স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৬৯

প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০২২

ঋত্বিক ঘটকের বায়োগ্রাফিকাল একটি মুভি আছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নামে। কমলেশ্বর মুখার্জি পরিচালিত। মূল চরিত্র নীলকণ্ঠ বাগচী তথা ঋত্বিক ঘটকের ভূমিকায় অভিনয় করেন শাশ্বত চ্যাটার্জি। মুভিটিতে দেখা যায়, অতিরিক্ত মদ্যপানে অসুস্থ ঋত্বিক ঘটককে হাসপাতালে ভর্তি করালেন তার স্ত্রী। ঋত্বিক ঘটক হাসপাতালের কেবিনকক্ষে ঢুকে বললেন, ও, এখানেই তবে তারকাসুর বধ হয়েছিল।

সংলাপটি আমার কান ছুঁয়ে গেল, কিন্তু কিছুই বুঝলাম না। কে এই তারকাসুর? তারকা নামের এই অসুর সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম পাঠ। তারকাসুর সম্পর্কে জানতে গিয়ে পেয়ে গেলাম আরেক অসুরের গল্প, যার নাম হিরণ্যকশিপু। মিথের প্রতি আমার তো বরাবরই আগ্রহ। তা ভারতীয়, গ্রিক, মিশরীয়, আরবীয়, চীনা, রুশ—যে মিথই হোক না কেন। হিরণ্যকশিপু এবং নৃসিংহাবতারের মিথটি খুব আকর্ষণ করল আমাকে।

শ্রীবিষ্ণু ও দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য একদিন ব্রহ্মার মানসপুত্র চতুঃসেন গেলেন বৈকুণ্ঠধামে। দেখলেন, দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে জয় ও বিজয় নামে দুই প্রহরী। তাকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিল তারা। ক্রুদ্ধ হয়ে চতুঃসেন তাদের অভিশাপ দিলেন, অসুরবংশে তোদের জন্ম হবে এবং তিন জন্মে শাপ মুক্ত হয়ে আবার বৈকুণ্ঠে ঠাঁই পাবি।

অভিশাপ অনুসারে তারা দিতির পুত্র হয়ে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু নামে জন্মগ্রহণ করল। বিষ্ণু যখন বরাহ অবতার নেন তখন হিরণ্যাক্ষকে বধ করেন। তাতে ক্রুদ্ধ হলো হিরণ্যকশিপু। ভাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করল। নিজেকে সে অজেয় ও অমর করার জন্য মন্দর পর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করল। তার তপস্যায় ব্রহ্মা প্রকট হয়ে বললেন, হে বৎস, তোমার তপস্যায় আমি মুগ্ধ। বলো কী বর চাও।

হিরণ্যকশিপু বলল, প্রভু, আমাকে অমর হওয়ার বর দিন।
ব্রহ্মা বললেন, শোনো, জগতে কেউ অমর হয় না। তবে তোমাকে এমন বর দেব যা জগতে দুর্লভ। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে তোমার মৃত্যু হবে না, ঘরের ভিতরে বা বাইরে তোমার মুত্যু হবে না, দিনে বা রাতেও তোমার মৃত্যু হবে না, আমার সৃষ্ট প্রাণীগণের দ্বারা তোমার মৃত্যু হবে না, কোনো অস্ত্র তোমায় মারতে পারবে না, যুদ্ধে তুমি সর্বদা অজেয় হবে।

ব্রহ্মার বর পেয়ে বিষ্ণুর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগল অসুররাজ হিরণ্যকশিপু। বিষ্ণুর বিষোদগার শুরু করল। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে সমস্ত দেবতা, অসুর, মনুষ্য, গন্ধর্ব, যক্ষ ও রাক্ষসদের কাছে নিজেকে অজেয় প্রমাণ করল সে। স্বর্গরাজ্য অধিকার করে ইন্দ্রের বাসভবনে রাজা হয়ে অবস্থান করতে লাগল।

হিরণ্যকশিপু যখন মন্দার পর্বতে তপস্যা করছিল তখন দেবরাজ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা তার প্রাসাদ আক্রমণ করেছিলেন। দেবঋষি নারদ তখন হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কায়াদুকে রক্ষা করে নিজ আশ্রমে নিয়ে যান। সেখানে প্রহ্লাদ নামে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় কায়াদু। প্রহ্লাদকে শিক্ষিত করে তোলেন নারদ। তার প্রভাবে প্রহ্লাদ হয়ে ওঠে বিষ্ণুভক্ত। এতে হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে পুত্রকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু যতবারই সে বালক প্রহ্লাদকে বধ করতে যায়, ততবারই বিষ্ণুর আশীর্বাদে প্রহ্লাদ বেঁচে যায়।

পুত্রকে হিরণ্যকশিপু বলল, তোমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। বাঁচতে চাইলে আমাকে ত্রিভুবনের অধিপতি হিসেবে মেনে নাও।
প্রহ্লাদ অস্বীকার করে বলল, আপনি নন, একমাত্র বিষ্ণুই এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ প্রভু। তিনি সর্বত্র বিরাজিত।
হিরণ্যকশিপু তখন একটি স্তম্ভ দেখিয়ে বলল, এই স্তম্ভেও কি তোমার বিষ্ণু আছে?
প্রহ্লাদ বলল, তিনি এই স্তম্ভে আছেন, এমনকি একটি ক্ষুদ্র লাঠিতেও আছেন।

কাশীদাসীর মহাভারতে এই ঘটনার উল্লেখ এভাবে:
ইহা শুনি দৈত্যপতি কহিল পুত্রেরে
কোথা আছে তোর বিষ্ণু, কোন রূপ ধরে।
শিশু বলে, আছে প্রভু সবার অন্তর
অনন্ত যাঁহার রূপ, বেদে অগোচর।
আব্রহ্ম পর্যন্ত্য কীট সকল সংসারে
আত্মরূপে আছে প্রভু সবার ভিতরে।
দৈত্য বলে, বিষ্ণু আছে সবার হৃদয়
সংসার বাহির পুত্র এই স্তম্ভ নয়।
ইতিমধ্যে বিষ্ণু যদি থাকিবে সর্ব্বথা
যথার্থ জানিব তবে তোমার এ কথা।
প্রহ্লাদ কহিল, শুন মোর নিবেদন
যত জীব, তত শিব রূপে নারায়ণ।
স্তম্ভমধ্যে অবশ্যই আছে মোর প্রভু
অন্যথা আমার বাক্য না জানিহ কভু।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে মুসলিম সুফি ইবনুল আরাবির কথা। তার তত্ত্বমতে, সুফি হলেন পরিপূর্ণ বোধসম্পন্ন সেই ব্যক্তি, যিনি উপাসনার প্রতিটি বস্তুতে সত্যের (স্রষ্টা ) প্রকাশ দেখেন; সেটি পাথর, বৃক্ষ, জন্তু, জানোয়ার, ব্যাক্তি বিশেষ, নক্ষত্র বা ফেরেশতা যাই হোক।

সুফিরা মনে করেন, যেদিকে যে বস্তুর প্রতিই দৃষ্টি করি, তাতে তোমাকেই (স্রষ্টা) দেখতে পাই, অন্য আর কিছু দেখি না।
সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমি যেমন বলেন, সর্বত্রই মহান প্রেমাস্পদ আল্লাহর বিকাশ; আর সৃষ্টি সবই পর্দাস্বরূপ। সে হিসেবে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান।

যাই হোক, পুত্রের কথা শুনে হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সামলাতে না পেরে গদার আঘাতে স্তম্ভটি ভেঙে ফেলল। আর তখনই সেই ভগ্ন স্তম্ভ থেকে নৃসিংহের মূর্তিতে প্রকট হলেন বিষ্ণু। ব্রহ্মার বর যাতে বিফল না হয়, অথচ হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করা যায়, সেই কারণে বিষ্ণু নরসিংহের বেশ ধারণ করেছেন। হিরণ্যকশিপু দেবতা, মানব বা পশুর বধ্য নয়, তাই নৃসিংহও পরিপূর্ণ দেবতা, মানব বা পশু নন। হিরণ্যকশিপুকে দিনে বা রাতে বধ করা যাবে না, তাই নৃসিংহ দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণ গোধূলিলগ্নে তাকে বধ করেন। হিরণ্যকশিপু ভূমিতে বা আকাশে কোনো শস্ত্রাঘাতে বধ্য নয়, তাই নৃসিংহ তাকে নিজ জঙ্ঘার উপর স্থাপন করে নখরাঘাতে হত্যা করেন। হিরণ্যকশিপু নিজ ঘরে বা ঘরের বাইরে বধ্য ছিল না, তাই নৃসিংহ তাকে বধ করেন তারই ঘরের দরজায়।

ভাগবতপুরাণে উল্লেখ, হিরণ্যকশিপুকে বধ করে বিজয়ের আনন্দে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসলেন নৃসিংহদেব তথা বিষ্ণু। সকল দেবতা নৃসিংহদেবের ক্রোধ নিবারণে ব্যর্থ হলেন। নৃসিংহকে শান্ত করতে দেবাদিদেব শিব প্রথমে বীরভদ্রকে পাঠালেন। বীরভদ্র ব্যর্থ হলো। এবার স্বয়ং শিব ‘শরভ’-এর রূপ ধারণ করে নৃসিংহকে প্রতিহত করতে গেলেন। শিবের এই ‘শরভ’ রূপটি ছিল মানুষ, পশু ও ঈগলের সংমিশ্রণে, যার সহস্র মুখ, দুটি বিশাল ডানা, আটটি পা ও নানা অস্ত্রে সজ্জিত চারটি হাত।

শুরু হলো শরভ ও নৃসিংহের যুদ্ধ। দুজনের সংঘর্ষে ধ্বংস হতে লাগল গ্রহ-নক্ষত্র, ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল সকল সৃষ্টি। আঠারো দিন ধরে চলল এই যুদ্ধ। এক পর্যায়ে শরভের প্রচণ্ড আঘাতে নৃসিংহ মাটিতে পড়ে যান এবং আত্মসংবরণ করেন। অন্য এক মতে, আদ্যশক্তির সাকার রূপ দেবী পার্বতী গিয়ে নৃসিংহের গায়ে চন্দন রস ছিটিয়ে দেন। তাতে প্রশমতি হয় নৃসিংহের ক্রোধ।

স্বরূপে ফিরে এলেন শিব ও বিষ্ণু। শিব বললেন, হে শ্রীহরি নারায়ণ, আপনি তো জগতের পালনকর্তা, জগতের কল্যাণে আপনি সদা সজাগ। তবু আপনি সিংহ অবতার নিয়ে কেন ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসলেন?
বিষ্ণু বললেন, হে মহাদেব, হিরণ্যকশিপুকে বধ করার আনন্দে আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আপনি শরভ রূপ ধারণ করে আমাকে প্রতিহত করে এই বিশ্বজগতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন। তবে আমার এই লীলার একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটি হচ্ছে, আমি সংসারে এক উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছি যে, বিজয়ের আনন্দে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো অনেক বড় ভুল।

শিব বললেন, ঠিক বলেছেন শ্রীহরি। বিজয়ের আনন্দে যে নিজের বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, সে নিজের ধ্বংসই ডেকে আনে। চলবে