সম্পদের অসম বণ্টনই নারী-পুরুষ বৈষম্যের কারণ

হাসান আজারকাত

প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০২০

পুরুষ তুমি মানুষ হও— কথাটির মাঝে গভীর একটা ছলচাতুরি আছে। নারীও মানুষ, পুরুষও মানুষ, তৃতীয় লিঙ্গও মানুষ। বায়োলজিক্যালি পুরুষ পুরুষই, নারী নারীই। নিজের ব্যাসিক বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি বাদ দিয়ে মানুষ কিভাবে হওয়া সম্ভব, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাইনি কোথাও। আমি মনে করি, মানুষ হতে হলে মনুষ্যত্ব থাকা জরুরি, সেই সাথে মানবিক গুণাবলি ও সাম্যের দর্শন। তা নারী ও পুরুষ উভয়ক্ষেত্রেই।

ব্যক্তিমালিকানার ধারণা আসার পর থেকে উৎপাদনের সকল মালিকানা পুরুষের দখলে থাকায় পুরুষ ঐতিহাসিকভাবেই সমাজ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সমাজে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিমালিকানা টিকিয়ে রাখতে নানান নিয়ম ও আইনও তৈরি হয়। বাহিনী গঠন করা হয়। পুরুষ তখন শুধু নারীর উপরেই নয়, অপেক্ষাকৃত দুর্বল পুরুষের উপরেও কর্তৃত্ব ফলানো শুরু করে। দাস হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়েই উৎপাদন হাতিয়ারের মালিকদের কাছে নির্যাতিত ও শোষিত হতে থাকে।

এই ধারা এখনো বিদ্যমান। শোষণ ও কর্তৃত্ববাদের পুরো ব্যাপারটাই ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক। নারী-পুরুষের লিঙ্গকেন্দ্রিক নয়। বায়োলজিক্যালি নারী পুরুষের চেয়ে দুর্বল বলে পুরুষ নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। নারীর উপর পুরুষের সহিংসতার একমাত্র কারণ হলো, পুরুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতা। অসম বণ্টনভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থায় উৎপাদন হাতিয়ারের উপর পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার। সেই অর্থনৈতিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে পুরুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল।

অসম ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদন ব্যবস্থায় নারী ও পুরুষ কেউই নিরাপদ নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে, সম-অধিকারের লক্ষ্যে, মর্যাদার লক্ষ্যে নারী ও পুরুষ পাশাপাশি অবস্থান না নেয়। আজ মাদ্রাসার ছেলেরা হুজুরদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার একমাত্র কারণ, মাদ্রাসার ছাত্রদের চাইতে মাদ্রাসার হুজুরের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বেশি। স্বামীর হাতে স্ত্রী ধর্ষিত হচ্ছে একই কারণে। দিনমজুরের নাতনি ধর্ষিত হয়, কিন্তু শিল্পপতির নাতনি ধর্ষিত হয় না।

এটা ঘটে এই দুই শ্রেণির অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও অবস্থার কারণে। যদি কাল সমকামীদের হাতে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়, তারাও সমগোত্রীয়দের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে ও ধর্ষণ করতে পিছপা হবে না, যা কুরআনের আয়াত অনুযায়ী কওমি লুতের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

সুতরাং, উপরের আলোচনার ভিত্তিতে এটা বলা যায়, নিপীড়ন, কর্তৃত্ববাদীতা, শোষণ, ধর্ষণ এসব লিঙ্গ পরিচয়ের উপর নির্ভর করে ঘটে না। অসম বণ্টনের উদ্দেশ্যে উৎপাদন মালিকানা দখল এবং তা থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে ঘটে। ফলে লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর মনোভাব আমাদের পরিহার করা খুবই জরুরি। সম্পদের সুষম বণ্টনের উদ্দেশ্যে উৎপাদনের মালিকানা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দখলে আনার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া মানবমুক্তির (পুরুষ ও নারী) কোনো বিকল্প নেই।