শিমুল বাশারের স্মৃতিচারণ ‘গল্প নয়, সত্যি’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২

বাসায় চুরি হয়েছে। সবার খুব মন খারাপ। বিদেশ থেকে ভাইয়ার আনা লাল টেপ রেকর্ডারটা উধাও হয়ে গেল। এ ক্ষতি কিছুতেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। বাবা বিভিন্ন জায়গায় লোক পাঠালেন চোরকে ধরে আনতে। পরিকল্পনা হলো, এলাকা থেকে বের হবার সমস্ত পথে ভোরের আগেই লোক পাঠানোর। যার কাছে লাল টেপ রেকর্ডার পাওয়া যাবে তাকেই ধরে আনা হবে।

ভোরবেলা পাশের বাগিচায় অচেনা একজনকে বসে থাকতে দেখে এলাকাবাসী চোর সন্দেহে তাকে ধরে আমাদের বাসায় নিয়ে এলো। কোনো প্রশ্নেরই যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর সে দিতে পারছে না। উঠানের আমগাছের সাথে তাকে বাঁধা হলো। এরপর রিমান্ড শুরু। রিমান্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমার মেঝো চাচা। আমরা বাসার ছোটরা যখনই চান্স পাচ্ছি টেপ রেকর্ডারটার কথা ভেবে চোরকে কয়েকটা কিল ঘুষি দিয়ে আসছি।

বিকেল পর্যন্ত তাকে গাছে বেঁধে মারা হলো। চোর যতই বলে সে চুরি করে নাই, মারের মাত্রা ততই বাড়ে। আমিও তাকে মারতে যাচ্ছি বারবার। মেঝো চাচার মতো ওই চোরের কাছে আমারও অনেক জিজ্ঞাসা। চোরটাকে আমি মারতে গেলেই বলে, জোরে জোরে মাইরো... গায়ে বল নাই তোমার? এভাবেই তার সাথে আমার কথোপকথন শুরু।

একসময় সেই চোর কণ্ঠ নামিয়ে আমাকে বলে, ‘ছাইড়া দাও আমারে, আমি তোমাগো টেপসেট আইন্না দিমু।
চোরের ওই কথা শুনে মেঝো চাচা রেগে বললেন, যদি তুই চুরি নাই করিস তাইলে কোথা থেকে টেপ আনবি?
চোর জানালো, সে একদিন বিদেশ যাবে তখন তার অনেক টাকা হবে এবং টাকা হলে দেশে ফেরার সময় আমাদের লাল টেপ রেকর্ডার তিনি নিয়ে আসবেন।

এতেও মারের মাত্রা কমলো না। অবশেষে সেই চোর আমাকে কাছে ডেকে বললো, শোনো তোমরা আমারে মারো, যত ইচ্ছা হয় ততই মারো। তয় ক্যালা গাছের ডাউগ্গা দিয়া মারবা তাইলে বেশি বিষ লাগবো... পায়ের তলাতে মারবা তাইলে আমি হাইটা আর কোথাও যাইবার পারুম না।

বিকেলের দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো চেয়ারম্যান বাড়িতে। বিচারের আশায় আমরাও দলবেঁধে পেছন পেছন গেলাম সেই বাড়িতে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে অন্য এলাকা থেকে আরেক চোর ধরে আনা হয়েছে। তাকেও বেঁধে রাখা হয়েছে। ওই চোরকে দেখে আমাদের বাড়ির চোরতো ক্ষেপে ফায়ার। ওই চোরকে সে মারবেই। আমাদের চোর ছুটে গিয়ে ওই চোরকে কিল ঘুষি মারতে মারতে বললেন, শুয়োরের বাচ্চা, তরে না কইছি আর কোনোদিন গরু চুরি করবি না। কিরে?

অবশেষে চোরের বিচার হলো। চেয়ারম্যান বললেন, আমাদের চোর নাকি আসলে চোর না, সে একটা পাগল। ছেড়ে দেয়া হলো তাকে। আমরা বাসায় ফিরে এলাম। কোথাও প্রকৃত চোরের হদিস পাওয়া গেল না আর।

বছর দেড়েক পরের কথা। হঠাৎ একদিন আমাদের উঠানে এক অচেনা লোক উপস্থিত। তার হাতে একটা লাল টেপ রেকর্ডার। আমরা ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। মাকে দেখে ওই লোক বললো, খালাম্মা আমারে চিনছেন? এই নেন আপনেগো টেপ। মনে আছে আমারে কেমুন মারছিলেন?

আমরা চিনতে পারলাম, এই সেই চোর। ওই চোর খলবল করে কথা বলছে, কিছুতেই আর থামছে না। সে বললো, আপনেগো মাইরের পর আমি ভালো অই গেছি। তয় আপনেরা অনেক ভালো। আমারে মারলেও ভাত দিসিলেন খাইতে। এর লিগাই আপনেগো টেপ টা ফেরত নিয়া আইছি।

আমাদের চুরি যাওয়া টেপ রেকর্ডারটার চেয়েও অনেক আধুনিক ডেস্ক সেট ঝুলছে তার হাতে।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী