
শামীমা জামান
শামীমা জামানের গদ্য ‘রাষ্ট্রীয় স্ক্রিপ্ট: নিখোঁজ কাহিনি’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২
গত বছর জানুয়ারির এক হিম হিম সকাল। তখনো ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভেঙে গেলে অফিসে যেতে চটজলদি রেডি হওয়ার কিছু আগের সময়। যে সময়টা আরামের ঘুম দু’চোখে নেমে আসে। সেই শয়তানি ঘুমকে আয়েশ করে প্রশ্রয় দেয়ার সময়টাই ফোনটা বেজেছিল। সাত সকালে ভিডিও কল। কানেক্ট হতেই ভিডিওতে ভেসে উঠলো মায়ের মুখ। মায়ের সুন্দর মুখটা ফ্রিজ হয়ে আছে। নাকে সাদা তুলো গুজে দেয়া। দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি পরা কয়েকজন লোক মাকে ধরে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিচ্ছে। আর উচ্চ স্বরে পড়ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু...।
আমার মা নেই! সত্যিই নেই হয়ে গেল মা! চিৎকার দিলেও মা ফিরে আসবে না। পৃথিবীর কোনো কিছুই আর মাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
এরপর মা আসেন। স্বপ্নে। প্রায় দিনই মা স্বপ্নে থাকেন। একদিন স্বপ্নটা বেশ দীর্ঘস্থায়ী ছিল। খুব জীবন্ত। মা বলছেন, আমি তো মরি নাই। ওটা মিথ্যে ছিল।
আহা, কী খুশি আমার! সব ভাইবোনকে বলছি, মা মরে নাই, মা বেচে আছে। আমরা শুধু শুধু কষ্ট পেয়েছি। কান্নাকাটি করেছি। এই যে মা ফিরে এসেছে। কী যে আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিল। আনন্দ আসলে কী তা অইটুকু স্বপ্নসময়েই বুঝেছি।
ঘুমটা ভেঙে গেলে যেমন বুঝেছি, দুঃখ কী। কী ভীষণ কষ্টে বুক ফেটে যায়। এটা স্বপ্ন ছিল! তাই তো, মা তো মরেই গেছে। মরে গেলে কি আর ফিরে আসে মানুষ!
মরিয়মের মা ফিরে এসেছে। কী সুখের কথা। এই প্রায় একটা মাস মেয়েটা কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদিয়েও। মা বলে কথা। আমার মা হারানোর ভয় নেই। কিন্তু যাদের আছে তারা মরিয়মের মায়ের জায়গায় নিজের অজান্তেই নিজের মাকে বসিয়ে অঝোরে কেঁদেছে আর ফুঁসেছে।
যদিও মরিয়মকে প্রথম দেখায়ই আমার খুব চেনা চেনা কই যেন দেখেছি, লাগছিল। যেমন করে একবার কোথাও দেখলে হয়। তা ফেসবুকের ময়দানে কোথাও দেখে থাকবো, এমন ভেবেছি। কিন্তু তিনি যে কোটা আন্দোলনের সেই কান্নার রোল করা বিপ্লবী অভিনেত্রী, দেশের একমাত্র অ্যাকটিভ বিরোধী নেতা জনাব নূর সাহেবের স্নেহধন্য, সেটা খেয়াল করিনি অনেকের মতোই।
আমার নারীবাদী বন্ধুরা যারা মরিয়মকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পাশে ছিল, তারাও ধরতে পারেনি তার সেই পরিচয়। অথচ বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। সে যে পরিচয়ই হোক। মা হারিয়ে গেছে, এখানে কোনো কথা থাকে না। থাকে না সন্দেহের কোনো অবকাশ। মাকে নিয়ে মিথ্যে বলতে মানুষের কলিজা কেঁপে ওঠার কথা। বলা হচ্ছে, জমিজমার জের ধরে বিপক্ষ শক্তিকে বেকায়দায় ফেলতে মা-মেয়েরা মিলে এমন নাটক সাজিয়েছে।
মরিয়ম যদিও বলছে, সে শুধু তার মাকে চেয়েছে। কারো শাস্তি সে চায়নি। সে কথাও কিন্তু সত্যি। তাহলে কি এরকম ভাবা যায়, প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা সফরের এই সময়টায় যখন নিউইয়র্কে একদল ইউএন ভবনের সামনে হাসিনা বিরোধী যে সমাবেশ করছে, কিম্বা যে এফকে বিমানবন্দরে ‘গো ব্যাক শেখ হাসিনা’ বলে ফেনা তোলা মরিয়া বিএনপি-জামাতগোষ্ঠিদের মুখপাত্রদের একটা টাটকা চলমান গুমকাহিনির স্ক্রিপ্ট দরকার ছিল।
ফলে মরিয়মকে এই আখ্যানে অভিনয় করতে হয়। পুনরায় আমাদের ভাবনার পরিবর্তন করে আমরা এও ভাবতে পারি, তাহলে একটা পচা গলন্ত লাশ কীভাবে এলো? লাশ কেনাবেচার কথা সিনেমায় দেখেছি। সেরকমই একটা সরকারি অনুদানের ছবি হতে পারে কি, যেখানে নানা রহস্যের পরে মানুষের মনে এই কথাটিই গেঁথে রইবে, আসলে গুমখুন এদেশে হয় না। কিছু মানুষ এমনভাবে প্রপাগাণ্ডা ছড়ায়।
‘আব্বু তুমি কান্না করতিছ কেন?’ বলে কোনো কিশোরীর ডায়ালগ আমরা কোনোদিন শুনতে পাইনি। মরিয়মের মায়ের এই শান্ত ধীর পায়ে পানি আনতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া আমাদের আরেকটি নিখোঁজ কাহিনি মনে করিয়ে দেয়। তিনিও শান্ত ধীর পায়ে তার ইকবাল রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে ছিলেন। তারপর তাকে এক হিন্দু মহিলাকে ফোন করতে হয়। তারপর তাকে আরেকটি শহরে আবিষ্কার করা যায়। শান্ত, ঘোরগ্রস্থ।
এরও পরে ফিরে এসে তিনি আর মিডিয়ার সাথে কথা বলেন না। তার সফেদ জুব্বা পাগড়ির সাথে দরবেশি দাড়ি হয়। তিনি এক ধাক্কায় ১০ বছর বুড়ো হয়ে যান। আহা! এত এত রাষ্ট্রীয় স্ক্রিপ্টের রমরমা দেশে স্ক্রিপ্ট রাইটাররা কী সামান্য সম্মানি পায়!
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট