লোপা মমতাজ

লোপা মমতাজ

লোপা মমতাজের গদ্য ‘এটাও এক ধরনের ক্রাইম’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১২, ২০২২

নতুন বছর চলে এসেছে। তবে আশপাশে তেমন কোনো ভালো ঘটনা খুঁজে পাচ্ছি না। আজ একটা মন খারাপের ঘটনা শুনে মনে হলো, একা একা মন খারাপ করবো কেন, আপনাদেরও বলি।

ঘটনাটা হলো, স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কেউ একজন আরেকজনকে ছেড়ে অন্যজনের কাছে চলে যাচ্ছে। এমনতো হরহামেশাই ঘটে। এ আর নতুন কী! তবুও মন বলে কথা... মনতো খারাপ হয়ই...

কথা হলো, যে যাবার সে যাবেই। তাকে জোর করে আটকে রাখা যায় না। যে সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে দুজন নারী-পুরুষ মিলে ঘর বাঁধে, তা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। ছেলেটা অথবা মেয়েটা যে কেউই আলাদা হবার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে এবং আলাদা হতে পারে, এখানে পাড়াপড়শী কেউই বাধা দিতে আসবে না। তবে আমাদের মতো গরিব দেশগুলোতে আলাদা হতে যাবার ব্যাপারে ঝামেলার বড় একটা কারণ, অর্থনীতি।

সংসার করতে যেয়ে যেটা হয় সেটা হলো, কেউ একজন ঘরে বসে যান। বসে যান মানে বসেই যান। বিএ, এম পাশের সার্টিফিকেট, নানান রকমের ডিগ্রি, কর্ম দক্ষতার ট্রেনিং কিছুই আর কাজে লাগাতে পারেন না। বাইরে কাজ করার ব্যাপারে একটা সময় নিজের ওপর তার কনফিডেন্ড কমতে থাকে। একা একা ঘর থেকে বের হয়ে সেও যে কিছু করতে পারবে বা একা একা চলতে পারবে, এটা সে নিজেই একসময় আর বিশ্বাস করতে পারে না।


এমনটা নারীদের বেলাতেই বেশি ঘটে। তো কথা হলো, অর্থনৈতিক ভাবে নারীটিও যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো তবে হয়তো আলাদা হতে যাবার সময়ে এত বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি হতো না!  যাক সে কথা।

শিল্প-সাহিত্য জগতে যারা বিরাজ করছেন তাদের নিয়ে এই বিষয়ে দুইটা কথা আছে। এই যে আপনি বা আপনারা অল্প বয়সে নিজ ইচ্ছায় বিবাহ করেন তারপর দুই চারটা সন্তানের বাবা-মা হয়ে সাংসারিক পর্ব শেষ হইলো মনে করিয়া আপনার প্রতিভা বিকশিত করিয়া আপনার নাম ডাক চারপাশে ছড়াইতে থাকেন, তারপর আপনি দুই চারটা পুরস্কার পাইয়া আমি কার কে আমার মনে করতে করতে দুই দিন পরপর প্রেমে পড়েন অথবা প্রেম আপনার উপড়ে পড়তে থাকে মনে করেন, তা কেন করেন?

মানে, আপনার যা খুশি ইচ্ছা তাই করেন কিন্তু সেক্স করতে মন চায় বলে বিয়ে কেন করেন তারপর সন্তান উৎপাদন করে ডিভোর্স দেবার ইচ্ছা কেন পোষণ করেন? আপনি ব্রোথেলে গেলেই তো পারেন। যাকে বিয়ে করলেন তাকে কোনোদিন সম্মান করলেন না, এটাও কী এক ধরনের ক্রাইম না?

ঘরের যে ভালোবাসার মানুষটি আপনাকে এত বছর সাপোর্ট করলো, আপনার জন্য নিজের ভালো লাগা ও ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হলো, আপনাকে এগিয়ে যেতে সব রকমের সহযোগিতা করলো, এই এত কিছু করার পরে আপনি যখন সমাজে কিছুমিছু হয়ে দাঁড়ালেন তখন আবিষ্কার করলেন, আপনি যাকে বিয়ে করেছেন তাকে বিয়ে করাটা আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তার সবকিছু আপনার অসহ্য লাগা শুরু করলো, তাকে আপনার নন ক্রিয়েটিভ মনে হতে লাগলো, তাকে আপনার সাথে কোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে বিরক্তিকর মনে হতে লাগলো, তিনি আপনার সন্তানের মা অথবা বাবা এই পরিচয়টা দিতেও আপনার লজ্জা লাগতে শুরু করলো।

তারপর একটা সময় মনে হলো, সে আপনার বুড় আঙুলের নখেরও যোগ্য না... এবং আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাকে আপনি ডিভোর্স দেবেন। তারপর আপনার মনে হলো, আপনার যোগ্য এমন কোনো এনলাইটেড মানুষকে মানে যাকে নিয়ে সমাজে একটা পরিচয় দিতে পারেন এমন কাহকে বিবাহ করবেন।  এটা কী কোনো মানবিকতার পরিচয় হলো?

ডিভোর্স দিতে চান, দেবেন। কিন্তু একবারও কী ভেবেছেন, আপনি যে আপনি হয়ে উঠলেন তার জন্য আপনার সঙ্গী জীবনের যতগুলো বছর নিজে কিছু না করে আপনাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে অথবা যতটুকু স্যাক্রিফাইস সে আপনার জন্য করেছে, আপনারও তা করা প্রয়োজন? একজন মানুষকে এমন অথর্ব করে হুট করে সন্তানসহ ছেড়ে দেবার ইচ্ছা পোষণ করাটাও এক ধরনের ক্রাইম।

চলে যাবেন, যেতেই পারেন। কিন্তু সোসাইটিতে যেভাবে ন্যায়নীতি ও ধর্মের কথা মুখে কপচাতে থাকেন সেটা ব্যাক্তিগত জীবনেও ফলিয়ে দেখান। তবেই না বুঝবো, আপনিও আসল পুরুষ অথবা আসল নারী।

কার কথা বললাম? আমি আমার পাড়াতো এক ভাবির কথা বললাম। এক প্লেট কাচ্চি হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভাবি এই মন খারাপের ঘটনাটা শুনালো। শুরুতে তাদের যখন ব্যাপক প্রেম ছিল তখন জামাই ভাবিকে প্রত্যেকদিন পুরান ঢাকার কাচ্চি এনে খাওয়াতো। ভাবিটি স্বামীকে ভালোবেসে এই কাচ্ছি খেয়ে খেয়ে এখন দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে গেছেন আর সম্প্রতি জামাই একই পাড়ায় এক নারীর প্রেমে মজে শুকিয়ে কাঠ হইয়া গেছেন। ফলে স্বামী তাকে বলেছেন, দেহ তোমার লগে আমার কুন মিল নাইক্যা। আমি কেমুন হুগনা আর তুমি কুরবানির খাশির লাহান ফাইটা যাইবার লাগছো। আমি মর্জিনারেই বিয়া করুম। অরে না পাইলে আমি বিষ খাইয়া মরুম... অয় কেরুম ইংলিশ কয় দেকচো? আই মিন হুঞ্চো? কুন দিন বাপের জনমে হুনছো এমন ইংলিশ? তুমিতো আবার অশিক্ষিত আছো, কিচু বুঝবার পারবানা... মাই ওল্ড বিবি, আমি আর তুমার লগে থাকবার পারুম না। আই ম্যারি ডিয়ার মরজিনা। আই টাচ ইউ নট...সি ইউ নট... ইউ টাটা... বাই বাই...ইউ সাট ইউর মাউথ...

এই ঘটনার চরিত্রের সাথে আপনি পরিচিত না হলেও আপনার আশপাশে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে...। তবে কী মনে হয় জানেন, কেউ কারো থেকে আলাদা হতে চাইলে, বেশ দীর্ঘ একটা সময় সাথের সঙ্গীটিকে দেয়া প্রয়োজন তার জীবন যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। যেন একা হয়ে যাওয়া মানুষটি নিজে মানুষিকভাবে প্রস্তুত হতে পারে, যেন তাকে ঘর সংসার চালানোর জন্য কারো কাছে হাত পাততে না হয়, যেন সে কিছু করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে এই দীর্ঘ সময়ে। পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় দিয়ে, পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়ায় গেলে তবেই না আপনি সত্যিকারের মানুষ।