‘নব্বই দশকের কবিতা: সমকালীন পাঠ’ সঙ্কলনের প্রচ্ছদ

‘নব্বই দশকের কবিতা: সমকালীন পাঠ’ সঙ্কলনের প্রচ্ছদ

কাজী নাসির মামুনের গদ্য ‘নব্বইয়ের কবিতা: একটি সরল সমীকরণ’

প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০২৪

কবিতা কোনো কালখণ্ডে বন্দি নয়, নদীর স্রোতের মতো বহমান। এরপরও সময়ের এক একটি খণ্ডে কবিতার রূপ ও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতেই দশকভিত্তিক কালবিভাজন করা হয়। এর সুবিধে হচ্ছে, কবিতার ধারাবাহিক যাত্রাটি সহজে বুঝতে পারা যায়। কখন, কীভাবে চলমান ধারা থেকে কবিতা ভিন্ন আঙ্গিকে বাঁক পরিবর্তন করলো, সেই সূত্রটিও এর মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকটি ছিল বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে নানামাত্রিক ভাঙচুরের সময়। এই কালখণ্ডে একঝাঁক তরুণ লিখতে শুরু করেন কবিতা। ২৪ বছর পেরিয়ে এসে তাদের লিখিত কবিতার রূপ ও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন নব্বই-উত্তর কয়েকজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের কবিতা কি স্বকীয় কাব্যভাষা নির্মাণ করতে পেরেছে? আমাদের ভূরাজনৈতিক সমাজজীবনের করুণ আর্তনাদ নব্বইয়ের কবিতায় কিভাবে চিত্রিত হয়েছে? সময়ের মর্মভেদী উৎকর্ষ চেতনায় নব্বইয়ের কবিরা কি কেবল নিরীক্ষাই করেছেন, নাকি উজ্জীবিত প্রাণের ধ্বনিময়তাও ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন কবিতার শরীরে। নব্বই দশকের কবিতা: সমকালীন পাঠ সঙ্কলনে অগ্রজদের সফলতা ও ব্যর্থতার শিল্পসীমানা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন তাদেরই উত্তরসূরীরা। এটি সম্পাদনা করেছেন আবু তাহের সরফরাজ। বইমেলায় সঙ্কলনটি পাওয়া যাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষাচিত্রের ৩৩ নং প্যাভিলিয়নে। সঙ্কলনটির ভূমিকা লিখেছেন প্রথম দশকের মেধাবী কবি কাজী নাসির মামুন। ‘নব্বইয়ের কবিতা: একটি সরল সমীকরণ’ শিরোনামের ভূমিকাটি এখানে প্রকাশ করা হলো।

জীবনের প্রথম চিন্তা— যাপন। দ্বিতীয় চিন্তা— উদ্‌যাপন। যাপিত জীবনের মধ্যে উদ্‌যাপনের মহিমা দেবার জন্যেই কবিতা লিখি এবং পড়ি। যতই সংলগ্ন হই, যাপিত জীবন আসলে একার। উদ্‌যাপন বহুর সঙ্গে মিলেমিশে হয়। যখন কবিতা পড়ি তখন কবির চিন্তা বোধ বিবেচনা স্মৃতির সন্তরণ বর্ণিল চিত্রকল্প উপমা অনুষঙ্গ হাসি কান্না ও অন্যান্য সংবেদনার মর্মমূলে নিজেকে বসিয়ে দেখি, বিভাময় হয়ে উঠেছে আমার জীবন। তখন মনে হয় আমি একা নই, অনেকের সঙ্গে একাকার। মহামিলনের এই সমাধিক্ষেত্রে আমার ’আমি’র এইভাবে মৃত্যু হলে ঠিক বুঝে ফেলি, আমার উজ্জীবন আসলে অনেকের রঙে রঙিন। হতে পারে তার হাসির সঙ্গে আমার কান্নার সর্ম্পক, কান্নার সঙ্গে হাসির। তার সংবেদনায় আমার হয়তো ভিন্ন অভিমত। তার চিত্রকল্পে আমার চোখ হয়তো অন্য কথা বলে। তার উপমায় হয়তো আমার মন বসে না। কিন্তু সকল ভিন্নতায় আমি তথা আমরা আসলে একটা বিপরীত ঐক্যে গেঁথে আছি। সেখানে আমরা একে অপরের পথিকৃৎ। যাপনে পৃথক, কিন্তু উদ্‌যাপনের সারথি।

জীবনে অপর, কিন্তু উজ্জীবনে আত্মীয়। সেই আত্মীয়তা এক প্রাণ থেকে মহাপ্রাণে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আমরা পাখির মতো গান গাই। প্রজাপতির মতো উড়ি। সাপের মতো ফুঁসে উঠি। আর কচুপাতার জলের মতো স্বচ্ছ জলের নিরাময় চাই জীবনের কোথাও কোথাও। অথচ আমরা পাখি নই। প্রজাপতি নই। নই কচুপাতার জল অথবা সাপ। সেই ঐক্যের সূত্রে আমরা সবাই নশ্বর; কিন্তু অবিনশ্বর এক মহাকালের যাত্রী হিসেবে বিকশিত হই। সেইখানে সকল নিরপেক্ষ বিবেচনার ভার। কাজেই কবিতা পড়তে গিয়ে দশকের খণ্ডিত ভাবনায় কবিকে সীমাবদ্ধ করি না আমি। আমাদের আছে আবহমান কাব্য-পরম্পরা। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯— এই কালখণ্ডের মধ্যে আবির্ভূত যেসব কবিকে নিয়ে আমি এই আলোচনার সূত্রপাত করেছি, তারা সবাই এই পারম্পর্যের অংশ। কালে মহাকালে মূল্যায়িত হবার দাবিদার। সেই মূল্যায়নে কেউ হয়তো চিরকালের ব্যাপ্তি নিয়ে টিকে যাবেন। কেউ মুহূর্তের আলোড়ন তুলে ঝরে যাবেন অচিরেই। তাই কোনো মূল্যায়নই চূড়ান্ত নয়। মূল্যায়নের নাম করে আমরা আসলে এক নান্দনিক সম্ভাবনার দ্বারে টোকা দিয়ে যাই মাত্র।

মাহবুব কবির সম্পাদিত নব্বইয়ের কবিতার ভূমিকা থেকে নব্বইয়ের পটভূমিকার একটু পাঠ নেয়া যাক— এর পটভূমিকায় রয়েছে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীনতা লাভের পর বিরাজিত তৎকালীন অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে স্বাধীন গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক বিকাশের দ্ব›দ্ব শুরু হলো। যুদ্ধ বিক্ষুব্ধতার পর নতুন করে দেশ নির্মাণের নিরিখে দেখা দিল আপাত অর্থনৈতিক মানের ক্রমাবনতি, খাদ্যাভাব, শ্রমিক অসন্তোষ, বেকারি। অন্যদিকে ’৭৫ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ব্যারাকের রাজনীতি, শিল্পায়ন ইত্যাদির অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ জাতীয় বুর্জোয়াদের শক্তিবৃদ্ধি, সাম্যবাদে বিশ্বাসী অসংখ্য রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মীর উপর দমন-পীড়ন, দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের নামে ‘হ্যাঁ=না’ ভোট রীতির প্রহসন। তারপর এক ব্যারাক কর্মকর্তা থেকে সুকৌশলে অন্য কর্তার হাতবদল। মাঝে রক্তের পর রক্তধারা। আবার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীর উপর দমন-পীড়ন, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে ক্রমাবনতি ইত্যাদি দেশীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। বৈশ্বিক ক্ষেত্রে দুই জার্মান একত্রিকরণ, রাশিয়ার ভাঙ্গন, ইউরোপে মুক্তবাজার অর্থনীতি, প্রাত্যহিক জীবনে কম্পিউটার, ডিস-চ্যানেলের প্রচলন, আমেরিকা কর্তৃক মঙ্গলগ্রহে সুজারনার কম্পিউটার অবতরণ ইত্যাদি যুগগত জটিলতাকে আরো তীব্র করে তুলেছে।

এতসব ভাঙচুরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে যুগের হাওয়ায় স্লোগানমুখর হয়নি নব্বইয়ের কারোর কবিতা। ‘পরিপার্শ্ব বর্জিত সমাজ নিরপেক্ষতা’র যে-কথা ভূমিকাতে উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের কবিতার ক্ষেত্রে প্রায় সর্বাংশ সত্য বলে মনে হয়। বলা যায় পারিপার্শ্বিকতার প্রতিক্রিয়ায় তারা অন্তর্মুখীনতাকে অর্জন করেছেন। শিল্পিত সৌন্দর্যের দিকে তাদের নিষ্ঠা যতটা প্রবল, ততটা সামাজিক দায়বদ্ধতায় আক্রান্ত নন তারা। সেই অর্থে তাদের কাব্যে স্বতঃস্ফূর্ততার মাত্রা বেশি। সমাজ যদি রেখাপাত করেও থাকে তবে তা অঙ্গীকারের মাত্রা পায়নি। তবে অঙ্গীকারে পরিণতি না পেলেও আদর্শের সৌন্দর্য নির্মাণ তাদের একটা মৌল প্রবণতা বলেই মনে হয়। ভাবচেতনায় কারো কারো কবিতা সজীব, তরতাজা। কেউ আবার প্রকরণচৈতন্যে আঙ্গিকের দিকে বেশি বেগবান। এই দু’য়ের মিলনে একটা সমন্বিত কাব্যপ্রচেষ্টা তাদের কবিতায় নান্দনিকতায় উচ্চকিত।

ভিক্টোরিয়ান যুগে কবি সমালোচক ম্যাথু আর্নল্ড touch-stone method নামের কাব্য সমালোচনার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। হোমার, দান্তে ও শেক্সপীয়ারসহ চিরায়ত পাঁচ কবিকে কষ্টিপাথর বিবেচনা করে তাদের কবিতার সাথে প্রতিতুলনা করে নতুন কবির কবিতা ক্লাসিক্যাল তথা ধ্রুপদী কিনা, সেই বিবেচনা তিনি করতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি সাহিত্য সমাজে সমালোচিত হয়েছিল। সে যাই হোক, কাব্য সমালোচনাকে ভাবার্থমূলক পর্যায়ে রেখে না দিয়ে মূর্তমান অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাই ছিল তার। আসলে কাব্য সমালোচনা কী, এ বিষয়টি এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হলো না। সাধারণ পাঠক ভালো কবিতাকে আনন্দের মাত্রায় গ্রহণ করেন মাত্র। সমালোচনার বহুমাত্রিক বিবেচনা চট করে তাদের নাড়া দেয় না। সেই পাঠক যখন বোদ্ধা হয়ে ওঠেন, বারবার কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে যখন সেই কবিতার নানা বিবেচনার রং তার চোখে ধরা পড়ে, শুধু হৃদয় নয়, তার মননশীলতাকেও নাড়া দেয় তখন সেই পাঠকই কি একজন সমালোচক হয়ে ওঠেন না? কিন্তু সেই সমালোচনার একটা মূর্তমান পর্যায় লেখায় তুলে আনা কি সম্ভব? কেননা কবিতা মূলত ভাবের বিষয় আর মগজ সেখানে অভাবের তাড়না সৃষ্টি করে বলেই কবিতা হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। আর হৃদয় সবসময় এ কথা স্পষ্ট করে বলে না, কেন কোন কবিতা কীভাবে আমার ভালো লাগল। তাই কবিতা রহস্যময় এবং হয়তো এজন্যেই নান্দনিক। অথবা নান্দনিক বলেই রহস্যময়। ফলে কষ্টিপাথরে কবিতার যাচাই সম্ভব নয়। বহু বছরের পাঠের মধ্যদিয়ে পাঠকের মনে নানা অভিঘাত তৈরি করে যে কবিতা, তা সময়ের বিস্তারে সংশ্লেষিত হয়। একজন সমালোচক নিজের মতামতকে সেই মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতের সাথে জুড়ে দিলেই হয়তো একটি বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার ধারা তৈরি সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন সময়ের। অন্যথায় বুক রিভিউয়ের নামে সামান্য পাঠ-প্রতিক্রিয়া ছাড়া একাডেমিক পর্যায়ে কাজে লাগবার মতো আর কিছু তৈরি হয় না।

কবিবন্ধু আবু তাহের সরফরাজের বিশেষ অনুরোধে এই সঙ্কলনের জন্য আমাকে কলম ধরতে হলো। এই কর্মযজ্ঞ নিয়ে বেশ কয়েকবার সে আমার সঙ্গে পরামর্শ করেছে। আমিও আগ্রহের সঙ্গে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে চেষ্টা করেছি। সরফরাজের সঙ্গে আমার দীর্ঘ বছরের সখ্য। তার মতো নিরীহ গোবেচারা মানুষের হাত দিয়ে শেষ পর্যন্ত যে এই সঙ্কলনটি বের হচ্ছে, এতেই আমি খুশি। যত দূর জানি, নব্বই দশকের কবিতার বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে এ ধরনের সঙ্কলন তার আগে আর কেউ করেনি। আমাদের এখানে সাধারণত যেসব সঙ্কলন প্রকাশিত হয় তার নেপথ্যে থাকে কিছু উদ্দেশ্য। কিন্তু নিছক পাগলামির বশেই সরফরাজ এই সঙ্কলন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাকে চিনি বলেই লিখতে পারছি, এই কর্মযজ্ঞে সরফরাজের কোনো উদ্দেশ্য নেই। যদি কোনো উদ্দেশ্য থাকে তবে তা শিল্পের তাড়না। আর তাই, কবিতার পাঠক ও বিশ্লেষকদের কাছে এই সঙ্কলন হয়ে উঠতে পারে নব্বই দশকের কবিতার ওপর একটি নিরপেক্ষ পাঠ-মূল্যায়ন।

একুশে বইমেলা ২০১৮