
মোরশেদ হাসানের গদ্য ‘নামকাহিনি’
প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২২
মেয়েটির বয়স বড়জোর দশ হবে। মেরুনের মধ্যে সবুজ ফুলের কাজ করা মাফলার পেঁচানো গলায়। বড় বোনের সঙ্গে এসেছে। বড় বোনটিকে দেখে কেন যেন মনে হলো, গার্মেন্টস-কর্মী। আমি ছোট মেয়েটির সমস্যা শুনলাম, গলায় ব্যথা। টর্চ দিয়ে গলাটা দেখে কপালে হাত দিয়ে খসখস করে একটানে প্যাডে লিখলাম, সোর থ্রোট, লো গ্রেড ফিভার। জিজ্ঞাসা করলাম, কী নাম তোমার?
চায়না।
হাসিমুখে বলি, ওহ আচ্ছা, চায়না দেশের নামে নাম তোমার। বাহ্।
প্রেসক্রিপশন লেখায় ব্যস্ত ছিলাম। খেয়াল করিনি যে, এরই মধ্যে মেয়েটির চোখমুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ করে চমকে উঠলাম তার গলায় ধাতব স্বর শুনে, আমার নাম চায়না দেশের নামে না।
কণ্ঠে কিছু একটা ছিল। আমি স্থির চোখে তাকাই। মেয়েটির কচি মুখের কোমল মাংসপেশী শক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। একটু সময় পেরোতে দিলাম। ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকালাম। বড় বোন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে একটি ভালো জামা পরিয়ে আনতে। তারপরও দারিদ্র্য প্রবল পরাক্রমে তার নিষ্ঠুর ছাপ বজায় রেখেছে। হয়তো মাথার চুলের কটকটে লাল রঙের সস্তা ফিতেটার জন্য। ছোট পায়ের পরিধিকে ছাপিয়ে স্যান্ডেলটি বেঢপভাবে বাইরে বেরিয়ে আছে। বড় বোন নিজেরটি পরিয়ে এনেছে সম্ভবত।
আমি যথাসম্ভব শান্তভাবে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, তবে?
সে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। আমি লেখা শেষ করে সাইন করছি, এমন সময় কথা বলে উঠল। চুপ করে শুনে গেলাম। ছোট মেয়েটির আগে তার আরও চারটি বোন বহুকালের বহুরূপী এই পৃথিবীকে তাদের জন্মকালীন কুৎসিত ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়েছে। জন্ম মুহূর্তে আবার মেয়ে হিসেবে তার আগমন খুব একটা সুখকর ছিল না দরিদ্র পিতা-মাতার কাছে। বিরস বদনে তাই তারা নাম রেখেছেন চায়না। আর কোনোভাবেই মেয়ে সন্তান চান না। চায়না নাম রাখলে হয়তো ভবিষ্যৎ সন্তানটি আর মেয়ে হবে না; বহু আকাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তান এসে ঘর আলো করবে।
বড় বোনটি ছোট বোনের আচরণে লজ্জিত হয়ে একবার মাটির দিকে আবার আমার পানে তাকাচ্ছে। আমাকে দ্রুত কাজ করতে হচ্ছে। আমি প্রেসক্রিপশনটি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আসুন।
দুবোন ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি অপলকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আসা বাতাসে দরজার পর্দাটি মৃদু দুলে উঠে থেমে গেল। অতঃপর চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিলাম।
এই কাহিনি খুব তো নতুন নয়। এ সমাজে সচ্ছল পরিবারে নবজাতক সন্তানের জন্য সুন্দর নাম খোঁজার হিড়িক পড়ে যায়। নামের বই কেনা হয়। অনেককে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেও দেখা যায়। যে-করেই হোক, একটি সুন্দর নাম চাই-ই, চাই। অথচ এ সমাজে আজও অনেকের নাম চায়না, খেঁদি, পচা, ভোলা, মরণচাঁদ।
যেসব মায়ের ছেলে আঁতুড়ে থাকতে বা জন্মের পরেই মারা যায় তাদের বিশ্রী নাম রাখলে নাকি যমে আর ছোঁয় না। চায়না নাম রাখলে এর পরের সন্তান আর মেয়ে হবে না। এক সময় সমাজে এই নিয়মও ছিল, যেসব মায়ের ছেলে অল্প বয়সে মারা যেত তারা পরবর্তী ছেলে হলে কখনও কখনও কড়ি নিয়ে দাইয়ের কাছে ছেলে বেচে দিতেন। এ সত্যিকারের বেচা নয়, যমকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য বেচা। আর এই সকল ছেলের নাম হতো এককড়ি, তিনকড়ি, পাঁচকড়ি হতে সাতকড়ি। পাঁচকড়ি দত্তের নাম শুনেছেন। কিন্তু কখনও ভাবেননি, তাই না?