রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘ফেসবুকে লেখালেখি’

প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০২৩

বাংলাদেশে ফেসবুকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে লেখালেখি করার সমস্যা কি? সমস্যা বহুবিধ। কিছু সুবিধাও অবশ্য আছে। সুবিধা থাক, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি। প্রধান সমস্যা হলো, ফেসবুকে আপনি যাই লেখেন, সবাই মন্তব্য করতে পারে, দ্বিমত প্রকাশ করতে পারে আবার সঙ্গে সঙ্গে একমত হতে পারে। পত্রিকায় লেখালেখির ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। পত্রিকায় একজন লেখক যা লিখছেন, সম্পাদকের দপ্তর পার না হয়ে সেসব লেখার সমালোচনা প্রশংসা কিছুই প্রকাশিত হবে না। যা বলতে চাচ্ছি, পত্রিকায় যিনি মন্তব্য করবেন, সমালোচনা করবেন তাকে সেখানে সেই লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানাশোনা ব্যক্তি হতে হবে। যা কিছু চাইলেই মন্তব্য করা যাবে না। পত্রিকার লেখা কারো পছন্দ না হলেই ইচ্ছামতো গালাগাল করা যাবে না। কারণ সম্পাদকের দপ্তর সাধারণত সেগুলো গ্রহণ করবে না। ফেসবুকে লেখক আর সমালোচকের মাঝখানে কোনো সম্পাদক নেই। ফলে যার যা খুশি মন্তব্য করার সুযোগ আছে। পত্রিকার লেখার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে একই কারণে, পত্রিকা তার বিশ্বাস বা নীতিমালার বাইরে সাধারণ অন্য কিছু ছাপাতে চায় না। কিন্তু ফেসবুকে যে কোনো মত বলা যায়। ফেসবুকে যা খুশি বলা যায়, এটা যেমন খুব ভালো দিক, ঠিক তেমনি এটাই সবচেয়ে মন্দ দিক। কারণ কেউ একটা বিষয়ে কিছু না জেনেও, এখানে তা নিয়ে লিখতে পারে এবং যখন যা খুশি মন্তব্য করতে পারে। ধরা যাক, বিরাট সংখ্যক মানুষের দেখা পাওয়া যাবে ফেসবুকে, যারা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের কিছু না জেনেও প্রতিদিন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। খুব সহজেই বলে দিচ্ছে, প্রতিদিন এটা খেলে ওটা খেলে আপনার সব রোগ দূর হয়ে যাবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বা স্বাস্থ্যবিজ্ঞান কিন্তু খুব সহজে এসব কথা বলতে পারছে না। কারণ কথাগুলো বলতে হলে তার আগে তাদের গবেষণা করতে হবে।

 

মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বিশ্বের মানুষের বেলায় এটা সত্যি কিনা জানি না, কিন্তু বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মানুষের বেলায় এটা খুবই সত্যি। বাংলাদেশের মানুষ খুব কান কথায় বিশ্বাস করে। কথাটা হলো এখানকার মানুষ, বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই শুধু কারো মুখে শুনে বা পত্রিকায় পাঠ করেই অনেক কথা বিশ্বাস করে নেয়। সামান্য প্রশ্ন তোলে না। বিশ্বাস করা নিয়ে ততটা সমস্যা ছিল না, সমস্যা হচ্ছে সে বিশ্বাসটুকু নিয়েই যারতার সঙ্গে তর্কেবিতর্কে নামা। যা সত্যি কি না সে নিশ্চিত নয়, বা যা কিছু প্রমাণিত সত্য নয়, শুধু অন্যের মুখে যুগ যুগ ধরে শোনা, তার পক্ষে লড়াই করে সে জান দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আসল সত্যটা যে কি সেটা জানার ধৈর্য্য বা ইচ্ছা কোনোটাই তার নেই। নিজের বিশ্বাসের জায়গায় সে এতটাই গোঁড়া, সেই ক্ষেত্রে এর যে ভিন্ন সত্য থাকতে পারে, তথ্য উপাত্ত দিয়ে যে ভিন্ন মত প্রকাশ করা যেতে পারে এটা মানতে সে রাজি নয়। নিজের ভুল মত প্রকাশের জন্য সে প্রাণ দেবে, কিন্তু অন্যকে সে তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে দেবে না। যদি আপনি তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নতুন তথ্য দেন, সে যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই আপনাকে আক্রমণ করতে নামবে। এই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত ফেসবুকে তাদের মত প্রকাশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু আপনি যখন তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নতুন কিছু বলবেন, সে সেটা ভালো করে পড়বে না পর্যন্ত । প্রথমেই আপনাকে আক্রমণ করে বসবে। সে মনে করে, তার বিশ্বাসের বাইরে আর কোনো সত্য থাকতে পারে না। মনে করে, পৃথিবীতে জ্ঞান বোধহয় ততটুকু যতটুকু সে জানে। তার বাইরে আর কোনো জ্ঞান, আর কোনো সত্য থাকতে পারে না। বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত লোকদের সম্পর্কেই এসব বলছি। যখন তাদের যুক্তি থাকে না, তখন ক্রোধের বশে ভয়াবহ রকম আক্রমণ করে বসবে আপনাকে, কুৎসিত গাল দিতেও দ্বিধা করবে না।

 

সকলেই তার নিজনিজ বিশ্বাসের গভীর প্রমে পড়ে আছে। যাদের কিছু পড়াশুনা আছে তারা আমাদের সমাজের আরো বড় সঙ্কট। কারণ সে তার সামান্য পড়াশুনাকে পুঁজি করে নিজেকে পণ্ডিত প্রমাণ করার জন্য মরিয়া, নিজের সামান্য পুঁজি নিয়ে সববিষয়ে ভয়াবহ তর্কে লিপ্ত হতে তার সামান্য লজ্জা নেই। কিছু ক্ষেত্রে সেই বিখ্যাত প্রবাদটা মনে পড়বে আপনার, অল্প বিদ্যা ভয়ংকর। কখনো এদের লেখা পত্রিকায় ছাপা হবে কিনা সন্দেহ, কিন্তু ফেসবুকে সবাইকে জ্ঞান বিতরণে তাদের আপত্তি নেই। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার সে কিছুই পড়েনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক পড়াশুনা করার পর আপনি যাই লেখেন, সেটা যদি তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায় সে তর্ক জুড়ে দেবে, আক্রমণ চালাবে। কুরান পড়েনি, বাইবেল পড়েনি, বেদ ছুঁয়ে দেখেনি, কিন্তু দেখবেন ধর্ম নিয়ে বিরাট বিরাট বুলি দিয়ে যাচ্ছে। শিল্প সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া নেই, কিন্তু আপনাকে শিল্প সাহিত্য শেখাচ্ছে। বাংলাদেশের ফেসবুক এরকম মানুষে ভরে গেছে, কিছু সম্পর্কে না জেনেই সে মন্তব্য করতে পারে। বহু ধার্মিক পাওয়া যাবে এমন, বহু মার্কসবাদীও পাওয়া যাবে। বিভিন্ন আরো অনেকে রকম মানুষ তো আছেই। কাউকে লিখতে আমরা বাধা দিতে পারি না। সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। কিন্তু একটা বিষয়ে না জেনে কথা বলা বা মন্তব্য করা কি ঠিক?

 

যদি কেউ একটা বিষয়ে গভীরভাবে পড়াশুনা করে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে মত প্রকাশ করে, তাহলে আপনি সেখানে মন্তব্য করতেই পারেন, যদি বিষয়টা সম্পর্কে আপনারও জানাশোনা থাকে। কিন্তু যে বিষয়টা সম্পর্কে আপনার জানা নেই, শুধু শোনা কথা বা আপনার বিশ্বাস দিয়ে সেই লেখার বিরোধিতা করতে পারেন না। কিংবা ধরে নেয়া যাক একটা বিষয় সম্পর্কে আপনার দু চারটা বই পড়া আছে, আর একজন সেটা নিয়ে গভীরভাবে বহুদিন অধ্যয়ন করেছে বা গবেষণা করেছে; তাহলে তার কাছে তথ্য বেশি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনি বই হাতে পেয়ে তা পাঠ করে যা জেনেছেন, আর একজন সে বিষয়টাকে জানার জন্যই বই পাঠ করেছে, ফলে তার আগ্রহ এবং পড়াশুনার পদ্ধতির কারণেই সে বিষয়টা সম্পর্কে বেশি জানবে। নিশ্চয় কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম ঘটতেই পারে। মনোযোগ দিয়ে কেউ গবেষণা করলো না, গবেষণা করতে গিয়ে নিজে যা কিছু পড়াশুনা করলো বা যা তথ্য উপাত্ত পেল তা নিয়ে কখনো সামান্য প্রশ্ন তুললো না, শুধুমাত্র নিজের বিশ্বাস নিয়ে পড়াশুনা করে গেল, সত্যিই সেরকম পড়াশুনা অর্থহীন।

 

যখন আমি লিখবো, তার পক্ষে যুক্তি থাকতে হবে। যা খুশি আমি লিখতে পারি না। যা খুশি লেখা মানে চিন্তার স্বাধীনতা নয়। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থাকতে হবে। সেই সঙ্গে সেই সব তথ্য উপাত্তকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে আমার। যারা সমালোচনা করবেন, কথাটা তাদের বেলাও সত্য। যদি সমালোচকরা বিষয়টা সম্পর্কে গভীরভাবে জেনে সমালোচনা করেন, যদি তেমন ঘটে, তখনি সমালোচকের মন্তব্য দ্বারা লেখক উপকৃত হন। লেখাটা পড়ে একটা লাইক দিলাম, তাতে লেখক খুব একটা উপকৃত হন না। গঠনমূলক সমালোচনা বা মন্তব্য লেখকের চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ফেসবুকে লেখার সমস্যা হচ্ছে, তথ্য উপাত্ত দিয়ে লেখককে সহযোগিতা করার মনোভাব নিয়ে মন্তব্য করার উদাহরণ কম। ভিন্ন দিকে যারা আক্রমণ করেন তাঁরাও তথ্য উপাত্ত দেন না। শুধু আক্রমণ করার আনন্দে আক্রমণ করেন, বা বিরোধিতা করার জন্য। বিরোধিতা তো করা যাবেই, সেটা যেন যুক্তি সঙ্গত হয়। বিষয়টা সম্পর্কে না জেনে যদি লেখককে আক্রমণ করা হয়, সেটা লেখকের জন্য একটা সমস্যাই বটে। কিন্তু আমাদের দরকার ধৈর্যশীল হওয়া, যুক্তি দিয়ে বিচার করা। সবার জন্য ফেসবুকের সব লেখালেখি তখনি ইতিবাচক ফল দেবে ।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ