লকডাউন যদি কাজে না আসে, বাংলাদেশ করবে কী

তুহিন খান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০২০

শিকাগো ইউনিভার্সিটির হিস্ট্রির প্রফেসর উইলিয়াম এইচ ম্যাকনেইল প্লেগ নিয়া একটা বই লেখছিলেন, প্লেগস অ্যান্ড পিপলস। প্লেগ নিয়া লেখা সেরা পাঁচ বইয়ের লিস্ট যদি আপনি করেন, এই বইটা লিস্টে থাকতে পারে।

বইটা যে ধারায় লেখা, ফিলহাল তার নাম `এপিডেমিওলজিকাল হিস্ট্রি`। মহামারি কীভাবে একটা জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রগঠন, সমাজগঠন, কালচার, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, ইতিহাস থেকে তার অন্তত চারটা উদাহরণ নিয়া এই বইতে আলাপ করছেন ম্যাকনেইল।

সম্প্রতি বইটা আবার আলোচনায় আসছে মূলত সুইডিশ হিস্ট্রিয়ান সেভেরকার সোরলিনের সূত্রে। সোরলিন তার সাম্প্রতিক এক আর্টিকেলে এই বইয়ের রেফারেন্সে মন্তব্য করছেন, বৈশ্বিক মহামারি বলতে কিছু নাই। প্রত্যেক জাতির মহামারি আলাদা আলাদা।

সোরলিনের এই মন্তব্য আসছে বোধহয়, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সম্প্রতি সুইডেনের নেয়া পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে। পুরা দুনিয়া যখন `লকডাউন`, `কোয়ারেন্টাইন`, `সোশাল ডিসটেন্সিং` ইত্যাদি ভারি ভারি শব্দ এবং তার ততোধিক ভারি ও মর্মান্তিক মর্ম বোঝাবুঝিতে ব্যস্ত, তখন সুইডেন রাষ্ট্রীয় মহামারি বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেস টেগনেলের পরামর্শমাফিক `হার্ড ইমিউনিটি` পদ্ধতি গ্রহণ করছে। `হার্ড ইমিউনিটি` কী, এইটা গুগলে দেইখেন। `হার্ড ইমিউনিটি`র ফলে যেটা হইছে, সুইডেনে কোনও লকডাউন বা সোশাল ডিসটেন্সিং-এর আতঙ্ক দেখা দেয় নাই, সরকারের তরফে `টপ-ডাউন` অ্যাপ্রোচে সেসব বাস্তবায়নেরও কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। পুরা ব্যাপারটাই সরকার তুইলা দিছে জনগণের বিচার-বিবেচনা আর পারস্পরিক দায়িত্বশীলতার উপর।

সুইডেনের এই পদক্ষেপ নেয়ার পেছনে বড় কারণ দুইটা। প্রথমত, লকডাউন বা কোয়ারেন্টাইন সিস্টেম বিশ্বের অনেক দেশেই কাজ করতেছে না (উদাহরণ ভাবেন মনে মনে)। লং টার্মে এইটা কাজ করার কথাও না। এখন আপনি কি গ্লোবাল মহামারির গ্লোবাল প্রতিরোধ পদ্ধতিই নিজের দেশে চালু করবেন, না নিজের দেশের, মানুশের এবং কালচারের দিকে নজর দিয়া আলাদাভাবে মহামারিটা নিয়া ভাববেন, এইটা গুরুতর প্রশ্ন। সুইডেন দ্বিতীয়টা করছে।

ধরা যাক, সুইডেনে হোমস্কুলিং বা গৃহশিক্ষা নিষিদ্ধ (ঠিক `নিষিদ্ধ` বলা চলে না। আপনি যদি মনে করেন যে, আপনার বাচ্চারে আপনি `প্রোপার এডুকেশন` দিতে পারবেন বাসায়ই, তাইলে ইটস ওকে)। তো, লকডাউন চালু করলে স্কুল বা প্রি স্কুলগুলা বন্ধ হয়ে যাবে। কলেজ বা ইউনিভার্সিটির কথা আলাদা; কিন্তু এই প্রি-স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে গেলে, বাচ্চাদের শিক্ষাজীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা নষ্ট হবে, যার ফলাফল হবে ভয়াবহ। লকডাউন করা হবে কি হবে না, তা বিবেচনার জন্য সুইডিশ কালচারের গুরুতর একটা দিক এইটা, কারণ: শিক্ষা, বিশেষত শিশুশিক্ষা সুইডেনে খুবই সেন্সিটিভ ইস্যু।

দ্বিতীয়ত, সুইডেন কাজটা কেন করতে পারছে বা করার সাহস পাইছে? এইটা হইতে পারছে সুইডেনের সরকার আর জনগণের মধ্যে যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট, তার কারণে। আপনি আপনার জনগণরে তখনই মূল্য দেবেন, যখন তাদের সাথে আপনার মজবুত সম্পর্ক থাকে। জনগণও তখনই সচেতন হবে, যখন রাষ্ট্র তাদের `সচেতনতা`রে এপ্রিশিয়েট করবে।

ঠিক এইখানে আইসাই আমরা বুঝতে পারি, কেন লকডাউন বিন্দুমাত্র কাজে না আসলেও, আমাদের সরকার লকডাউনের কোনও বিকল্প ভাবতেই পারবে না।

প্রথমত, লকডাউন তুইলা দিলে প্রাথমিকভাবে যে পরিস্থিতি তৈয়ার হবে, তা সামাল দেয়ার কোনও ক্ষমতাই এই সরকারের নাই। করোনা আক্রান্তদের ১১% স্বাস্থ্যখাতের লোক, ডাক্তার-নার্স মিলায়ে মোট তিন শতাধিক— কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর `পিপিপি`র কোনও খোঁজখবর নাই। জনগণের সাথে সরকারের বিশ্বাস বা ট্রাস্টের অবস্থা তো, হাজি সেলিম সাহেবের, `ভাচায় প্রকাছ করা যায় না`র মতন। জরুরি কোনও সেবাই তো ঠিকমতো দেয়া হইতেছে না, উল্টা রিলিফের জিনিশপত্র নিয়া বেদম কাড়াকাড়ি। ভোটহীন সরকারের জন্য তাই, জনগণের `সচেতনতা`রে এপ্রিশিয়েট করা সম্ভবই না। ভোটহীন সরকারের মটো থাকে একটাই— জনগণ ভোদাই। আর তাই, যেকোনো স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, জনগণরে একটু বেশিই ভোদাই লাগতে থাকে আমাদের।

দ্বিতীয়ত, সরকার আর জনগণের ভিতরে কোনও ট্রাস্ট তো নাই-ই, দেশে এমন একটা বিভাজন তৈরি করছে আওয়ামী লীগ, যে বিভাজনের ফলে এখনও ভুগতে হয় জনগণরে। ডা. মঈন আওয়ামী লীগ আর তার দোসর শাহবাগীদের এই বিভাজনের রাজনীতির বলি। দেখা যাচ্ছে, আমাদের সোসাইটিতে যে বিরাট একটা বিভাজন হইছে ২০১৩-তে, তার রিপেয়ারিং হয় নাই; বরং দিনে দিনে মিউচুয়াল ট্রাস্ট কমছে আমাদের মধ্যে। সামাজিক সম্প্রীতি কোনও কারণে নষ্ট হইলে তার আছর থাকে বহুদিন। করোনার সময়ে সেই আছর স্বমহিমায় প্রকাশিত হইছে। যেসব করোনা আক্রান্ত রোগীর সাথে তার আত্মীয়রা নির্মম আচরণ করছে, তাদের নির্মমতারে স্বীকার কইরাই, এই নির্মমতার ব্যাকগ্রাউন্ডটা এক নজর চেক কইরেন। অসুস্থ বাপরে নিয়া জানকবুল দৌড়াদৌড়ির পরেও যদি আইসিইউ না পান, যদি আইডিসিইআর টেস্ট না করেই বলে যে কিছু হয় নাই, যদি তারপরে আপনার বাপ মারা যায়, আর আপনার দুলাভাইরে মিথ্যা `ইতালিফেরত` তকমা দিয়া মিডিয়ায় নিউজ প্রোপাগাণ্ডা হয় পুরা পরিবারটার বিরুদ্ধে— এরচাইতে বাপরে গোরস্তানে রাইখা আসা আপনার জন্য বেশি ভালো না?

বাংলাদেশে লকডাউন কোনও কাজেই আসবে না— এইটা অলরেডি সবাই বুঝে গেছেন। এইটা অবশ্য বোঝা গেছে গত মাসেই, যখন করোনার সকল `বাধা` জয় করে, বাংলাদেশে একটা ইলেকশন হইছে। যেন বুঝায়ে দেয়া যে, ভোট জনতার অধিকার না, বাধ্যবাধকতা। ফলে জান হাতে নিয়া ভোট দেয়া লাগবে সবার। তো লকডাউন যদি কাজে না আসে, বাংলাদেশ করবে কী?

দেখা যাক।