অ ও আ

পর্ব ৫

মো. খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সল

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০১৮

থমথমে দোলাচল পরিবেশে জীবনের কূলে শুধুমাত্র বালিকণা পাওয়া যায় একসময়। জীবনের প্রতিটি অনুচ্ছেদে এক একটি ছোট্ট পদক্ষেপ, ছোট্ট সচেতনতা হাহাকার রয়ে যায়, যেখানে নশ্বর জীবন সাগরের ঢেউয়ের মতো। কাছ থেকে দেখতে গেলে উজানের ঢেউ তলিয়ে দেয় কূলের পাথারে। হারিয়ে যাওয়া গল্পের শব্দচয়ন গুলো অনেকটা মৃদ্যু সঙ্গীতের মতো, যেখানে আলতো ছোঁয়ায় একধরনের পরশ পাথর পাওয়া যায়। আর সেটি অনেকটা বাঙলা চলচ্চিত্রের মতো যেখানে আনন্দ, বেদনা, কষ্ট, দুঃখ, নাট্যক্রিয়া, রসাত্মক মুহূর্ত, আবেগিক সংজ্ঞা’র শৈল্পিক প্রচ্ছদ পাওয়া যায়!

 

ডা. মেহেরুন্নেসার চেম্বারটি দো’তলার করিডরের শেষ মাথায়, হেঁটে গিয়ে এন্ডিং পয়েন্টের সর্বশেষ রুমে বসেন তিনি। রোগী বসার জন্য হলরুমে বেশকিছু চেয়ারের সুব্যবস্থা থাকায় সেগুলো প্রায় সময় ব্যতিব্যস্ত থাকে। ঠিক তেমনি দু’টি চেয়ারে বসে আছে শুভ্র-শুভ্রা। পরিবেশ কিছুটা থমথমে থাকার কথা থাকলেও কিছু কিছু দম্পতি প্রথম সন্তান সহ আসায় ওদের চেঁচামেচি বেশ আওয়াজ দিচ্ছিলো। সে মুহূর্তে ডা. মেহেরুন্নেসা’র রুমের ভিতর থেকে বেশ জোড় আওয়াজের শব্দ হলো, কলিংবেলের শব্দ! কাঁচা পাঁকা চুলের এক মধ্য বয়স্ক লোক ভিতরে ঢুকে গেলেন, মুহূর্তখানিক পরে বেরিয়ে এসে বললেন – “মিস্টার এন্ড মিসেস আশরাফ এসেছেন কি?”

 

পরমুহূর্তে এক দম্পতি উনাদের বছর দু-তিনেক বয়সের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ডা. মেহেরুন্নেসা’র রিস্পেশনের লোকটি উনাদের জন্য দরজা টেনে খুলে দিলেন। বাম হাতে থাকা রেজিস্টার খাতায় ডান হাতের কলম দিয়ে সম্ভবত একটি টান এঁকে দিলেন, হয়তো রোগীর নামটিকে কেটে দিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে খাতার উপর থেকে মুখ উঠিয়ে বললেন- “শুভ্র ও শুভ্রা এসেছেন কি?” কথার জবাবে মধ্য সারিতে বসে থাকা শুভ্র হাত উঁচিয়ে ধরলো। তা দেখে লোকটি জবাব দিলো – “আপনাদের সিরিয়াল এর পরে, তৈরি থাকেন।” জবাবে শুভ্র নিজের মাথাকে বাঁ দিয়ে কাত করে সম্মতি জানালো।

 

শুভ্রা বেশ চুপচাপ বসে আছে, শুকনো মুখে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে। খাঁ খাঁ রোদে আকাশের বুক ছিঁড়ে নিঃসৃত হওয়া বিন্দু বিন্দু জলে তৃষ্ণা নিবারণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যেন সে। শুভ্র শুভ্রার বাহুকে ছোট্ট করে টেনে নিয়ে বললো - “এখনো দুশ্চিন্তায়?”

“জানি না!” খাদ কন্ঠে জবাব দিলো শুভ্রা। 

শুভ্রার জবাবে অনেকটা দমে গেলো শুভ্র, নিজেকে যাহির করতে গিয়েও না পেরে উঠাটা বেশ একগুঁয়ে করে দিচ্ছে মেয়েটিকে। নিজের অপারগতাকে ব্যবচ্ছেদ করতে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে উঠে গেলো শুভ্র, কিছু হেঁটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো জানালার সামনে। যেখান থেকে বাইরের বৃষ্টিস্নাত পরিবেশকে বেশ লাগছিলো, এক হিমেল বাতাসে যেন তখন জাগান দিলো দুনিয়ার বুকে! শুভ্রের আচরণে যার পরনাই অবাক না হয়ে শুভ্রাও নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো জানালার পাশে। দু`জনের নিস্তব্ধতা অনেকটা গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ চৌচির মতো লাগছিলো! সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে শুভ্র বলে উঠলো-

“শুভ্র....”

“বল....”

“নাহ, কিছু না!

এমনি তোকে ডাকতে ইচ্ছে করলো।”

“দেখ, ভণিতা করিস না। বল, কি বলবি?”

“একটু সামনে আয় না! চোখের সামনে এসে বস না একটু!”

“এই কথাটা বলার জন্য তুই চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছিস। এতো ভণিতা করিস না, শুভ্রা!

......চেয়ারে বস, কিছুক্ষণ পরে ভিতরে যেতে হবে।”

 

কথাগুলো যেন যোদ্ধার বর্শার মতো বিঁধে যায় রাতের আকাশে, শিল কুঁড়ানোর জন্যে ঝাঁপ তোলে দোকানের আলোতে। আর, সেই সাথে সাদা বুলেটের বৃষ্টি মাথা খুঁড়ে অন্তর্জালে বেরিয়ে আনে এক নব জীবনকে! শুভ্রা শুভ্রের পিছন থেকে এসে সামনে দাঁড়ায়। আকাশের কালো মেঘের গর্জনের মাঝেও শুভ্রার মায়াবী চোখগুলো আঁকড়ে ধরছে শুভ্রকে! কেমন জানি এক কাকুতি, মায়া আর রহস্যের জালে বাঁধা পরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত! বৃষ্টির শব্দ আর বজ্রের ডাক যেন এক স্নিগ্ধ আবহাওয়ার রূপ দেয়।

 

বেশ কিছু মুহুর্ত পেড়িয়ে গিয়েছে শতাব্দীর মাঝে, সময়ের টের ততক্ষণ পাওয়া গেলো না যতক্ষন না ডা. মেহেরুন্নেসার কম্পাউন্ডারের হাঁক শোনা না গেলো! খানিকটা চিৎকারের সাথে বলে উঠতে লাগলো – “শুভ্র সাহেব, এই যে মিস্টার শুভ্র, শুভ্র সাহে.....”

এমন চেঁচানো কন্ঠের ডাক শুনে হুড়মুড় করে বাস্তবে যেন ফিরে এলো শুভ্র ও শুভ্রা। নিজেকে তটাস্থ করে জবাব দিলো – “এভাবে চিৎকার করছেন কেনো ভাই?”

“আরে মিয়া, আপনে তো বড্ড আজব মানুষ! কতক্ষণ ধরে ডাকছি আপনাকে, কথা যেন আপনার কানে যায় ই না! দুইজনে জানলা দিয়া কি বিয়া দ্যাখতেছিলেন নাকি?”

“.......যাই দেখি ওটা আমাদের ব্যক্তিগত। এখন বলেন এভাবে ঝটিতে ডাকছিলেন কেন?”

“রোগী কি দ্যাখবেন নাকি.....” কম্পাউন্ডারের কথা শেষ হবার আগে রুমের বাইরে থাকা কলিংবেল দ্বিতীয় বারের মতো বেজে উঠলো। দ্বিতীয়বার বেজে উঠাতে মধ্য বয়স্ক কম্পাউন্ডারে হিসেবে নিয়োজিত লোকটি হকচকিয়ে গেলো, তটস্থ হয়ে বলতে লাগলো – “আরে ভাই, চলেন। ঢুকেন ভিতরে। এই নিয়া ম্যাডাম দ্বিতীয়বাব বেল বাজাইছে! .......তাড়াতাড়ি ঢুকেন।”

 

পরমুহূর্তে শুভ্রা’র ডান হাত টেনে নিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো, আর নিজে দাঁড়িয়ে রইলো রুমের বাইরে। রুমের ঢোকার পূর্বে এক নজর কাজল দেওয়া বড় বড় হরিণী চোখগুলো দিয়ে শুভ্র চেয়ে উঠলো শুভ্রের চোখে, মুহূর্তের মাঝে যেন শতাব্দীর শত বেদনা বিনা বাক্যে বয়ে গেলো লোনা পানি হয়ে!

“কিরে ভাই, আপনে যান না কেন ভিত্রে? বউরে কি কেউ এমনে একলা পাঠায়া দেয় নাকি?

............পরথম বাচ্চা আপনাদের, উনার সাথে আপনার থাকা উচিত, উনি ভরসা পাবে আপনারে দেইখা। শুধুমাত্র এই সময়টাতে স্বামীকে স্ত্রীর সাহস বাড়ানোর জন্য শক্ত মনোবল নিয়ে খাঁড়ায়া থাকতে হয়। বুঝলেন বেটা জি?” কম্পাউন্ডার লোকটি বলে উঠলো সে দৃশ্য দেখে।

 

লোকটির দিকে চেয়ে শুধু মাথাটা ডান দিকে কাত করে জ্ঞাপকতা নির্দেশ করে পিছনে মোড়ে হেঁটে চললো শুভ্র। কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট সমস্যা সম্মুখীন হয়েছে কিন্তু আজকের এই সমস্যা যেন ইহকাল, পরকালের পাপের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে অসহায় ভাববে নাকি অপরাধী তা নিয়ে নিজের মাঝে এক গৃহ যুদ্ধ খেলে যাচ্ছে শুভ্র। হাঁটতে হাঁটতে আবারো সেই হলরুমে বড় বড় জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো, যেখানে কিছু মুহূর্ত আগেও এক ঐশ্বরিক পরিবেশ কাজ করছিলো। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলার পরমুহূর্তে পকেট থাকা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠে। ফোনটি পকেট থেকে তুলে নিয়ে স্ক্রিনে ভাসা নামটি পড়ে বা হাতের ঘড়িতে নজর দিয়ে মুচকি হাসি দেয় সে। রিসিভ করার মাত্র অপর প্রান্তের জবাবে বলে উঠে – “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

“স্যার, আপনাকে দেওয়া ৪৮ ঘন্টার আগে আমি কাজ করতে পেরেছি স্যার। We just trace the bustard. The mothefucker’s location is on Dhaka at Mirpur 2.

What? Seriously, mizan?

…….you got the son of a bitch? Send me the location right now. I wanna grab the motherfucker and kill that bustard. Send me the location, now!”

“স্যার, মূলত হান্টিং এখন শেষ হয়নি। বেসিক লোকেশন পেয়ে আরো কিছু সময় লাগবে স্যার। সোর্সের তথ্য মতে আজকে ‘ও’ ঢাকার এসেছে প্রায় ৪-৪.৫ মাস পর, নতুন শিকারের লোভে! এবং শুনেছি স্যার, এবারের শিকার নাকি বেশ টাকা-পয়সাওয়ালা। আগেরটার মতো.....”

মিজানের কথা অসমাপ্ত রেখে শুভ্র ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো – “মিজান, Don’t you dare to talk about shuvra! I will tear you apart, be careful, just be careful!”

“...........না, না, স্যার! একদম না স্যার। আমি শুভ্রা ম্যাডামকে নিয়ে কিচ্ছু বলে নি, আমি তো শুধু উনার সাথে হওয়া দূর্ঘটনা......”

“মিজান, তোমার অ্যাকাউন্টে আজকের সোর্সের জন্য দ্বিগুণ অঙ্ক পৌঁছে যাবে।

......ধন্যবাদ তোমাকে।”

“স্যার, স্যার.....প্লিজ....প্লিজ স্যার। আমি কিন্তু শুভ্রা ম্যাডামকে উল্লেখ করে কিছু বলি নাই।.....স্যার, আমি স্যরি........” কথা শেষ করার আগে অপর প্রান্ত থেকে টং টং টং আওয়াজে বেজে আসতে লাগলো, মিজানের এক গাঢ় দীর্ঘশ্বাস শুধু অক্সিজেনের সাথে মিশে গেলো।

মিজানের কথাগুলো এখনো কানে বাজতে লাগলো, সেদিনের ঘটে যাওয়া স্মৃতি, দুঃস্মৃতিগুলো মুহূর্তে মাঝে হানা দিলো শুভ্রের মস্তিষ্কের। কি এক নিদারুণ তান্ডব চলছিলো তা শুধু অন্তরীক্ষে থাকা সত্তা ভালো জানেন!

সামনে থাকা চেয়ারটি টেনে বসে গেলো শুভ্র, সমুদ্রের লোনা জলের স্বাদ আজকে দ্বিতীয়বারের মতো হদিস পাওয়া গেলো আবারো, নতুন করে!