অনার্ঘ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘মনমানবীকে’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯

আশা করি, এই কবিতাটা লেখার জন্য আমার এই নগণ্য জীবন ২৫ বছরে অপঘাতে মরবে না। কিম্বা নিন্দুকের দল এটা থেকে আমার বিষয়ে কোনো চরিতকাব্য লিখবে না। তাছাড়াও আশা করি, যেসব ইতিহাসবিস্মৃত জ্ঞানপাপী কেঁচোদের জন্য এটা লেখা, তারা নিজগুণে আমার থেকে দূরে সরে যায়।

এক.
সখী,
বহুযুগ কেটেছিল শান্তির নীড়ে নির্ভয় সহবাসে—
আমাদের আসুরিক গণ-অভিধান, লোকায়ত শব্দকোষ
ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ছুঁড়ে ফেলেছিল
`যবন` বা `কাফের`-এর মতো একজোড়া বিষাক্ত শব্দের সত্তাকে।
রথযাত্রা-মহরম, বাউল-ফকির, কীর্তন-কাওয়ালি
ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়ার মতো, বাংলার বুকজুড়ে
রাজপথে হেঁটেছিল হাতে হাত রেখে;
সেখানে শামিল ছিল দক্ষিণ রায়,
আর, বনবিবি আমাদের অতন্দ্রপ্রহরী।
নবান্নের লগ্নে ধানের সদ্যজাত শিশুকে
কোমল হাতের করতলে সযত্নে তুলে নিয়ে
আনন্দে হয়েছিল আত্মহারা সাবেক গাঁয়ের বধূ—
প্রতিমা, ফতেমা; নামে কীইবা আসে যায়?
চর্যার আদিকবি জ্বেলেছিল যে আলো
সে আলো অতীত আজ— ম্লান, ম্রিয়মান।

প্রণয়িনী গো,
(এ মাটির ইস্তেহার মতে) কথা ছিল,
এই দেশে বাহাস-বিতর্ক জায়েজ।
তাই এই মাটিতেই যুক্তির খঞ্জরে
বিভেদকামী শাস্ত্রের দম্ভকে নাশ করেছিল
আদিগুরু চার্বাক, তথাগত বুদ্ধ, নিমাই সন্ন্যাসী।

দুই.
হায় ভিটে! হায় যুগ!
শশাঙ্ক বা ঈশা খানকে স্যাঁতস্যাঁতে পুথির পাতায়
তালাশ করে করেই অথর্ব হয়ে গেছে বাস্তব,
অসহ্য হয়ে গেছে পরিস্থিতি।
অনন্য প্রেয়সী লক্ষ্য করো, চেতনার অগোচরে
অন্ধকার এ অমাবস্যায়, আমাদের কৃষ্টির কাছে অচ্ছুৎ হয়ে,
অন্ধকূপে নির্বাসিত নিঃসঙ্গ লালন ফকির আজ
কেবলই নিষ্প্রাণ জীবাশ্ম মাত্র।
ঐ দ্যাখো প্রিয়তমা,
আমাদের গ্রন্থশালায়, তপোবনের আঙিনায়,
বিন্দু বিন্দু পড়ে আছে লোলুপ বর্বরের নিষ্ঠীবন।
আতঙ্কে নির্বাক আমাদের সারথি
চণ্ডীদাস, আলাওল, রামপ্রসাদ, জয়দেব:
এই বুঝি লেখা পড়ে অস্ত্র হাতে তেড়ে এলো
ধর্মপ্রাণ বৃশ্চিক।
দ্যাখো রাই, রোজ বসে বেলেল্লা মজলিস
লম্পট সর্দারের জলসাঘরে।

তিন.
ধিক্! ধিক্! ধিক্কার ছুঁড়ে মারি তোমাদের দিকে।
যতসব গদিখোর কদর্য কীট!
কোত্থেকে ছত্রাকের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসে
দুই শতাব্দি ধরে ভাঙিয়েছ
বিদ্বেষবিষমাখা সরীসৃপের শীতঘুম,
মানবতাকে ক্রুশবিদ্ধ করে।
সেই অপজাগরণের গর্ভজাত জালিমের কাছে
আমাদের সব স্বকীয়তা নাকি `নাপাক`? ওদের
জান্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের ঐতিহ্যের
উদার সহাবস্থান আজ নাকি `রাজদ্রোহিতা`?

নাউজুবিল্লাহ্! নাউজুবিল্লাহ্! নাউজুবিল্লাহ্!
হায় খোদা, এদিকে তাকিয়ে দ্যাখো,
ভূমিকন্যার দেহে ভাগের অঙ্ক কষে পাষণ্ড কাঁটাতার,
এঁকে দেয় ক্ষমতার ক্ষতচিহ্ন। তবুও,
দরবারি জন্তরা বেহায়ার মতো
চিৎকার করে বলে, ‘স্বৈরশাসন জিন্দাবাদ!’

চার.
ওগো মনমানবী, চিন্ময়ী সাধনসঙ্গীনি, তাই বলি,
চলো আজ তুমি-আমি একাকারে ওৎপ্রোত হয়ে
ভাষার অস্ত্র হাতে পা রাখি দিগন্তগামী প্রান্তরে
সৃষ্টির মাহেন্দ্রক্ষণে যামল হয়ে।

ধর্মপালের দেশের প্রতিটি ধুলোর কসম,
খোয়াবি মহল ছেড়ে
আমাদের লোকায়ত স্বর্ণযুগ ফিরে পেতে,
রক্ষা করতে আমাদের বিদ্রোহের উত্তরাধিকার,
প্রেমের পক্ষ নিয়ে এগিয়ে যাব
মীর কাশিমের পথে;
ভবানী পাঠকের গিরিসেনা শিবিরের কুচকাওয়াজে
মুক্তির দৃঢ় অঙ্গীকারে, মুক্তিযজ্ঞচত্বরে
মজনু শাহের মতো অধ্বর্যু হব।
এসো বীরাঙ্গনা, শুরু হোক দ্বন্দ্ব।
বলে ওঠো, ‘জয় ব্যাফোমেট!’