রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করতে হবে

কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৮, ২০২৪

পৃথিবীর প্রথম কবিকে কবিতা লেখা তে শিখিয়েছে— এরকম কথা যারা বলে তাদের বলার মধ্যে এমন একটা ঔদ্ধত্য দেখতে পাই, মনে হয় যারা কবিতার ব্যাকরণ-প্রকরণ শেখার কথা বলে তারা নিতান্তই কবিতা-মূর্খ। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, নিজেদের অজ্ঞতা ও শেখার অনাগ্রহ আড়াল করার জন্যই তারা এসব কথা বলে।

এ যাবৎ আমরা যেসব প্রাচীন কবির কথা জেনেছি তাদের মধ্যে মেসিপটেমিয়া সভ্যতার আক্কাদ সম্রাট সারগন ও তার স্ত্রী তাশলুলতুমের কন্যা এনহেদুয়ানাই পৃথিবীর প্রথম কবি। এনহেদুয়ানা কি জানতেন, তিনি কবিতা লিখেছেন? না, তিনি দেবি ইনানার স্তুতি করে কিছু কথা বলেছেন। সেসব কথা কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে পাথরে খোদাই করে লিখেছেন।

কালক্রমে বোদ্ধারা, পণ্ডিতেরা সেসব কথা উদ্ধার করে ঘোষণা করেন, এগুলো কাব্যস্লোক। মানে, কবিতা। এসব কথার মধ্যে ছন্দ আছে, ইঙ্গিত আছে, প্রেম আছে, সমর্পণ আছে, প্রার্থনা আছে, যা আদি কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

কালক্রমে আমরা যখন জানলাম ছন্দ কবিতার একটি প্রধান উপকরণ, তখন ছন্দকে গাণিতিক শুদ্ধতার ছাঁচে ফেলে একটি ফর্মুলা তৈরি করে নিলাম। পরবর্তীতে এই ছাঁচে ফেলে দেখা গেল, অনেক প্রাচীন কবিতাই পুরোপুরি শুদ্ধ ছন্দে রচিত হয়নি। কারণ তারা এই গাণিতিক শুদ্ধতা জানতেন না। যেমন বাংলা ভাষার প্রাচীন কবিতা চর্যাপদে ব্যবহৃত মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রচুর অশুদ্ধতা রয়েছে।

অশুদ্ধতা থাকাই স্বাভাবিক। কারণ, চর্যাপদের কবিরা ছন্দের ব্যাকরণ জানতেন না। তাদের অন্তরে যে প্রাকৃতিক ছন্দ ছিল সেই ছন্দেই তারা লিখেছেন, সেখানে বৈজ্ঞানিক শুদ্ধতার অভাব থাকতেই পারে। কিন্তু যখন আমরা বৈজ্ঞানিক শুদ্ধতা শিখে ফেলেছি তখন কি আর শুদ্ধ/অশুদ্ধ প্রাকৃতিক ছন্দে কবিতা লিখব?

একজন বাউল বাংলার পথে পথে হাঁটেন আর গান করেন। তিনি সারগাম শেখেননি, মনের খেয়ালে গান করেন। সেই গান আমাদের শুনতে ভালোও লাগে। কিন্তু সেই গানের তালে, সুরে, ছন্দে, লয়ে প্রচুর ব্যাকরণগত ভুল থাকে। যখন আমরা পেশাদার স্টুডিওতে সেই গানটি একজন পেশাদার আধুনিক শিল্পীর কণ্ঠে নির্মাণ করি তখন ত্রুটিগুলো শুধরে নিয়ে ব্যাকরণ সম্মত তাল, লয়, ছন্দেই তৈরি ও পরিবেশন করি।

যিনি প্রথম রেডিও বানিয়েছেন, যিনি প্রথম কম্পিউটার বানিয়েছেন, যিনি প্রথম অ্যারোপ্লেন বানিয়েছেন তারা আমাদের নমস্য। যেমন নমস্য লুই পা, সবর পা, কুক্কুরি পা`র মতো চর্যাপদের লেখকেরা। কিন্তু তাদের প্রথম নির্মাণের ত্রুটিগুলো থেকে আমরা কি প্রতিনিয়ত উত্তরণ ঘটাইনি? এখন কি আমরা প্রথম বিমানের মতো বিমান বানাই? বানাই না। কারণ আমরা এখন আরও উন্নত বিমানের প্রযুক্তি (মানে ছন্দ) শিখে গেছি।

আজকের কবি, একজন আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক কবি, কিছুতেই একথা বলবেন না যে, পৃথিবীর প্রথম কবিকে কবিতা লেখা কে শিখিয়েছে? কবিতা হাজার হাজার বছরের অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে আজকের কবি হিসেবে আমাকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে।

আপনি যদি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদদীন, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ করি, তাদের চেয়ে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব নয় এবং আমি তাদেরই অনুসরণ করবো, তাহলে আপনি প্রথমেই আত্মসমর্পণ করলেন এবং নিজেকে একজন ব্যর্থ কবি হিসেবে স্বীকার করে নিলেন। কবি হিসেবে আপনার প্রধান কাজ হলো, পূর্বসূরীদের অপূর্ণতা খুঁজে বের করা এবং তা পূর্ণ করা।

আপনি যদি তাদের চেয়ে উন্নত কবিতা লিখতে না পারেন তাহলে আজকের পাঠক কেন আপনাকে পড়বে? আপনি যদি নজরুলের কবিতাই লিখেন তাহলে পাঠক কেন নকল নজরুল পড়বে যখন আসল নজরুলই তাদের লাইব্রেরিতে রয়েছে?

আমি একবার বলেছিলাম, কবি হিসেবে আমার উচিত হবে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা। অনেকেই এতে আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এই অস্বীকারের অর্থ তাকে অশ্রদ্ধা করা নয়, তার কবিতাকে আমার কবিতার পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা বা বাতিল করা। আমাকে এমন কবিতা লিখতে হবে যা তিনি লিখতেই পারেননি কিন্তু পাঠকের কাছে এই নতুন কবিতার কদর রয়েছে।

আমি বলেছিলাম, আমাদের আজকের রাজনীতিবিদদের উচিত হবে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানের চেয়ে বড়ো, বিচক্ষণ, উদার, দেশপ্রেমিক ও নৈতিক নেতা হওয়ার চেষ্টা করা। আমরা যদি মেনে নেই যে, তাদের চেয়ে বড় নেতা হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে দেশ এগুবে কী করে? ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের চেয়ে ভালো ও শুদ্ধ কবিতা যদি আজকের কবিরা লিখতে না পারেন তাহলে বাংলা কবিতা এগুবে কী করে?

হলিসউড, নিউইয়র্ক
১৭ এপ্রিল ২০২৪