প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘কষ্ট সহিষ্ণুতা’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২৩

প্রচণ্ড শীতে তারুণ্য আর বয়স্কদের মধ্যকার পার্থক্যটা টের পাওয়া যায়। চারদিকে দৃষ্টি ফেললে চোখে পড়ে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী বা কমবয়স্করা শীত নিয়ে তেমন সচেতন নয়। খুব কম পোশাকে পথ চলছে তারা। কুয়াশায় ঢাকা ঠাণ্ডা বাতাসের ভিতর বীরের মতো চলাফেরা করছে কম বয়স্করা। স্বাভাবিক তাদের চলার ভঙ্গি। প্রচণ্ড শীতের ভিতরেও কত স্বাচ্ছন্দ্য তাদের গতিবিধি, যখন বয়স্ক আমি কতরকম পোশাক গায়ে চাপিয়েছি ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাবার জন্য।\

 

সত্যিই কি বয়সের ব্যাপার এটা? না, সবটা বয়স নয়। মূল কারণটা কায়িক পরিশ্রম থেকে দূরে সরে থাকা আর নানারকম বিলাসিতা ও আরাম আয়েসে গা ভাসানো। সকাল বেলা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবার পথে কত বৃদ্ধ মানুষকে দেখলাম, কুয়াশার ভিতরেই আমার চেয়ে অনেক কম পোশাকে হাঁটাচলা করছেন। মাছ বিক্রি করতে যে বয়স্ক মানুষটি আসেন এই সাভার সেনাপল্লীতে, তার গায়ে একটি জামা আর সাধারণ মানের একটি সোয়েটার, সেই সঙ্গে মাথায় একটা টুপি। পায়ে প্লাস্টিকের সেণ্ডেল, মোজা নেই। কুয়াশা ভিতরে সেনাপল্লীর পথের উপর দাঁড়িয়ে তিনি মাছ বিক্রি করছেন। কমবয়স্ক অনেক ক্রেতারা বরং ঘরের জানালা দিয়ে কথাবার্তা বলে মাছ কিনছে। ঘর থেকে বের হচ্ছে না, বিক্রেতা মাছটা ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন।

 

কয়েকদিন আগে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে বা পথে-প্রান্তরে শীতের ভিতর বহু মানুষকে দেখেছি সামান্য পোশাকে নির্বিকার পথ চলছে। দামি পোশাক কেনার সামর্থ নেই যেমন তাদের, তেমনি প্রস্তুতি আছে। প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়বার শক্তি এবং সামর্থ্য আছে তাদের, যা আমার নেই। আমার বাসায় রান্না করে যে মেয়েটি, গতকাল কাজে আসেনি। জানিয়েছিল খুব জ্বর। ধরে নিয়েছিলাম আরো দুদিন আসবে না, কারণ সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ সকালে এসে হাজির। বর্তমান মেয়েটি কাজে যোগ দিয়েছে মাত্র কয়েক মাস। বললাম, জ্বর নিয়ে এলে কেন? জ্বর কি কমেছে? সে বলল, পরপর দুদিন না এলে খাবেন কি? বললাম গতকাল আমি নিজে দুদিনের রান্না করে রেখেছি তোমার জ্বর দেখে। সুস্থ হয়ে তারপর আসো। জ্বর নিয়ে আসার দরকার নেই। সে বললো, কাজ তো আপনার এক বাসায় করি না। বাকিরা কি সবাই এতদিন ছুটি দেবে?

 

বুঝতে পারি, তার প্রস্তুতি আছে। জীবন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে নিজেকে সে প্রস্তুত করে নিয়েছে। শীত, বর্ষার ভিতর জ্বর নিয়ে কাজ করবে সে বেঁচে থাকার জন্য, যখন আমরা বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইবো না। হ্যাঁ, কঠিন বাস্তবতার ভিতর দিয়ে তার প্রশিক্ষণ হয়েছে, সেই প্রশিক্ষণ লাভের কোনো সনদপত্র নেই তার। কিন্তু আমরা সুযোগ সুবিধার কারণে বিলাসিতা বা আলস্যে গা ভাসিয়েছি, কষ্ট করে প্রস্তুতি নেইনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়াবার। সত্যি বলতে হিসেব করলে জীবনটি আমাদের কখনো কখনো `ষোল আনাই মিছে`। সুকুমার রায়ের কবিতার সারমর্ম যেন আজ প্রথমবার বুঝলাম, যখন দেখলাম কুয়াশা ঢাকা শীতের সামনে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছি না। নিজের দোষেই এটা ঘটেছে। বিশেষ করে বিশ বছর ধরে সবরকম শারীরিক পরিশ্রম বাদ দিয়েছি হাঁটাহাট করা ছাড়া।

 

শীতের দিনে গরম পানি দিয়ে গোছল করা, গরমের দিনে শীতানুকূল ঘরে বসে থাকা, ঠিক মতো আমাদের শরীরকে বেড়ে উঠতে দেয় না। সামান্য কারণেই আমরা শরীরে রোগকে বাসা বাঁধতে দেই। তারপর বিছানায় পড়ে থাকি। কিন্তু কিছুটা কষ্টসহিষ্ণুতা, প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিলেই আমরা আর একটু বেশি ভালো থাকতে পারি। পদক্ষেপগুলো আর একটু সাহসী হতে পারে।