শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তীর গদ্য ‘ডিজিটাল বাটপারির যুগে লেখালেখি’

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০২২

লেখক আর লেখকের প্রোফাইল এক জিনিস নয়। এসব নিয়ে সিরিয়াসলি কখনো ভাবিনি। কিন্তু কিছুদিন ধরে যেসব তথ্য উঠে আসছে, তা আমরা যারা সৎভাবে লেখালিখিটা করি তাদের জন্য বেশ দুশ্চিন্তার।

লেখক কে? যিনি না লিখে পারেন না তিনি লেখক। তার লেখনি যদি ঈর্ষা করার মতো হয়, তবে তিনি অবশ্যই লেখক। আর লেখকের প্রোফাইল কি? লেখকের ওপর যখন প্রতিষ্ঠানের ছাপ্পা পড়ে তখন তার একটা ভালো প্রোফাইল তৈরি হয়। অথবা আজকের আত্ম-প্রতিষ্ঠার যুগে একজন লেখক যখন নিজেই নিজের বগল বাজানোর চব্বিশ ঘণ্টার দায়িত্ব নেন, সোজা কথায় কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে সোস্যাল মিডিয়ায় সম্পূর্ণ পেইড পিআর দিয়ে লাখ লাখ ফলোয়ার ওয়ালা পেইজ বানিয়ে নিজের প্রচার সারেন, তখনও তার একধরনের প্রোফাইল তৈরি হয়। সেটাকেও অপচয় বলা যায় না, যদি অবশ্য তার মেধা থাকে।

প্রাতিষ্ঠানিক ছাপ্পাই যখন একমাত্র স্বীকৃত মাধ্যম ছিল, সেই যুগে সবটাই যে খুব মেধার অনুকূল ঘটেছে, এমন নয়। কী কী হয়েছে বা হয় তা লেখা নিষ্প্রয়োজন। তবু যেহেতু প্রতিষ্ঠানের সম্মানের প্রশ্ন, তাই একেবারেই প্রতিভাহীন মানুষকে তারা খুব একটা জায়গা দেননি। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়ার এই পেইড প্রমোশনের যুগে যা ঘটছে তা অকল্পনীয়।

ধরুন, একজনের লেখাটা সেরকম একটা আসে না। লেখক হওয়ার জন্য যে বোধের জায়গাটুকু লাগে, সেটুকুও নেই। কিন্তু এরকম একজন মানুষ কোনোরকমে একটি বই লিখে দুর্দান্ত মার্কেটিং করে কিছু কপি বিক্রি করে ফেললো। সাথে সাথে সোস্যাল মিডিয়ায় পেইড পিআর আর পেইড রিভিউ দিয়ে তৈরি হয়ে গেল জব্বর এক প্রোফাইল। লেখক নেই কিন্তু লেখকে প্রোফাইলটি হলো খাসা। আজকাল শুনেছি বড় বড় শো রুমে ছোট ছোট ব্র্যান্ডের জন্য র‌্যাক ভাড়া দেওয়া হয়। অর্থাৎ একজনের কাছে প্রচুর টাকা আছে আর তা দিয়ে তৈরি করা ব্র্যান্ড নেম আছে। তা দিয়ে সে একটা শোরুম খুলে ফেলেছে। কিন্তু যারা প্রোডাক্ট বানায় তাদের সেটা বেচার মতো জায়গা বা ব্র্যান্ডনেম নেই। তারা ওই শোরুমের মালিকের থেকে নির্দিষ্ট ভাড়ার বদলে নিলো ব্র্যান্ড নেম আর জিনিস রাখার জায়গা।

ঠিক সেরকমই সোস্যাল মিডিয়ায় এরকম কিছু বড় র‌্যাকের মালিক আছে। র‌্যাক আছে কিন্তু নিজের মাল নেই। এবার সে কী করবে! এমন অনেক লেখক আছেন যারা খুব ভালো লেখেন কিন্তু লেখাটাকে নিয়ে ব্যবসা করার কথা ভাবেননি। সুতরাং তাদের কেউ সেভাবে চেনে না। এদের বই থাকলেও বাজারে সেরকম বিক্রি নেই। প্রোফাইলের মালিক কিছু মূল্যের বিনিময়ে এদের থেকে লেখার স্বত্ব কিনে নিতে থাকলেন। অথবা আসল লেখক কিছু জানতেই পারলেন না। তিনি হয়তো থাকেন প্রত্যন্ত গ্রামে। তার অজান্তেই তার লেখার কনটেন্ট বেশ কিছু অদল বদল করে নিজের র‌্যাকে সাজিয়ে রাখলেন প্রোফাইলের মালিক। লেখক দেখে বই কেনেন সে পাঠক সংখ্যালঘু। সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রথমে ছাপ্পা দেখে বিভ্রান্ত পাঠক, প্রোফাইলের র‌্যাক থেকে ব্র্যান্ডের নামে অন্যের কনটেন্ট কিনে নিয়ে বাড়ি গেলেন। ব্যাস! ব্যবসাটা ভালোই দাঁড়িয়ে গেল। এরজন্য লেখক হওয়ারও প্রয়োজন হলো না, অথচ টাকা ও খ্যাতি দুটোই হলো।

এই যদি চলতে থাকে, তাহলে সৎ পরিশ্রমের কী মূল্য থাকলো! প্রকৃত প্রতিভারই বা কী হবে! এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে হাজার হাজার কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ায় হাই পিআর করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কে আর অথেনটিসিটি দেখছে। লোকে সেল্ফ-মেইড ব্র্যান্ড দেখে জিনিস কিনছে আর ঠকছে। তরুণ প্রজন্ম কেন লিখতে আসবে? সহজ টাকা, সহজ খ্যাতির প্রলোভন তাদের টেনে নিয়ে যাবে চরম সর্বনাশের দিকে, যদি না আমাদের অগ্রজরা এই ধরনের অর্গানাইজড ক্রাইম শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। আজ এই ডিজিটাল বাটপারির যুগে আমাদের যে কারো কলম চুরি হয়ে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে, আমরা যারা অনেক রাতজাগা পরিশ্রমে অনেক যত্নে নির্মিত শুধু আমাদের ছাপটুকু ছেড়ে যেতে চাই...