মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ১২

প্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২১

সামিয়া ক্যাম্পাসে এসে লাইব্রেরির সামনে অপেক্ষা করছিল। দূর থেকেই শিলা তা দেখতে পায়। এই, তুই দেরি করলি কেন? আমি তো তোর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।
আহারে কি এমন অপেক্ষা, মাত্র তো পাঁচ মিনিট। এসে ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম নতুন প্রাধ্যক্ষকে দেখা করতে। হলে একটা সিট বরাদ্দ হয় কিনা জানতে, আর গিয়েই শুনলাম আমার সিট বরাদ্দ হয়ে গেছে, দ্রুতই যেন হলে উঠে যাই। দেরিতে হলেও হলে থাকার সুযোগ হলো জেনে বেশ ভাল লাগলো। আগামী মাস থেকে আর বাড়ি ভাড়া লাগবে না।

সামিয়া বলে, তবে তো আজ দুপুরে তুই আমাদের ক্যাফেটারিয়াতে খাওয়াবি। চল তবে শিউলিকে নিয়ে আসি।
বিভাগে, সেমিনার লাইব্রেরিতে ওকে খুঁজে না পেয়ে ওরা শিউলিদের বাসায় যায়। দুদিন পরেই সামিয়ার জন্মদিন। সবাইকে বাসায় আসতে বলে। শিউলিকে খুব একটা প্রাণবন্ত মনে হয়নি। কিছুক্ষণ কথা বলেই ওরা বুঝতে পারে শিশিরের সাথে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সামিয়া বলে, তোর মতো একজন মানুষের সাথে যদি কেউ ঝামেলা করে তাকে কখনোই ভালো মানুষ বলা যাবেনা, আর তার জন্য তোর মন খারাপ করারও কিছু নেই। কালই আমাদের বাসায় চলে আয়। আমার জন্মদিনে বাসায় মাস্তি হবে। একটা ব্ল্যাক লেভেল জোগাড় করেছি। রাতে খাব।

শিউলি এর আগেও দুয়েকবার খেয়েছে। ব্ল্যাক লেভেলের কথা শুনেই তার মন ভালো হয়ে যায়। শিলাও ভেতরে ভেতরে একরকম উত্তেজনা অনুভব করে। জীবনে প্রথম এমন একটা সুযোগ হবে হুইস্কির স্বাদ নেবার, এতে কেমন অনুভূতি হয়, তা পরখ করার। শিলা তাই আগের দিনই সামিয়াদের বাসায় চলে আসে। শিউলির ইচ্ছে থাকলেও সেদিন ও আসতে পারেনি। রাতের খাবারের পর মায়ের সাথে গল্প করে সামিয়ার ঘরে চলে যায় ওরা। কিছুক্ষণ পর বোতল বের করে সামিয়া। দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালে। জল মেশায়। শিলা চেয়ে চেয়ে দেখে। ওর খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে আবার ভয়ও হচ্ছে যদি সামলাতে না পারে।

সামিয়া শিলার হাতে হুইস্কির গ্লাস তুলে দেয়। নিজের গ্লাস শিলার গ্লাসে ঠেকিয়ে চিয়ার্স বলে চুমুক দেয়। শিলা গ্লাস হাতে সামিয়ার দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে। সামিয়া শিলাকে বলে, কোনো ভয় নেই, গলায় ঢেলে দে প্রিয়। শিলা সামিয়াকে অনুসরণ করে। এক তেতো স্বাদ পায়। ওর কেমন যেন পেট গুলিয়ে আসে, মনে হয় বমি হয়ে যাবে। কিন্তু শিলা থামতে চায় না। একরকম জোর করেই চুমুকে গ্লাস উজাড় করে দেয়। সামিয়া আবার ঢালে। ধীরে ধীরে খায়। শিলা কেমন যেন একটা ঝিমুনি অনুভব করে। সামিয়া আবারও ঢেলে নেয়, গোল্ড লিফের লাল প্যাকেট বের করে। সিগারেট ধরায়। শিলাকেও এগিয়ে দেয়। শিলা নেয় না। সামিয়া নিজের টানা সিগারেট শিলার ঠোঁটে চেপে ধরে বলে, টান তো ডার্লিং।

শিলাও টান দেয়। ওর চোখের কোণে জল বেরিয়ে আসে। সামিয়াকে সিগারেট ফিরিয়ে দেয় শিলা। সামিয়া সিগারেট শেষ করে আবার গ্লাসে নেয়। শিলা বিছানায় শুয়ে পরে। ওর শরীরজুড়ে একটা চনমনে ভাব। সারা শরীর যেন টলছে। ঘুম আসে না। সামিয়া বোতলটা আলমিরাতে রেখে বিছানায় আসে। শিলার পাশে শোয়। শিলার গায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, কেমন লাগছে প্রিয়?

মাথা ভারি হয়ে আসছে, শরীর যেন টলছে। কিছুক্ষণের মাঝেই শিলা ঘুমিয়ে পড়ে। সামিয়ার শিলাকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করছে। ওর শরীরে হাত বুলাচ্ছে, চুমু খাচ্ছে কিন্ত শিলার কোনো সাড়া নেই। সামিয়ার হ্যংওভার কেটে যায়। পরদিন সন্ধ্যায় শিউলি আসে। রাতে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে সামিয়ার ঘরে যায় ওরা। আধ-খাওয়া হুইস্কির বোতল বের করে। তিনজনেই খায়। শিলা আজ অনেকটা সহজ। কিন্তু ও খুব বেশি খায়নি। সামিয়া আর শিউলি বোতল শেষ করে। দুজনেই বেশ টালমাটাল। শিউলি গলা জড়ানো কণ্ঠে  বলতে থাকে, সামিয়া মাই ডিয়ার, আই লাভ ইউ, ফাকিং শিশির... শিলা ঘুম ঘুম চোখেই তা শুনছে।

সামিয়া শিউলিকে জড়িয়ে ধরে বলছে, তাই নাকি, ইউ ওয়ানা ফাক মি ডিয়ার, বলেই হেসে উঠে। শিশির আমায় ঠকিয়েছে, ফাকিং শিশির। সামিয়া শিউলিকে জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে কথা বলে। শিলা কিছুই শুনতে পায় না। কিছুক্ষণ পর শিলা মেঝেতে ওদের গড়াগড়ি দেখে। অন্ধকারেই দুটো শরীরের যুগল ছায়া দেখতে পায়।  

ক্যাম্পাসে এখন শুধুই মিছিল, সমাবেশ। ক্লাস পরীক্ষার বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলছে না। এর মাঝেও ওরা ক্যাম্পাসে যায়। লাইব্রেরি চত্তরে বসে। মিছিলে তারুণ্যের ঢেউ দেখে। শিলার ইচ্ছে হয়, মিছিলে যোগ দিতে। কিন্তু তা আর হয় না। আড্ডা শেষে তিনজনে মিলে হলে যায়। শিলা হলে ওঠার প্রস্তুতিমূলক সব কিছু ঠিক করে নেয় এবং পরদিনই হলে ওঠে। হলে উঠেই সামিয়ার কাছ থেকে দুটো টিওশন নিশ্চিত হবার খবর পায়। ক্যাম্পাসের ভেতরেই দুটো টিওশন। একটার পর একটা ভাল খবরে শিলা বেশ উচ্ছ্বসিত। প্রতিদিনের আড্ডায় এখন রাজনীতির আলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও চলচিত্রের মতই জমে উঠছে।

লাইব্রেরি চত্তরে পড়ুয়াদের ছোট ছোট দলে আড্ডা চলছে। শিলারাও এমনি একটা ছোট গ্রুপে আড্ডা দেয়। গল্প, কবিতা, উপন্যাসই শুধু নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা বিষয়ে ওরা আলাপ করে। মিছিল, সমাবেশ আর রাজনীতি নিয়ে এই পড়ুয়াদের দলের আগ্রহ শুধু আলোচনাতেই থেমে থাকে। ওদের কেউই খুব একটা মিছিলে যায় না, কেউ কেউ নাটকে, গানে, কবিতা পাঠে আর চলচিত্র প্রদর্শনে ব্যস্ত। ফিল্ম সোসাইটির হাবিব এসে শিলা, সামিয়া আর শিউলিকে আগামী সপ্তার চলচিত্র প্রদর্শনী সম্পর্কে জানিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ পায় শিলা। মুহুর্মুহ গুলিতে দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে সবাই। কিছু না বুঝেই ওরাও উঠে লাইব্রেরির দিকে দৌড় দেয়। একটা ভাঙা ইটে পা লেগে হোচট খেয়ে পড়ে যায় শিলা। উঠে দাঁড়াবার আগেই সামিয়া আর শিউলি লাইব্রেরি এলাকায় ঢুকে পড়ে। পেছনে তাকিয়ে দেখে, শিলা মাটিতে পড়ে আছে।

নিজেকে সামলে নিয়ে সে ওঠে দাঁড়ায়। প্রাণপণে ছুটে লাইব্রেরির দিকে। একটা গুলি এসে শিলার মাথা ভেদ করে চলে যায়। আর্তচিৎকারে লুটিয়ে পড়ে শিলা। সবুজ ঘাষ রক্তে ভেসে যায়। গুলির আওয়াজ থামে। লাইব্রেরি এলাকা থেকে সবাই শিলার কাছে আসে। শিলার দেহে আর প্রাণ নেই। নিথর দেহ পড়ে আছে। সবুজ ঘাষের ওপর জমাট বাধা রক্তে জাতীয় পতাকার রঙ পেয়েছে লাইব্রেরি চত্তর। শিলা যেন পতাকার পাশেই শুয়ে আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই তার মৃতদেহ নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা শোক মিছিল করে। শহীদ মিনারের পাদদেশে সকল রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষক সমিতি, কর্মচারী সমিতির সবাই এই শহীদের শোক মিছিল থেকে স্বৈরতন্ত্রের পতন অনিবার্য করার শপথ নেয়। সামিয়ার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো লাশবাহী গাড়ি সাতক্ষীরায় আসে।

একমাত্র মেয়ের এমন মৃত্যু সইতে পারেনি ওসমান। বুকে চাপ বোধ করে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে নিভৃতে ওসমানও চলে যায়। সন্তান-স্বামী হারিয়ে হামিদা নির্বাক হয়ে যায়। পিতা ও বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি আসে সজীব। চাচার সাথে মিলে সকল সামাজিক অনুষ্ঠান শেষ করে। হামিদা বেগমের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় সজীব বাড়িতেই অবস্থান করে। মায়ের সাথে কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। জয়নাল সজীবের সাথে কথা বলে জানতে চায় সজীব এখন কি করবে। জমিজমার ভাগাভাগি তো কিছু হলোনা বাবা, এখন তবে কি করবা জানতে চায় জয়নাল।

জমিজমা তো চাচাই দেখাশুনা করছে জ্যাঠা।
তা তো ঠিকই ভাতিজা। কিন্তু তোমার আয়নাল চাচা তো মাস্টারি করে, খুব একটা সময় দিতে পারে না। তাই বলছিলাম কি জমি ভাগাভাগি হলে তোমাদেরই ভাল হতো। তোমার আব্বার অনুপস্থিতিতে তোমার মায়ের পক্ষে তো আর এসব দেখে ঠিক করা হবে না। জমিজমা ভাগ হয়ে গেলে প্রয়োজনে তোমাদেরটা আমি দেখাশুনা করতে পারি। বর্গা চাষ করতে পারি। তোমরা বর্গা দিতে না চাইলে লিজও নিতে পারি। তোমার মা আর চাচার সাথে কথা বলে এসব বিষয় ঠিক করতে পার, বলেই জয়নাল চলে যায়।

হামিদা কোনভাবেই জমিজমার ভাগাভাগি নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়। আয়নালের বিয়ে হয়নি। ওর সন্তানাদি নেই। ও যেভাবে আছে তাতে আর বিয়ে করার সম্ভাবনাও নেই। হামিদাও কোনভাবেই চায় না আয়নাল বিয়ে করুক। বিয়ের কথা উঠালেই আয়নাল বলে, তুমি তো আমায় অনেক ভাল রেখেছ। বিয়ে করে আর কি হবে। ওসমানের বেঁচে থাকার সময় হামিদা যেভাবে ভাবতো এখন তার ভাবনায় কেমন যেন বদল হচ্ছে। বিধবা যদি একা বাড়িতে অবিবাহিত দেবরের কাছে থাকে তবে তো গ্রামে নানা কথা হতে পা্রে। তখন কি তাকে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে? আয়নালকে ঘিরে ভাবনার শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়।

রাতে এসব ভাবনার কথা জানিয়ে আয়নালকে বিয়ে করতে বলে হামিদা। কিন্ত্ আয়নাল এসব নিয়ে কিছু বলেনি। প্রসঙ্গ বদল করে আয়নাল বলে, তুমি বরং সজীবকে নিয়ে ভাইয়ের ব্যবসাটা ধরে রাখতে চেষ্টা করো।
চাচার কথায় সজীব তার মাকে নিয়ে ব্যবসার কাজ শুরু করে। বকেয়া আদায়ের চেষ্টা করে। হামিদা ধীরে ধীরে সবকিছু সামলে নিয়ে ব্যবসায় সময় দিচ্ছে। গ্রামের বাজারে এই প্রথম কোনো নারী দোকানে বসে ব্যবসা দেখছে। বিষয়টা নিয়ে কিছুটা কানাঘুষা শুরু করে জয়নাল আর হাফিজ মেম্বর। এসবের কিছু কিছু হামিদার কানেও আসে। সজীবও জানতে পারে কিন্তু এসব কথায় ও কোনো গুরুত্ব দেয় না। ব্যবসার কাজে মায়ের বাজারে বসাতে সজীবের কোন আপত্তি নেই। রাতে জয়নাল বাড়ি এসে বলে শোন আয়নাল, শিলার মা’র বাজারের দোকানে বসা নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলছে। বাড়ির মেয়েমানুষ এমনভাবে বাজারে বসলে তো নানা কথা হবেই। আমাদের বংশের একটা ইজ্জত আছে। কোন দিন কোন মেয়ে বাড়ির বাইরে কোন কাজে যায়নি। বাজারে বসে এমনভাবে ব্যবসা করলে তো আমাদের শরম হয়।

গ্রামের মানুষ বলে ওসমান ভাইয়ের পেনশনের টাকায়ইতো ভাবীর চলে যাবার কথা। আর এত জমিজমা থাকতে তাকে বাড়ির বাইরে বাজারে বসে এমনভাবে আয়-রোজগার করতে হবে কেন? তাই বলছি, শিলার মায়ের কিন্ত বাড়িতে থাকাই ভাল হবে।
হামিদা বলে, ব্যবসা করতে বাধা কোথায় ভাইসাব। আমদের নবিও তো ব্যবসায়ী নারী খাদিজাকে বিয়ে করেছিলেন। এত বছর আগে যদি আরব দেশে একজন নারী ব্যবসার কাজে যুক্ত থাকতে পারেন, আর তাকে বিয়ে করতে স্বয়ং রসুলুল্লাহ যেখানে রাজি হলেন সেখানে এত বছর পর আমার ব্যবসা দেখাশুনা করতে আপত্তি কেন হবে? যারা এমন বলে তাদেরকে ভাল করে বোঝাতে হবে ব্যবসায় নারীর অংশগ্রহণ মন্দ কোন কিছু নয়। এছাড়া আমাকে নিয়ে যারা এমন কথা বলছেন তাদের বলবেন তারা যেন আমার দোকানে এসে সরাসরি আমাকেই এসব বলে। এর মানে তুমি ব্যবসা ছাড়বে না। হামিদার মুখে সরাসরি না শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু না বলেই চলে যায় জয়নাল। চলবে