ্ণতা পায় আয়নাল। কিছুক্ষণ আগে যা স্বপ্নে ছিল এখন তা বাস্তব। হামিদা আয়নালকে সহজ করতে চাইলেও আয়নালের আড়ষ্টতা টের পায়। আয়নালকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে হামিদা। গোধূলির লাল আভা বিলীন হয়। অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বারান্দা ছেড়ে আয়নালও ঘরে ঢুকে। হামিদার ছোঁয়ায় আয়নাল উদ্দীপ্ত। কিন্তু ভাইয়ের জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে এমন কোনো আচরণ সে করতে চায় না যা নিয়ে পরবর্তীতে তাকে কথা শুনতে হয়।

আয়নাল ভেবেছে, ভাবী যদি কোনোভাবে মনে করে এমন সঙ্কটের সময় সে সুযোগ নিতে চাইছে। এসব সাতপাঁচ ভেবে নিজেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। আয়নালের ঘরে ঝকঝকে আলো, হামিদার ওখানে নীলাভ আবছা আলো। দূর থেকে কিছুই দেখা যায় না। হামিদা কি নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। এসব ভাবতে ভাবতে হামিদার ঘরে উঁকি দেয় আয়নাল। কোনো শব্দ না পেয়ে ঘরে ঢুকে। হামিদা শুয়ে আছে। আয়নালের উপস্থিতি টের পায়। চুপ করে থেকে আয়নালকে লক্ষ্য করে। আয়নাল কি তবে পাশে আসবে। ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা অনুভব করে হামিদা। কিন্তু না, আয়নাল ফিরে যায়। আয়নাল ভাবে, ভাবী মনে হয় অনেক ক্লান্ত, তার বিশ্রাম দরকার। আয়নালের ওপর অভিমান হয়।

বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না হামিদার। খাবার সময় হয়ে গেছে সেই কখন তাও তো ভাবীর কোনো খবর নেই। না খেয়েই শুয়ে পড়ে আয়নাল। পাশের ঘরে আলো নিভে গেলে হামিদা টের পায় আয়নাল মনে হয় শুয়ে পড়েছে। বেচারা কি না খেয়েই শুয়ে পড়লো, এই ভেবে বিছানা ছেড়ে আয়নালের ঘরে যায় হামিদা। গায়ে হাত রেখে ঝাঁকুনি দেয়। আয়নাল পাশ ফিরে তাকায়। কি ব্যপার, না খেয়েই শুয়ে পড়লে? আয়নাল আস্তে করে বলে তোমাকে ছেড়ে খাব? তাইতো, কত নজর রাখো তুমি আমার, হামিদার গলায় অভিমানের সুর। বিছানায় বসে হাত ধরে। খাবে ওঠো। খেয়ে ঘুমাও। হামিদার হাত চেপে ধরে আয়নাল। নিশ্চুপ থেকে তা উপভোগ করে হামিদা। ঘনিষ্ট হয়। আয়নালও সাড়া দেয়। হামিদা কিছুটা ঝুঁকে  আয়নালের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করে। আরও ঘনিষ্ট হয়। আয়নালও কাছে টানে হামিদাকে। কোনো কথা নয়। দুজনেই পরস্পরের নিঃশ্বাসে গভীর ভালবাসা অনুভব করে।

গভীর আলিঙ্গনে সমুদ্রের গর্জন। ফেনিল ঢেউয়ে ভাসে। জীবনের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। মনের ভেতর জমে থাকা কালো মেঘ ঘরের অন্ধকারে বিলীন হয়। পরস্পরের ভালবাসায় তাদের মাঝের কাচের দেয়াল ভেঙে পড়ে। সারাক্ষণ আয়নালকে ঘিরে থাকতে চায় হামিদা। এই সঙ্কটে এমন সুখ পেতে পেতে পারে তা হামিদার কল্পনারও অতীত ছিল। জীবনের দীর্ঘ বঞ্চনার পর হামিদার জীবনে যেন সুখের পায়রা ধরা দেয়। হামিদাকে ঘিরে মনের ভেতর যে যুদ্ধ চলছিল তার আপাত অবসান হলেও এই সুখের স্বল্প স্থায়িত্বের কথা বিবেচনায় বিচলিত আয়নাল।

পরদিন হাসপাতালে গিয়ে ভাল সংবাদ পায় আয়নাল। ডাক্তার খবর দেয় ওসমানের অবস্থার উন্নতি হয়েছে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হবে। দু’দিন পর্যবেক্ষণের পর অবস্থার উন্নতি হলে ওয়ার্ডে পাঠানো হবে। খুশি হয়ে বাসায় ফিরে আসে আয়নাল। হামিদার সাথে খুব সহজ হয়ে ওঠে। দ্বিধাহীন এমন যৌথ যাপনে আয়নাল ও হামিদা দুজনেই অভ্যস্ত হয়ে জীবনের নতুন অর্থ  খুঁজে পায়। ভেতরে জমে থাকা না বলা কথা খোলামেলাভাবে বলতে পেরে বেশ হালকা বোধ করে। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখায় দীর্ঘদিন এমন অপার আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকায় অনুশোচনাও হয়। হামিদা বেশ স্পষ্ট করেই বলে দেয় আয়নাল যেন আর তাকে বঞ্চিত না করে। বাড়ি ফিরে গিয়েই যেন অচেনা না হয়ে যায়। আয়নাল চুপ করে থাকে। হামিদা আয়নালকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। আয়নালও সমস্ত উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে হামিদাকে জীবনের নিত্যদিনের অংশ করে রাখার কথা জানিয়ে দেয়।

এক সপ্তাহের মাঝেই ওসমান হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। ওসমানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসে হামিদা ও আয়নাল। চলবে