সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘শশধর মিত্র মৃত’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : জুন ১৪, ২০২২

ভোর চারটে বেজে বারো মিনিট
সিধুর জ্যাঠা দীপক একটা কালো আলখাল্লা পরে আধো অন্ধকার ঘরটায় কী যেন করছেন পেছন ফিরে। সিধুর বাবা তিলকও আছে। সে ওই ঘরেই একটু দূরে একটা মরা কাটছে। সিধু অবাক হয়ে এগিয়ে আসে ঘরটায়। কল্যাণ ডাক্তার সিধুকে পেছন থেকে ডাকে। ফাঁকা হিমঘরজুড়ে সাদা বরফ ধোঁয়া।

খুব গিলে-মেটে খাওয়া হচ্ছে? কল্যাণ বলে ওঠে।
সিধুর বাবা মরা কেটে তার ভেতর থেকে অনেক লাল কাপড়ে মোড়ানো ডায়েরি বের করছে। সিধু একটু এগিয়ে এসে দেখে, তার জ্যাঠাও পাঁঠার বডির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে লাল কাপড়ে মোড়ানো ডায়েরি বের করছে। কত যে ডায়েরি জমা হয়েছে ঘরটায়, বলে বোঝানো যাবে না!
সিধু চেঁচিয়ে বলে ওঠে, বাবা? জ্যাঠা? তোমরাও এত ডায়েরি পেয়েছ, তাহলে আমি একা নই?

কেউ জবাব দেয় না। পেছনে খুটখাট শব্দ হতে থাকে। সিধু ফিরে দেখে, পেছনের একটা স্ট্রেচারে শশধর মিত্রর মরাটা পড়ে আছে। একটু যেন কাঁপছে। সিধু সেদিকে এগিয়ে গিয়ে অভ্যেস মতো ছুরি আর কাঁচি তুলে নিতেই শশধর সটান চোখ খুলে সিধুর দিকে চেয়ে বলে ওঠেন, আমার স্থাবর অস্থাবর সব তোমার। আমি লিখে দিয়ে যাচ্ছি, এক্ষুণি। একটা ডায়েরি আর পেন দেবে?

সিধু ঘেমেনেয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে খাটে। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে জোরে। ওদের বস্তিতে অনেকের ঘরেই কারেন্ট চুরি করে আসে। তবুও সিধুদের টাকা দিতে হয়। যে চুরি করে লাইন করে দিয়েছে তাকে। প্রতি মাসে তিনশো করে। সিধু নীল প্লাস্টিকের জগ থেকে জল খায়। পাশে রানি ঘুমোচ্ছে অঘোরে। অল্প অল্প নাক ডাকছে সে। বাইরে রাস্তার কুকুরদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সিধু বিড়ির প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে বাইরে আসে। ভোর হতে এখনও দেরি আছে। আবার আবহাওয়াটা গরম হয়ে গেছে। সিধু ফের চামড়ার ডায়েরিটা খোলে। আগের পাতাগুলোয় ফের চোখ বুলিয়ে দেখে ঠিকই পড়েছিল সে। একটুও ভুল নেই কোথাও। লোকটা সত্যিই তার সম্পত্তি যে এই লেখাটা পড়ছে তাকে দিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু এমনি এমনি এইভাবে কেউ কারুর অর্জিত টাকা দিয়ে দেয়? সিধু যতটা পড়েছিল তার পর থেকে আরেকটু পড়ে।

শশধর মিত্র লিখেছেন, বুঝলেন? কথাটা সত্যি কিনা তাই মনে হচ্ছে তো? তবেই বুঝুন। কেউ একটা কথা বললেই সেটা জল মেশানো কিনা কিংবা চিটিংবাজি কিনা সেটাই আগে মনে হয়। আমাদের মন কতটা বিষিয়ে গেছে! সে যাক গে, আমি আমার সব আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি, ব্যাস। আমার একজন চেনা লোক আছেন। তার কাছে গেলেই এই ডায়েরিটা দেখালেই তিনি আপনাকে বাকি সব বুঝিয়ে দেবেন। এই ডায়েরির আরেক কপি তাকেও দেওয়া আছে। সে দুটো কপি মিলিয়ে নিলেই আমার সব আপনার।

সিধু বিড়িতে বড় টান দেয়। আবার পড়ে, সেই লোকটি যে আপনাকে আমার সব কিছু পাইয়ে দেবে তার কাছে যেতে হলে আপনাকে শ্যামবাজারে যেতে হবে। ঠিকানাটা হলো: কাউন্টার প্রেস ১৩০ এ, ফরিয়াপুকুর রোড। কলকাতা ৭০০০০৪। ওখানে গিয়ে বলবেন, শিবশীষ রায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। আমার নাম করবেন। বাকিটা উনি বলবেন। নমস্কার। আবার কথা হবে যদি আপনার কৌতুহল বজায় থাকে।

সিধু দেখে, অন্ধকার রাস্তায় দূরে কেউ যেন এদিকেই আসছে। সিধু উঠে দাঁড়ায়। চেহারাটা আরেকটু কাছে আসতেই সিধু বোঝে, রাস্তায় জল দিতে যাচ্ছে নতুন এই বস্তিতে আমদানি হওয়া ছেলেটা। ওর নাম বাসু। সরকারি চাকরি করে। কাকভোরে গাড়ি করে রাস্তা ভেজাতে ভেজাতে যায়। সিধুকে এই অসময়ে বাড়ির বাইরে দেখে বাসু একটু অবাক হয়েই হাসে। সিধু ডায়েরিটা সরিয়ে নিয়ে পাল্টা হাসে।

শফিকুলের দোকান এখন বন্ধ। তার পাশেই একটা চায়ের দোকান আছে। সিধু আজ অনেকটা সকালেই সেখানে এসে হাজির। কয়েকজন চেনা মুখ বেরিয়ে গেল।
দুধ চা তো? চায়ের দোকানের লোক জিজ্ঞেস করে।

সিধু হ্যাঁ বলে। পাশেই কাগজ বিলি করে কানাই সিধুকে দেখে বলে, মাছের বরফ, লেবুর জলের বরফ এগুলো নাকি সব মর্গের বরফ, তাই সিধু?
সিধু বলে ওঠে, হলেই বা কার কি?
কানাই নাক কুঁচকে ঘেন্নায় বলে, তুই মালটা দিন কে দিন কসাই হয়ে যাচ্ছিস। হলেই বা কার কি মানে? মানুষের রক্ত ফক্ত লেগে ইসসস!

সিধু চায়ে চুমুক দেয়। বলে, রক্ত আমরা সবাই খাই কানাইদা, কেউ বলে জানিয়ে খায়, আর কেউ স্যাট করে লুকিয়ে মেরে দেয়। রক্ত না খেলে বাঁচব?
কানাই সাইকেলে উঠে বলে, যা যা! বড় বড় বুককুনি! ডোমের বাচ্চা, এঁদো মাল! এক্কেবারে বাপ জ্যাঠার রক্ত পেয়েছে! মুখ খুললেই লাশকাটা ঘর!

সিধু মুচকি হেসে চায়ের দোকানের লোকটার দিকে চেয়ে বলে, মরলে তো আমাকেই খবর দিতে হবে, নাকি? ছেলেমেয়ে, বউ-ভাই এসে থোড়াই চুল্লিতে ঢোকাবে? বৈতরণী পার করিয়ে দি তো। এখন কি বুঝবে? দাঁড়িয়ে যাক ক’টা দিন। কি বলো?

চায়ের লোকটা অন্য লোকেদের চা দিতে ব্যস্ত। সিধু দেখে, কনস্টেবল গণা পুলিশের জিপে বসে চলেছে। সিধুকে দেখে হাত নাড়ে। গাড়ি থামায়। সিধু এগিয়ে যায়। গণার পাশে নতুন মুখ কোনো পুলিশের স্যার। দারুণ চেহারা। দেখলেই হিংসে হয় এমন। গণা বলে ওঠে, কিরে সিধু? কোথায়?
সিধু বলে, এই তো। চা খাচ্ছিলাম। নতুন স্যার নাকি? নমস্কার। আমার নাম সিধু। মরা কাটি। বাপও তাই করত। ডোম স্যার।

নিজের মোবাইলে চোখ রেখেই সানগ্লাস পরা লোকটা মাথা নাড়ে। সিধু জিজ্ঞেস করে, কোথায় চললে?
গণা বলে, কাজ আছে। ধর্মতলার দিকে। কেন?
সিধু কী একটা ভেবে বলে, আমাকে নামিয়ে দেবে? আমি শ্যামবাজার যাব। ধর্মতলা থেকেই তো ট্রাম বাস পেয়ে যাব।

গণা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, মানে সামনে বড়বাবু আছে যখন তখন ওর হ্যাঁ বলা উচিত না। তাই সে স্যারের অপেক্ষায় থাকে।
স্যার বলেন, ওঠ, পেছনে যা।
সিধু উঠে পড়ে। জিপ চলতে থাকে। স্যার লোকটা কথাই বলে না ছোটলোকদের সঙ্গে।

গণা বলে, সক্কাল, সক্কাল মারামারি, ভাব!
সিধু কৌতূহলী, কিসের গো?

গণা মাথা চুলকে বলে, আর কী বলব, এদেরও বাঁড়া কাজ নেই! এসএসসি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু পোঁদপাকাদের  মিছিল আছে। তারা আইন অমান্য করলেই ক্যালানোর অর্ডার আছে। ভালোলাগে সাত সকালে?

সিধু মাথা নেড়ে যায় গণার কথায়। কিন্তু মনে মনে ঝলিয়ে নেয় শিবশীষ রায়। কাউন্টার প্রেস। ফরিয়াপুকুর। আকাশে মেঘ করে আসে আবার। বৃষ্টি হবে। হঠাৎ সিধু জিজ্ঞেস করে ওঠে, এই বাচ্চা কাচ্চাগুলোকে মারতে ভালো লাগে? মিছিল করলে ক্ষতি তো কিছু নেই, নাকি?

গণা ফিসফিস করে বলে, এরা সব ক‘টা পোঁদপাকা মাল! এদের মারলে কিছুই মনে হয় না। খালি সরকারকে টোন কাটবে, কাজ নেই কিচ্ছু নেই! খালি মিছিল মিছিল খেলা। পারবে সাতশো দেনা মাথায় নিয়ে সরকার চালাতে?

ধর্মতলার আগে থেকেই জ্যাম শুরু। গোটা ধর্মতলাজুড়ে যুবক-যুবতীরা মিছিল করছে রাস্তা ব্লক করে প্রায়। এসএসসির এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও! পুলিশ তোমার মেরুদণ্ড কোথায়? কত দামে হলো বিক্রি? এইসব স্লোগান!
সিধু নেমে পড়ে।

শশধর মিত্রর স্থাবর অস্থাবর কী কী হতে পারে, ভেবে নিয়েই রাস্তা পার হলো সিধু। ওদিকে টিয়ার গ্যাস ছুড়ল গণারা মিছিলের দিকে! কুণ্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে দেখতে পেল সিধু ট্রামে ওঠার আগে। চলবে