মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ১১

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২১

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দিনগুলো অন্য বন্ধুদের মতো শিলার কাছে এত রঙিন ছিল না। বাড়ি ছেড়ে এসে নিজের মতো করে চলতে গিয়ে তার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। হলে কিংবা বিভাগে ডাকপিওন এসে যখন বন্ধুদের হাতে মানি-অর্ডার এর টাকা তুলে দিয়েছে তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। কিন্ত কারো ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেই নিজের জীবন চালিয়ে নিতে পারছে ভেবে পরক্ষণেই মন ভাল হয়ে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মুক্ত জীবনে শিলা নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। হলে সিট বরাদ্দ না পাওয়া আর ছাত্র পড়াবার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে সাংগঠনিক কাজে বেশি সময় দিতে পারেনা শিলা।

নিজেদের বাসা থেকে আসতে পারে বলে শিউলি, সামিয়াদের হলে থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু বাসায় থেকে নিজের চলাফেরার স্বাধীনতা শিলার চেয়ে অনেক কম বলে সামিয়া, শিউলিদের আফসোস হয়। ওরাও হলে থাকতে চায়। দুবছর হয়ে গেলেও হলে সিট বরাদ্দ পায়নি ওরা অথচ ছাত্র রাজনীতির সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তারা ঠিকই হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। শিলাকেও নেতা নেত্রীরা হলে থাকার কথা বলেছে যদিও সেখানে প্রকারান্তরে তাদের দলের সাথে থাকার বিষয় আছে, সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নেবার বিষয় আছে। শুধু হলে থাকবার সুযোগের জন্য কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার রুচি তার নেই।

এসব দেখে শিলা রাজনীতির প্রতি কিছুটা বীতশ্রদ্ধ। শিলার সহপাঠী ও বন্ধুদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার পার্থক্যের ফলে সকলেই শিলাকে নিজেদের সংগঠনে কিংবা তাদের সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত হতে উদবুদ্ধ করে। শিলা সবার কথাই শোনে কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা তার কি করা উচিত। এর মাঝেই শিউলি তার ছেলে বন্ধু শিশিরের সাথে উত্তরণ সংস্কৃতি সংসদের সাথে যুক্ত হয়। শিউলির গানের গলা ভাল কিন্তু কখনোই কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়নি। এই প্রথম শিশিরের জন্য সে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হয়। প্রথমে তার কিছুটা অস্বস্তি থাকলেও সকলের আন্তরিকতায় ওর তা ভাল লাগে।

শিউলির অনুরোধেই সামিয়া আর শিলা একদিন ওদের অনুষ্ঠানের মহড়া দেখতে যায়। মহড়ায় এসে ওদের কাজের পরিবেশ আর পারস্পরিক সহযোগিতার ধরন দেখে সামিয়া আর শিলা বেশ প্রাণিত হয়। এক পর্যায়ে সমবেত সঙ্গীত শুরু হলে সামিয়া আর শিলাও সকলের সাথে মিলে ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা গেয়ে ওঠে। এরপর সবাই মিলে মহড়ার বিরতিতে চা-সিঙ্গারা খায়। মহড়া পুনরায় শুরু হবার আগে শিউলি শিলাকে একটা আবৃত্তির অনুরোধ জানায়। শিউলির অনুরোধ উপেক্ষা করলে সবার কাছে শিউলি ছোট হয়ে যেতে পারে ভেবে শিলা আবৃত্তির করে, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরানো শকুন।‘

সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে। তুমুল হাত তালিতে শিলার মনে আনন্দ ঢেউ খেলে যায়। উত্তরণ এর সভাপতি শিউলিকে তাদের অনুষ্ঠানের দিন এই আবৃতিটি করবার অনুরোধ জানায়। তিনি আরও বলেন, এই আবৃত্তিরর জন্য তাকে মহড়ায় আসতে হবে, এমনও নয়। শুধু অনুষ্ঠানের আগে দুয়েকদিন এলেই চলবে। তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে শিলার পক্ষে এই আহ্বান উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এভাবেই শিলা আর সামিয়াও উত্তরণ এর কর্মসূচিতে অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে শিলার আবৃতি দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। রাতারাতি ক্যম্পাসে শিলার পরিচিতি বেড়ে যায়। অনেকেই শিলাকে তাদের  অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করার অনুরোধ করে।

শিলাও কয়েকটা অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে। এরপর উদীচীর ইতিহাস কথা কও নাটকে অংশ নিলে তার অভিনয় প্রতিভাও নাট্যানুরাগীদের নজরে আসে। স্বৈরাচার প্রতিরোধের রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে মনের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে শিলা। ক্যাম্পাসে দায়িত্বরত গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে শিলার নাম সেনানিবাসে চলে যায়। শিলার অজান্তেই  তাই তার চলাফেরা গোয়েন্দা নজরে আসে। একদিন পড়াতে গেলে তার ছাত্রীর বাবা মেজর সাহেব শিলার সাথে কথা বলেন। শিলা কিছুই বুঝতে পারে না। মেজর সাহেব তার বিরুদ্ধে আনীত গোয়েন্দা অভিযোগ সম্পর্কে শিলাকে অবহিত করে জানায়, এই আন্দোলন থেকে সরে না এলে শিলা যেন আর ক্যন্টনমেন্টে না আসেন।

শিলার ছাত্রী পড়াবার কাজটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ে শিলা। কোন রাজনৈতিক দলের না হয়েও শিলা গণতন্ত্রের পক্ষে, তাই শুধুই একটা টিওশনির কাজ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কোন আপস করতে প্রস্তুত ছিল না শিলা। কিন্তু এই ধাক্কা কিভাবে সামলে উঠবে সে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় শিলা। বাসার মধ্য নিজেকে আটকে রাখে। ক্যাম্পাসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ক্যাম্পাসে এখন শুধুই মিছিল, সমাবেশ। ক্লাসেও উপস্থিতি কম। বলতে গেলে ক্লাস অঘোষিত বন্ধ। শিক্ষক সমিতিও আন্দোলনে যোগ দেয়। শিলা লক্ষ্য করে এই আন্দোলন এখন আর ছাত্রদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। আন্দোলনে শ্রমিক, পেশাজীবীরাও যুক্ত হচ্ছে। এবার হয়তো স্বৈরাচারের বিদায় হবে কিন্ত স্বৈরতন্ত্র বিদায় হবে তো?

এসব নিয়ে তার চিন্তা হয়। রাজনীতির ভাবনায় এভাবে জড়িয়ে পড়ায় নিজে নিজেই হেসে ওঠে। শিলাকে ক্যাম্পাসে দেখতে না পেয়ে সামিয়া ভাবে শিলা অসুস্থ নয়তো? হঠাৎ ক্যাম্পাসে আসা বন্ধ করে দিল কেন? সামিয়া তাই শিউলিকে সাথে নিয়ে শিলার কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত শিউলিকে না পেয়ে একাই শিলার ওখানে যায়। সামিয়া এর আগেও শিলার কাছে গিয়েছে কিন্ত সবসময় তা শিলার সাথেই। এবারই প্রথম একা শিলার কাছে এসেছে। বেশ ক’দিন তোকে ক্যাম্পাসে না দেখে ভাবলাম অসুস্থ কিনা, এজন্য দেখতে এলাম। শিলা একটু গম্ভীর হয়ে বলে অসুস্থ হলে আমাকে দেখার যে কেউ আছে তা বুঝলাম।

সামিয়া বলে, এসে তো দেখলাম দিব্যি ভাল আছিস, তা ক্যাম্পাসে যাচ্ছিস না কেন?
ক্লাস হয় না তাই যাই না।
সামিয়া হেসে বলে, আড্ডা তো হয়। ক্লাস নেই তো চুটিয়ে আড্ডা দেব। ক্যাম্পাসময় ঘুরে বেড়াব। ক্যাম্পাসে আসার নাম করে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াব। পদ্মার চরে গিয়ে মাস্তি করবো। চল পদ্মায় ঘুরে আসি। আজ তো তোর টিওশন নেই।
শিলা বলে, তো শিউলিকে নিয়ে আসতি। এখন ওকে ছাড়া গেলে পরে কথা শুনিয়ে দেবে, যা ঠোঁটকাটা ও।
সামিয়া বলে, ও যখন শিশিরকে নিয়ে পদ্মার চরে যায় তখন কি আমাদের সাথে নেয়? ওর শিশির আছে, আর আমার আছিস তুই। চল যাই। দুজনে মিলে পদ্মায় যায়। ফেরি ঘাটে ওপার থেকে নৌকা এসে ভিড়ে। হরেক রকম যাত্রীদের ওঠানামা দেখে ওরা। চল ওপারে ঘুরে আসি বলেই শিলাকে টেনে নৌকায় উঠায় সামিয়া।

পড়ন্ত দুপুরে মিষ্টি রোদ ভালোই লাগে শিলার। চরে পৌঁছে সামিয়া আর শিলা হাঁটতে থাকে। খুব একটা মানুষজন চোখে পড়ে না। দূরে কিছু গরু চড়তে দেখা যায়। হাতে হাত রেখে হেঁটে চলে ওরা। সামিয়া শিলাকে বলে, তোকে আমার খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হয়, ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছে করে। সামিয়াকে শিলার কেমন যেন সন্দেহ হয়। ও আসলে কি বলতে চাইছে। ওকি হোমোসেক্সচুয়াল? মাঝে মাঝে ও যেভাবে জড়িয়ে ধরে আর চুমু খায় তাতে শিলার কেমন যেন লাগে। ও তো দেখতে বেশ সুন্দর, অনেক ছেলেরাইতো ওর প্রেমে পড়ে। ওকে ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে পেতে চায়। কাউকেইতো ও কাছে টানেনি। শিলার মাধ্যমেও অনেক বন্ধুরা সামিয়াকে ভাল লাগার কথা জানিয়েছে কিন্ত তাতে সামিয়ার কখনোই কোন আগ্রহ দেখেনি শিলা।

আজ ওর এমন কথায় অতীতে ছেলেদের প্রতি সামিয়ার অনাগ্রহের বিষয়টি শিলার কাছে যেন নতুনভাবে ধরা দিচ্ছে, নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু সামিয়াকে তা জিজ্ঞেস করতে কোনভাবেই মন সায় দিচ্ছে না শিলার। কিছু দূর হেটে এসে দুর্বা ঘাষের সবুজ গালিচায় বসে দুজন। সামিয়া বেশ ঘনিষ্টভাবে বসে শিলার হাতে হাত রাখে। শিলা পরিস্থিতি ঘুরাতে গিয়ে ওর টিওশন হারাবার কথাটা সামিয়াকে জানায়। কাজ হারিয়ে আর্থিক সঙ্কটে পড়া নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানায়। এতদিন বাড়ি থেকে টাকা না এনে হঠাৎ টাকা চেয়ে বাড়িতে চিঠি পাঠাতেও যে তার সঙ্কোচ হচ্ছে সেকথাও বলে। এ নিয়ে কোন চিন্তা করিস না ডার্লিং, আমি তোর জন্য কোন একটা ব্যবস্থা করেই ফেলবো। গভীর আন্তরিকতায় ওকে কাছে টানে সামিয়া।

জড়িয়ে ধরে বলে মন খারাপ করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে বলেই আলতো করে চুমু খায়। শিলা কিছুই বলতে পারছে না। কেমন যেন অন্যরকম লাগছে তার। পদ্মার জলে সুর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, চল উঠি। রাতে বাসায় ফিরে শুধু সামিয়ার কথাই ভাবতে থাকে শিলা। মায়ের প্রতি ওর বাবার নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণে বাবার প্রতিই শুধু নয় পুরুষের প্রতিই ওর ঘৃনা জন্মে যায়। কিন্ত্ মায়ের কাছে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বন্ধুর সম্পর্কে জেনে, তার সাথে কথা বলে সামিয়ার এই ঘৃণাবোধ কমে এলেও তা মিলিয়ে যায়নি। ওর মায়ের প্রেমিক যে আজন্ম অকৃতদার থেকেছেন তা জেনেও পুরুষের প্রতি সামিয়ার নেতিবাচক মনোভাবকে শিলার পছন্দ নয়। চলবে