মুহম্মদ মোফাজ্জল

মুহম্মদ মোফাজ্জল

বিত্তের আবরু খুলে দ্যাখা উলঙ্গ নাগরিক সভ্যতা

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে চাকরি। যে মেধাবী ও পরীক্ষার ফলাফল ভালো, তার উদ্দেশ্য আরও সুনির্দিষ্ট। আর তা হচ্ছে, বিসিএস ক্যাডার হওয়া। সবমিলিয়ে শিক্ষা অর্জনের স্বাভাবিক উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি। পরিবারের অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদেরকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে উৎসাহী করে তোলেন। সন্তানদের তারা বলেন, ‘পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারলে ভালো চাকরিও পাবি না।’ এই ভালো ফল করতে গিয়ে অভিভাবকদের আহাম্মকির কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। আমরা প্রায়ই সংবাদপত্রে পড়ি, পরীক্ষায় জিপিএ ৫ না-পাওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। কেন তারা আত্মহত্যা করে, তা আমাদের সবারই জানা। প্রথমত, পারিবারিক চাপ। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন ধারণা তৈরি করে দিয়েছে যে, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে না পারলে জীবন বৃথা। বৃথা কারণ, ভালো ফলাফল না হলে তো ভালো চাকরি জুটবে না। আবার, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ না পেলে চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধে বাড়বে না।

সমাজ ও পরিবারের এই চাপ মাথার ওপর নিয়ে দেশের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। পড়াশোনাটা যেন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় সন্তান যেন পিছিয়ে না পড়ে সেজন্য অভিভাবককে তার পেছনে ঢালতে হচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। প্রচলিত এই সিস্টেমে ছোটবেলা থেকেই একজন শিক্ষার্থী বুঝে যায় যে, তার পেছনে সমাজ ও পরিবারের অদৃশ্য একটি চাবুক রয়েছে। যে চাবুক তাকে তাড়া করে ফিরছে। এই চাবুকের ভয়েই শিক্ষার্থী দৌড়চ্ছে। যেন সে ঘোড়া। কিন্তু মানুষ তো ঘোড়া নয়। সত্যি যে, এই সিস্টেমের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম মানুষ হয়ে ওঠেনি। ঘোড়াও হয়ে ওঠেনি। হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক মানুষ। এই মানুষের অনুভূতি আছে কিনা, তা সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণে না গেলে বোঝা মুশকিল।

পড়াশোনা শেষে দেশের সকল জেলা থেকে ছেলেমেয়েরা জড়ো হয় রাজধানী ঢাকাতে। খুঁজতে শুরু করে চাকরি। খেয়ে না-খেয়ে তারা জোঁকের মতো লেগে থাকে এই শহরের বুকে। চাকরি না পেলে কোন মুখে সে গ্রামে ফিরে যাবে? গ্রামবাসীর কাছে পরাজিত মুখ সে দেখতে দিতে চায় না। অভিভাবকদের কাছেই বা তার বলার কী থাকবে! এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পাশাপাশি তার ভেতর কাজ করে মোহ। শহরের নাগরিক জীবনের প্রতি মোহ। এই চিত্র দেশের বৃহত্তর সমাজের। বলতে কি, এই শ্রেণির বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কৃষক পরিবারের সন্তান। কৃষি থেকে উপার্জিত টাকা দিয়েই তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ‘শিক্ষত’ হওয়ার সার্টিফিকেট অর্জন করে। এখানে একটি প্রশ্ন রাখা যায়। আর তা হলো, ঢাকায় ভিড় না জমিয়ে তারা তো গ্রামে কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। তা কেন করে না? এ প্রসঙ্গে আমার পরিচিত একটি ছেলের কথা বলা যেতে পারে। ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে। কোম্পানির প্রধান হিসাব রক্ষক সে। বেতন পায় ষাট হাজার টাকা। এখনো বিয়ে করেনি। অফিসে ঢোকে সকাল ৯টায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০-১১টা বেজে যায়।

প্রায় দিনই থাকে ফিল্ড ওয়ার্ক। ফলে কোম্পানির দেয়া মটরসাইকেলে চেপে তাকে রাজধানীর নানা প্রান্তে ঘুরতে হয়। সারা দিনের কাজ সেরে যখন ছেলেটি বাসায় ফেরে, তখন সে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। বাইরে থকে আনা প্যাকেটজাত খাবার কোনোমতে গলাধঃকরণ করে অবসন্ন দেহটাকে বিছনায় এলিয়ে দেয়। এরপর ল্যাপটপ খুলে বসকে ই-মেইল করতে হয় দিনের আয়-ব্যায়ের হিসাব। এরপর ঘুম। পরদিন সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠেই ছুটতে হয় অফিসে। এই ছেলের বাবা কৃষক। মোটামুটি সচ্ছল কৃষক। অথচ ছেলেটি কৃষিকে তার পেশা হিসেবে গ্রহণ করেনি। বিষয়টি জানতে চাইলে ছেলেটি আমাকে বলেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে আমি করবো কৃষিকাজ? তাহলে আর লেখাপড়া করলাম কেন! আরে ভাই, গ্রামের লোকজনও তো বিষয়টা ভালোভাবে নেবে না। পরিবারের কথা না-হয় বাদই দিলাম।

ছেলেটির কথায় যুক্তি আছে। সেই যুক্তি কি, তা আর নিশ্চয়ই ভেঙে বলে দিতে হবে না। এই শ্রেণির পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণি রয়েছে। এরা ঢাকার বুকে বসবাসকারী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তান। এসব ছেলেমেয়ের ভেতর মফস্বলের ছেলেমেয়েদের মতো বিত্ত-বৈভবের প্রতি মোহ নেই ঠিকই, কিন্তু যা আছে তা আরও ভয়ংকর। তা হচ্ছে, ঘেন্না। চাষাভুষার প্রতি এক রকমের অবজ্ঞা। কোনো ব্যক্তির আচরণ তাদের কাছে নগরসভ্যতার বিপরীত মনে হলেই তারা বলে ওঠে, ব্যাটা খ্যাৎ। মানে, চাষের খেত থেকে উঠে এসেছে, এমন অর্থে। এই শ্রেণির পাঁচ শিক্ষার্থীর অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনি নিয়ে মুহম্মদ মোফাজ্জলের উপন্যাস ‘চাষাভুষার সম্মান’। সময় প্রকাশন থেকে এবার বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শিরোনামটি পড়লে মনে হয়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সময়ের কোনো উপন্যাস হাতে নিয়ে বসেছি। এই খুঁতখুঁতানি নিয়েই পড়তে শুরু করলাম কাহিনি। দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ডলার, প্রিন্স, ইভান, জেনিফা ও শ্যামল। শ্যামল গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে ঢাকায় এসেছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। কিন্তু বাকিরা ঢাকা শহরের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। বিত্তবৈভবে ডুবে যারা ভুলেই গেছে গ্রামের সহজ-সাধারণ জীবনযাত্রা।

তারা জানেই না, প্রতিদিন তাদের খাবার টেবিলে সুস্বাদু যেসব খাবার পরিবেশন করা হয় সেসব খাবার আসে কৃষকের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। তারা কেবল জানে, এসব খাবার যে কোনো সুপার শপে গেলেই কিনতে পাওয়া যায়। মুহম্মদ মোফাজ্জলের কৃতিত্ব হচ্ছে, যে জেনারেশন বর্তমানে ঢাকার বুকে বেড়ে উঠছে তাদের স্বরূপ নিখুঁতভাবে তিনি ধরতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন। এই বোঝাপড়ার ভেতর দিয়েই উপন্যাসটিতে তিনি তিন তরুণ ও এক তরুণীর চরিত্র চিত্রণ করেছেন দক্ষ শিল্পীর আঁচড়ে। এই প্রজন্ম জানেই না, ঢাকার জনজীবন আসলে ভাসমান। ঢাকাবাসী আসলে শেকড়চ্যুত। ঢাকায় বসবাসকারী বর্তমান প্রজন্ম তাই অস্থির। জীবনের প্রগাঢ় কোনো অনুভূতি তারা লালন করে না। আর তাই সহপাঠী শ্যামলকে ডলার, প্রিন্স, ইভান ও জেনিফা চাষার পুত বলে অবজ্ঞা করে। খ্যাপায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়ে খুব সিঁটিয়ে থাকে শ্যামল। ওই চার সহপাঠীকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। কিন্তু তা কী আর হয়! একই সেমিস্টারে যখন তারা পড়ছে তখন দেখা-সাক্ষাৎ তো হবেই। কিন্তু দেখা হলেই কৃষক পরিবারের সন্তান বলে তাকে তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। বিষয়টি একটা সময়ে এসে মানসিকভাবে ভীষণ পীড়াদায়ক হয়ে উঠল শ্যামলের কাছে।

শেষমেষ অনেক ভেবেচিন্তে সে হাজির হলো পুলিশ কমিশনারের দপ্তরে। ভাগ্যক্রমে তার প্রতি সদয় হলেন পুলিশ কমিশনার সাঈফ আদনান। শুনলেন শ্যামলের মনোঃপীড়ার কারণ। সেও কৃষকের সন্তান। ফলে আরেক কৃষকের সন্তান শ্যামলের অপমান সাঈফের কাছে হয়ে উঠল সকল কৃষক-সন্তানের অপমান। কিন্তু কেবলমাত্র চাষার পুত বলে কাউকে খ্যাপানোর অপরাধে কারো বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তবে মানহানির মামলা হতে পারে। যাই হোক, ডলার, প্রিন্স, ইভান ও জেনিফাকে গ্রেফতার করে কোর্টে তুললেন সাঈফ। মামলার বিষয় তেমন গুরুতর নয় বলে কোর্ট তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ দিল। এজন্য দায়িত্ব দেয়া হলো পুলিশ কমিশনের কার্যালয়কে। সাঈফ চারজনকে নিয়ে একটি বাড়িতে গিয়ে তুললেন। ডলার, প্রিন্স ও ইভানকে একটি কক্ষে আটকে রাখলেন। জেনিফাকে আরেক কক্ষে। কিছুই খেতে দিলেন না। এভাবে চলতে থাকল। খিদেয় কাতরাতে লাগল তারা। কাতর স্বরে কিছু খাবার বারবার চাইতে লাগল। কিন্তু বাইরে থেকে তাদেরকে বলা হলো, আমরা যেসব খাবার খাই তার সবই কৃষকদের উৎপাদিত। যে কৃষকদের প্রতি এত ঘেন্না, সেই কৃষকদের উৎপাদিত খাবার তো তাদেরকে দেয়া হবে না।

এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের পরনের সকল পোশাক বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে স্ক্যান করা হলো। তাতে দেখা গেল, সকল পোশাকই বাংলাদেশে তৈরি। যদিও সেসব পোশাক পশ্চিমা দেশগুলো থেকে কেনা। তবে সেখানকার বায়াররা বাংলাদেশ থেকেই তৈরি পোশাক তাদের দেশে নিয়ে গেছে। এসব জেনে ভীষণ অবাক হয় ধনাঢ্য তিন তরুণ ও এক তরুণী। খুলে পড়ে তাদের আভিজাত্যের আবরু। সংশোধনের পরের পর্যায়ে সাঈফ তাদের বাপ-দাদার ঠিকুজি তাদেরকে জানান। এসব তথ্য সে তার সহকারীকে দিয়ে আগেই সংগ্রহ করে রেখেছিল। তাতে দেখা যায়, প্রত্যেকের পিতাই আসলে কৃষক পরিবারের সন্তান। কারো পিতা আবার ভূমিহীন বর্গাচাষির সন্তান। লেখাপড়ায় ভালো বলে তাদেরকে কৃষিকাজে লাগানতি তাদের পিতারা। মানে নতুন প্রজন্মের দাদারা। আমাদের সমাজে এমনটাই স্বাভাবিক। ছেলে পড়াশোনায় ভালো হলে তাকে দিয়ে সংসারের কাজ তেমন একটা করানো হয় না। কৃষক বাবা একাই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জমিতে ফসল ফলান। সন্তানের পড়ালেখায় ক্ষতি হবে ভেবে সন্তানকে কখনোই জমিতে কৃষিকাজে লাগান না। সাঈফ তাদেরকে সংশোধন করে দিয়ে বলেন যে, আপনারা সবাই কৃষকের সন্তান। লেখাপড়া শিখে নিজের বুদ্ধিতে আপনাদের বাবারা চাকরি শুরু করেন। কিন্তু আরও বিত্তবৈভবের আকাঙ্ক্ষায় চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় শুরু করেন। কারো কারো ব্যবসা অসৎ পথের। এসব জেনে লজ্জিত হয় ডলার, প্রিন্স, ইভান ও জেনিফা।

এর পরের পর্যায়ের সংশোধনীর জন্য সাঈফ তাদেরকে নিয়ে যায় হাওর অঞ্চলে। সেখানে একটি কৃষক পরিবারে এক সপ্তাহ তাদেরকে রাখা হয়। সেই বাড়িতে থেকে তারা কৃষকজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ওই বাড়ির কৃষকের সঙ্গে তারা মাঠে হালচাষও করে। মাঠপর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝতে পারে, কী অমানুষিক পরিশ্রম করে কৃষক তাদের মতো ভদ্রলোকদের মুখে আহার তুলে দেয়। কৃষক না থাকলে একদিনও টিকে থাকতে পারতো না আজকের সভ্যতা। যান্ত্রিকতা কিংবা প্রযুক্তির অবদানের কথা যতই আমরা বলি না কেন, সবার আগে কৃষি। অথচ এই কৃষকদেরকেই কথায়-কথায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা রয়েছে ঢাকা শহরে গড়ে ওঠা বর্তমান সুশীলদের। সাঈফ আদনানের মনে পড়ে, নামকরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক একবার বলেছিলেন, “আমরা চাষাভুষার সন্তান নই, আমাদের সম্মান করে কথা বলুন।” বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলছেন যে, চাষাভুষা হলে তাকে অসম্মান করা যায়। উপন্যাসটির কাহিনি যেন চাবুকের ঘা। এই ঘা শপাৎ করে এসে আঘাত করে আমাদের চেতনায়। আর ভেঙে দেয় বিত্তের অহঙ্কারে নির্মিত প্রাসাদের কংক্রিট ভিত।

পাঠক বুঝতে পারেন, জীবন বাঁচাতে ও জীবন সাজাতে পৃথিবীতে যত প্রোডাক্ট ও বাই-প্রোডাক্ট উৎপাদন করা হয়, তার সবকিছুর মূলে রয়েছে কৃষকের আবাদ। ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, সবজি কিংবা যত রকম খাবারই আমরা খাই না কেন, খাবারের টেবিলে পরিবেশনের আগপর্যন্ত এগুলোর প্রতিটার পেছনে একটা গল্প আছে। সেসব গল্প কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের কায়িক শ্রম, হাসি ও কান্নার। কিন্তু শেকড়চ্যুত ঢাকার অভিজাত নাগরিকরা এসব কথা ভুলে যেতে চায়। ভুলে যেতে চায় তাদের পেছনের ইতিহাস, কৃষকজীবনের অধ্যায়।

সাঈফ আদনানের ভেতর ভাবনার ঢেউ ওঠে, নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট শিক্ষার্থীর চাকরির বায়োডাটার ওজন বাড়ায় ও নজর কাড়তে সাহায্য করে। কিন্তু সে যদি মানুষকে বুঝতে ও সম্মান করতে না শেখে, তাহলে যে কোনো বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তার অর্জিত সার্টিফিকেট ও জ্ঞান প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। জাতির খাদ্যের চাহিদা পূরণে কিষাণ-কিষাণীর অবদানকে ভুলে যারা তাদেরকে খাটো চোখে দেখে, তারা অনেক বড় ডিগ্রিধারী হওয়া সত্ত্বেও মূর্খই রয়ে গেছে। এসব মানুষ আসলে নিজেদেরকেই ছোট করে। কারণ, তারাও চাষাভূষার বংশলতা। উপন্যাসের শেষে এসে মুহম্মদ মোফাজ্জল প্রশ্ন তোলেন, সকল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর খরচ আসতো খেতে উৎপাদিত ফসল বেচার টাকা থেকে। কৃষিভিত্তিক সেই ভিত্তিমূলের কথা আজকের প্রতিষ্ঠিত প্রজন্ম কি মনে রেখেছে?

এই প্রশ্ন পাঠকে কাতর করে তোলে। কারণ আমরা জানি, এই প্রজন্ম কৃষিভিত্তিক সেই জীবনের কথা ভুলেই থাকতে চায়। মনে রাখা তো অনেক দূরের কথা। যে শ্যামলের অভিযোগে সাঈফ আদনান তিন তরুণ ও এক তরুণীর চেতনার জগৎকে সংশোধন করে দেন সেই শ্যামলও কিন্তু তার পিতার কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে না। সেও আসলে চায় এই ঢাকা শহরেই কর্পোরেট জীবনযাপন করতে। এই দিকটি কিন্তু ঔপন্যাসিক তার কাহিনিতে তুলে আনেননি। ফলে দেখা যাচ্ছে, মুদ্রার একটি পিঠের চিত্রই আমরা তার উপন্যাসে পাচ্ছি। আরেক পিঠে রয়ে গেছে কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা সন্তানরা যে কোনো প্রকারেই হোক না কেন, ছুটছে একটা চাকরির পেছনে। নয়তো ঢাকার বুকে বসে কোনো ব্যবসা চালাতে চেষ্টা করছে। কখনোই ভাবছে না গ্রামে ফিরে গিয়ে চাষাবাদ করবে। ঔপন্যাসিক যদি জেনিফাদেরকে হাউর অঞ্চলে না নিয়ে সমতলীয় কোনো গ্রামে নিয়ে যেতেন, তাহলে দেখা যেত ভিন্ন চিত্র। সেই চিত্র হচ্ছে, বর্তমানে গ্রামের শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। বাকি অংশের নিজস্ব কৃষিজমি থাকলেও তা তারা চাষ করে না। তারা চাকরিজীবী নয়তো ব্যবসায়ী। এটাই আজকের সমাজ বাস্তবতা।

দিন দিন কৃষির ওপর থেকে মানুষ হাত তুলে নিচ্ছে। অথচ বাজারে কৃষিজ পণ্যের দাম খুবই চড়া। কৃষিতে খাটনি আছে ঠিকই, তবে টাকাও আছে। আর ঢাকার বুকে বসে যে কর্পোরেট জীবন কাটাচ্ছে এই প্রজন্ম, সেই জীবনে কতটুকু স্বস্তি আছে তা ভেঙে বলতে হবে না। সহজেই আমরা বুঝতে পারি। শিক্ষিত হওয়ার মানে চাকরি করতে হবে, এই মনোভাব আমাদের জাতীয় মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। অথচ সহজ কথা হচ্ছে, শিক্ষিত হয়ে কেউ যদি কৃষিকাজ করে তাহলে সে সাধারণ একজন কৃষকের চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে পারবে। কেননা, সেই শিক্ষা সে পেয়ে এসেছে। অথচ তা না করে শিক্ষিতের দল ঝাঁকে ঝাঁকে ভিড় জমাচ্ছে ঢাকার বুকে, নগরসভ্যতার সারথি হতে। মুহম্মদ মোফাজ্জলের উপন্যাসটিতে সমাজের এই দিকটি উঠে এলে সমস্যাটির সামগ্রিক চিত্র পাঠক পেত। তবে যে বিষয়টি নিয়ে তিনি কাহিনি বুনেছেন, তা নিয়ে এ দেশের কথাসাহিত্যিকরা খুব একটা লেখেন না। সমাজের সঙ্কটগুলো বেশিরভাগ লেখক উপেক্ষা করে যান। এই বিবেচনায় মুহম্মদ মোফাজ্জল ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। চমৎকার একটি বিষয়কে কাহিনিরূপ দেয়ার জন্য পাঠক হিসেবে লেখককে আমার আন্তরিক ভালোবাসা জানাচ্ছি।

আলোচক পরিচিতি: কবি, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক

একুশে বইমেলা ২০১৮