সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘শশধর মিত্র মৃত’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০২২

সকাল দশটা বেজে তিন মিনিট
ঝাঁ চকচকে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সিধু। কিন্তু কিন্তু করছে ভেতরে ঢুকবে কিনা। সেই ফ্ল্যাট বাড়ি থেকেই বেরিয়ে এলো এক কাজের মহিলা। তাকে দেখে নিজের অনেকটা কাছের মনে হলো সিধুর। জিগেশ করল, এখানে শিবাশীষ রায় থাকেন? ক` তলায়?

চার তলায়। লিফট আছে ঢুকে বাঁ দিকে। চলে যাও।
মহিলা মেশিনের মতো বুলি আউড়ে চলে যান। সিধু ফের একবার ঘাড় উঁচু করে বাড়িটা দেখে। কী বলবে ভেতরে গিয়ে? শিবাশীষ রায় কি বিশ্বাস করবে তাকে? ভাববে না তো যে, সে চুরি করেছে কারুর থেকে ডায়েরিটা?

লিফট এসে থামল চার তলায়। সামনেই দরজা। দরজার বাইরে একটা নেমপ্লেটে লেখা, কাউন্টার প্রেস। সিধু বেল টেপে। দরজা খোলে ষাটের কাছাকাছি বয়সের একজন ভদ্রলোক। পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা। তিনি স্বাভাবিকভাবেই সিধুকে চেনেন না।

সিধু বলে ওঠে, শশধর মিত্রকে চেনেন?
ভদ্রলোক চুপ করে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
দামি ঝাঁ চকচকে বসার ঘরে একটা চেয়ার টেনে বসে আছে সিধু। উল্টো দিকের সোফায় বসে আছে শিবাশীষ রায়। কথা বলে যাচ্ছেন, খ্যাপাটে লোক ছিল শশধর। প্রথম জীবনে কবিতা লিখত। তখন আমরা শুরুও করিনি। তারপর এত টাফ হয়ে গেল টু হ্যান্ডেল যে কোনও বই-ই বেরোল না। তবে অবশ্য তার বেশিকিছু আমি জানি না। খবর রাখিনি। কয়েক বছর আগে একবার এলো। এসে বলল, অনেক কামিয়েছি ভাই। সেগুলোর একটা গতি তো করতে হবে, একটা ডায়েরি রেখে গেলাম সিল করা খামে। ইচ্ছে করলে খুলতেও পারিস। তবে তোর প্রয়োজনীয় কিছু নেই এতে। একটি ছেলে বা মেয়ে আসলে যে কেউ, মানে হুট করে একদিন এসে বলতে পারে আমার নাম, তখন তাকে দিয়ে দিস।

একটা খয়েরি খামে পোরা আরেকটা ডায়েরি এগিয়ে দিল সে সিধুর দিকে। সিধু সেটা নিয়ে একটু বোমকেই গেছে। সে আর দাঁড়ায়নি এক মুহূর্ত। ডায়েরিটা নিয়েই বেরিয়ে এসেছে। শিবাসীষের বাড়িতে সিধুর জন্য তৈরি হওয়া চাটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ফেলা হলো বেসিনে। গলগল করে গড়িয়ে সেটা ঢুকে গেল সরু পাইপের মধ্যে।

সুড়ঙ্গের ভেতর মেট্রো রেল ছুটছে। সিধু ট্রেনের ভিড়ে দাঁড়িয়ে খাম খুলে ডায়েরিটা বের করে পড়তে শুরু করে, এক নম্বরের হারামি লোক শিবাশীষ। সেটা নিশ্চই দেখেই বুঝেছ? যদি না বুঝে থাকো তাহলে কিছুই বলার নেই। চোখের পরীক্ষা করাও। এই কথাটার নিচে শিবাশীষের একটা স্কেচ করে গেছেন শশধর।

এরপর আবার লেখা, ফালতু লেখা লিখে একটা প্রেস খুলে লোক ঠকানোর একটা দারুণ ফন্দি বের করেছে, করেও খাচ্ছে। হেবি ফুটানি। গুজুগুজু, হাম্পি, নাভি এইসব নামের উপন্যাস লেখে আর বেস্ট সেলার পুরস্কার পায়। বাড়িতে পুরস্কার দেখোনি? লোকে আদৌ পড়েই না। নিজেই অর্ধেক কপি কিনে নিয়ে বলে সব বিক্রি! যাক গে, তোমার কৌতূহলের একটা অবসান ঘটাই। ভাবছ তো আমি শরীরে মধ্যে কি করে একটা কাপড়ে মোড়ানো ডায়েরি নিয়ে ঘুরেছি? প্রথম প্রথম অসুবিধে হতো। তারপর গা সয়ে গেল। তুমি হয়তো জানোই না তোমার শরীরেও একটা খাতা আছে।

সিধু মেট্রো থেকে নেমে হাসপাতালের পাশ দিয়ে হেঁটে বস্তির দিকে যাচ্ছে। হাসপাতালের বাইরে কল্যাণ সিগারেট খাচ্ছিল। সিধুকে দেখে বলে ওঠে, এই গিলে মেটে! কোথা থেকে?

সিধু বলে, শ্যামবাজার গেছিলাম কাজে।
কল্যাণ জিজ্ঞেস করে, আজ তো ধর্মতলার দিকে হেব্বি ঝামেলা! পুলিশ প্রচুর কেলিয়েছে মিছিলকে! ছাত্রছাত্রীগুলোর কি দোষ বল তো? ঠিকই তো বলছে।
সিধু চুপ করে থাকে।
কল্যাণ বলে, কাল আসিস, বডি আছে!

সিধু এগিয়ে যায়। ডায়েরিটা বের করে আবার পরে, আমার সম্পত্তির কি হলো, ভাবছ তো? তার জন্যে তোমাকে আমার বাড়ি যেতে হবে। ঠিকানা যাদবপুর সন্তোষপুর, রানি রাসমণি লেকের পাশেই। সেখানে গেলেই আমার বউ তোমায় সবটা বলে দেবে। নিয়ে নিও। ভাবছ, আগেই সন্তোষপুর বললে পারতাম? আমার যা কিছু বউকে না দিয়ে তোমায় দিয়ে যাব যখন একবার বাজিয়ে দেখব না, তুমি সত্যিই কতটা ইন্টারেস্টেড! বেস্ট অফ লাক!

খপাৎ করে ডায়েরিটা কেড়ে নেয় রানি। সিধু বাড়ি ফিরে এসেছে! রানি ডায়েরিটা নিয়েই একবার প্রথম কটা লাইন পড়ে নিয়ে সিধুর দিকে চেয়ে থাকে অবাক হয়ে। সিধু অনেকদিন পর খেয়াল করে, রানির হাতে আজকে ওর ফোন নেই! আশ্চর্য! গেম খেলছে না সে? চলবে