
শক্তিনাথ ঝা
শক্তিনাথ ঝা’র কাছে প্রশ্ন
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০১৯
বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান― এ দুটি বাঙালির বাস্তবতা। কখনো কখনো এই বাস্তবতাকে আমি অস্বীকার করি। কখনো কখনো কোনো কোনো বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে ভালো লাগে। শান্তি পাই। আমি মনে করি বাঙালি বাঙালিই। সে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান জৈন বৈষ্ণব যাই হোক না কেন। আবার কখনো কখনো মনে হয়, অস্বীকারের কী আছে? মত-পথের বৈচিত্র তো থাকবেই। থাকাটা প্রকৃতির নিয়ম। বৈচিত্র্যের মধ্যেই খুঁজতে হবে ঐক্য। বাঙালি একটি বিশাল নদীর নাম। এর বহু শাখা। শেষ পর্যন্ত সকল শাখা মিলিত হয়েছে একই নদীতে―বাঙালি নদী। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে খেয়াল করি, বাঙালি হিন্দু সমাজের একটা বিশাল অংশ বাঙালি মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন, একেবারেই অজ্ঞ। এই অজ্ঞতা শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাহীন হিন্দুসমাজের মধ্যেই নয়, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দুসমাজ, এমনকি হিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজেও বিদ্যমান।
প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতি গবেষক পরম শ্রদ্ধেয় শক্তিনাথ ঝা সত্যিকার অর্থেই সাধকজীবন যাপন করেন। থাকেন মুর্শিদাবাদে, ভাগীরথী নদীর তীরে একটি বাড়িতে। একা। ছেলেরা থাকেন প্রবাসে। তাঁকে দেখভাল করেন সুফিপন্থি এক ফকির। দু-বছর আগে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলাম তাঁর সঙ্গে। দীর্ঘক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনেছি তাঁর কথা। যেন অমৃতবাণী। ফেরার সময় তাঁর রচিত ‘সূফি: মদিনা থেকে মহাস্থানগড়’ বইটি উপহার দিলেন আমাকে। শুভেচ্ছা বাণীতে লিখলেন, ‘স্নেহের স্বকৃত নৌমানকে।’
নিজের নামের বানানের এমন বিকৃত দশা দেখে মন খারাপ হয়নি। কারণ আমি তো জানি বাঙালি হিন্দুসমাজের একটা বিশাল অংশ যে বাঙালি মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ। কলকাতার লেখক-সাংবাদিকরা প্রায়ই বাঙালি মুসলমানের নামের বানানের ক্ষেত্রে ভুল করে থাকেন। কলকাতার দৈনিক কাগজগুলোতে প্রায়ই দেখি বাংলাদেশের লেখকদের নামের ভুল বানান। শামসুর রাহমানকে লেখে সামশুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হককে লেখেন সৈয়দ শমছুল হক। এমনকি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের নামকেও বিকৃতভাবে সৈয়দ মুশতফা সেরাজ লিখতে দেখেছি। এ নিয়ে একবার আমি লিখেছিলামও। গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে গল্প নিয়ে একটি সেশন ছিল। অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার গল্পকাররা। মঞ্চে ছিলাম আমিও। কলকাতার এক গল্পকার তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের কথাশিল্পী শহীদুল জহিরকে বারবারই শহীদুল জাহির বলছিলেন। এক পর্যায়ে আমি প্রতিবাদ করলাম। তিনি লজ্জিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। প্রথম যখন আমি কলকাতায় যাই, তখন পরিচয় হয়েছিল এক লেখকের সঙ্গে। তিনি আমার নামের বানান লিখেছিলেন ‘নোহমান।’
কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান লেখক-সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবী সমাজ এই ধরনের ভুল করে না। জীবনানন্দ দাশকে তারা জীবনানন্দে দাস লেখে না, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানেক বন্দ্যোপোদ্যায়, তারাশঙ্করকে তারাছঙ্কোর, বিভূতিভূষণকে বিভুতিবুশন লেখে না। কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায়, অমর মিত্রসহ কোনো লেখকের নামের বানানে কখনোই ভুল করে না। কেন করে না? কারণ বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজ হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীন নয়, অজ্ঞ নয়। পড়শি হিন্দু সংস্কৃতিকে তারা ‘অপর সংস্কৃতি’ ভাবে না, নিজেদের সংস্কৃতিই ভাবে। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত আর মধ্যযুগের সকল সাহিত্যকীর্তিকে তারা নিজেদের সম্পদ বলেই মনে করে। এই ব্যাপারে তাদের কোনো দ্বিধা নেই।
শক্তিনাথ ঝা’র ‘বস্তুবাদী বাউল’সহ অন্য বইগুলো ঢাকায় পাওয়া যায়। কলকাতায়ও। কিন্তু এ বইটি, ‘সূফি : মদিনা থেকে মহাস্থানগড়’, কলকাতার একটি অখ্যাত প্রকাশনী থেকে মুদ্রিত হওয়ায় ঠিকমতো পাঠকের হাতে পৌঁছায়নি। সর্বত্র পাওয়া যায় না। আমি ভাবলাম, এমন অসাধারণ একটি বই থেকে পাঠক বঞ্চিত থাকবে কেন? বাংলাদেশের পাঠকরাও এটা পড়ুক। ব্যক্তিগতভাবে আমি শরিয়ত বা সূফি তরিকায় বিশ্বাসী না হলেও আমি মনে করি, বাংলাদেশে মোল্লাতন্ত্রের ভয়াবহ উত্থানের এই কালে বাঙালি মুসলমানকে বাঁচাতে পারে কেবল একটি পথ―সূফিবাদ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সমন্বয়বাদী এই পন্থার কোনো বিকল্প নেই। তাই এ ধরনের বই যত বেশি রচিত হবে ততই মঙ্গল। শ্রদ্ধেয় শক্তিনাথ ঝা’র সম্মতিতে গত বছর বইটি বাংলাদেশের রোদেলা প্রকাশনী থেকে বাংলাদেশ সংস্করণ প্রকাশের ব্যবস্থা করি।
এই সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সুতাটি আরো একটু মোটা হয়। আজ হাতে পেলাম তাঁর অন্য একটি বই, ‘জাত গেল জাত গেল বলে।’ মুর্শিবাদ থেকে পাঠিয়েছেন তিনি। আমাকে দিয়েছেন খ্যাতিমান লোকসংস্কৃতি গবেষক ও নাট্যকার সাইমন জাকারিয়া। বইটি মূলত বাংলার লোকায়ত শিল্পীদের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কিছু গানের সংকলন। বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় শুভেচ্ছাবাণীতে শক্তিনাথ ঝা লিখেছেন, ‘স্বকৃত নৌমান/ প্রীতিভাজনেষু/ শক্তিনাথ ঝা/ ১৪.০৫.১৯।’
শক্তিনাথ ঝা শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আমার মতো তুচ্ছ একজন লেখককে ভালোবেসে আপনার মতো মহান একজন মানুষ সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে বইটি পাঠিয়েছেন, এজন্য আমি গর্বিত, আনন্দিত। এই গর্ব ও আনন্দ প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। এ জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। কিন্তু স্যার, কিছু কথা আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে। আমার জন্ম বাঙালি পরিবারে। এ নিয়ে আমার কোনো গর্ব নেই, কোনো খেদও নেই। কেননা আমার জন্মের পেছনে আমার কোনো হাত ছিল না। আমি ইংরেজ, চীনা, পাঠান, পাঞ্জাবি, তামিল, তুর্কি, জার্মান, ফরাসি, কোরিয়ান, স্পার্টান, সামুরাই, মগ, চাকমা বা পৃথিবীর আর আর জাতিগোষ্ঠীতে জন্ম নিতে পারতাম। প্রকৃতির ইচ্ছায় জন্মেছি এই বাংলায়, বাঙালির ঘরে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে বাঙালি মুসলমানের ঘরে। এতেও আমার হাত ছিল না। আমি বাঙালি হিন্দুর ঘরেও জন্মাতে পারতাম, কিংবা বাঙালি বৌদ্ধের ঘরে। জন্মের পর পরিবার তো বটেই, রাষ্ট্রও আমার গায়ে সিল মেরে দিয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে আর পাসপোর্টে আমাকে লিখতে বাধ্য করেছে আমি মুসলমান। একজন মানুষ কেবলমাত্র মানুষ পরিচয়েও যে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে, সেই অধিকার রাষ্ট্র দেয় না।
স্যার, আপনি জানেন যে, একদা আরবের সঙ্গে বাংলা বা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও ভাষাগত সম্পর্ক ছিল। বণিক, সূফি-দরবেশ ও দখলদার মুসলমান যোদ্ধাদের আবির্ভাবের পর আরবি ও ফারসি ভাষা অত্যন্ত ব্যাপকতা ও সমৃদ্ধি লাভ করে বাংলায়। কালের প্রবাহে বাংলা ভাষায় প্রবেশ ঘটেছে প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দ। ফারসি সাহিত্যের প্রতি আমার পিতার অনুরাগ ছিল বলে তিনি আমার নামটি রাখেন ফারসিতে। নোমান একটি ফারসি শব্দ। বাবার কাছে শুনেছি নোমান অর্থ অনল বা অগ্নি। আমি কখনো যাচাই করে দেখিনি। দেখার ইচ্ছেও নেই। ছলিমউদ্দিন, কলিমউদ্দিন, নোমান, হ্যানিমান, হেরিসন―যে কোনো একটা নাম হলেই হলো। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, নোমান নামটি আমার। এই নামেই আমার পরিচয়। নোমানের পরিবর্তে আপনার মতো পণ্ডিত যখন ‘নৌমান’ লেখেন, তখন আমার কেবলই মনে পড়ে যায় বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজের ঔদাসিন্য আর অজ্ঞতার কথা।
স্যার, শত শত বছর ধরে একই ভূমিতে পাশাপাশি বসবাস করছে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। অথচ বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজ বাঙালি মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কতই না অজ্ঞ! সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ক্ষমা করা যায়। সাধারণ মানুষ সবসময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। পড়শির খোঁজ-খবর করা সবসময় তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী সমাজের অজ্ঞতা কি ক্ষমা করা যায়? বুদ্ধিজীবীর অজ্ঞতার জন্য কিন্তু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটা গোটা জাতি। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন নানা দিক বাঙালির উপর শুরু হয়েছে ভাষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অপচেষ্টা চলছে বাঙালিকে বিভক্ত করার, এ অজ্ঞতাটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। অজ্ঞতার এই বদ্ধকূপ থেকে মুক্তি কি কোনোদিন মিলবে না? নাকি মুক্তির প্রয়োজন নেই। জানার ইচ্ছে থাকল। আমি জানি, কোনো না কোনোভাবে আমার এ লেখাটি আপনার দৃষ্টিগোচর হবে। যদি কখনো সময়-সুযোগ হয় অধমের প্রশ্নটির উত্তর দেবেন।
টুকে রাখা কথামালা/ঢাকা, ১৪ জুলাই ২০১৯