রিফাত বিন সালামের কলাম ‘তর্ক-বিতর্কে সুভাষচন্দ্র বসু’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২১

ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসু এক কিংবদন্তি। নেতাজি নামে পরিচিত ইতিহাসের এই রহস্য মানব। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশ্যা রাজ্যের কটক শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি ৯ম। ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিকসহ বিএ পাশ করেন। পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান তিনি। কিন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সেই নিয়োগ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। নেতাজির বক্তব্য ছিল, কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো, তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়া।

নেতাজিকে নিয়ে যেমন আলোচনা আছে, তেমন সমালোচনাও আছে দুনিয়াজুড়ে। বিশেষ করে নেতাজি ও হিটলারের সাক্ষাৎ নিয়ে। রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র সকল পক্ষই তার বিরোধিতা করেছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। এমনকি কেউ কেউ তাকে নাৎসি মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলেও অভিযুক্ত করেছে। সে বিতর্ক আজও চলমান।

কিন্তু নেতাজির আসল উদ্দেশ ছিল ভারতের স্বাধীনতা। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার রাজনৈতিক পদক্ষেপ থেকে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হলেও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত বিভেদ তার ছিল। তিনি মনে করতেন, গান্ধীজির অহিংস নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছে স্বাধীনতার জন্য কান্নাকাটি না করে বরং তা আদায় করে নিতে হবে। কেননা আলোচনা, অনুরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা আদায় কখনোই সম্ভব নয়। সহিংস আন্দোলন ছাড়া মুক্তি সম্ভব না, এটাই ছিল তার আদর্শগত অবস্থান। তাই তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিংদের আন্দোলনেও তার সমর্থন ছিল।

ভগৎ সিংদের ফাঁসি ও জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ নেতাজি ‘গান্ধী-আরউইন’ চুক্তির বিরোধীতা করে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে তাকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবারও তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে মোট ১১ বার কারাগারে নিয়েছিল।

দেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করতে পিছুপা হতেন না নেতাজি। নিজের স্বার্থকে বড় করে না দেখে দেশ ও জাতির কথাই সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। আর তাই তো ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের পরও তা ত্যাগ করে বেছে নেন মুক্তি সংগ্রামের পথ। আর এসব পদক্ষেপের কারণেই দেশ-বিদেশে সুবিধাবাদী শাসক শ্রেণি তাকে শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করে। ধারণা করা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়। তবে এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা গল্প আজও চালু আছে। সেই তথাকথিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধ প্রমাণও আছে।

জাপানের টোকিও শহরের রেনকোজি বৌদ্ধ মন্দিরে নেতাজির চিতাভস্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে, সেটি নেতাজির নয়। নেতাজি জীবিত না মৃত, তা নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে বিতর্ক রয়েছে।

নেতাজি সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বন্দি অবস্থায় সাইবেরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। কিংবা ভারতবর্ষে নেতাজির তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে হিংসার বশবর্তী হয়ে একদল ভারতীয় নেতা এবং ইংরেজ সরকার যৌথভাবে ষড়যন্ত্র করে নেতাজিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। এমন আরও গল্প আছে তাকে নিয়ে। এমন কী, ভারত সরকার কখনোই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ জনসমক্ষে আনেনি। হয়তো আরও কয়েক যুগ ধরে চলতে থাকবে এসব বিতর্ক। ধীরে ধীরে আরও রহস্যময় হয়ে উঠবে `নেতাজি` চরিত্র। আরও না জানা কথা উঠে আসবে ইতিহাস থেকে।