আমাদের গল্প-উপন্যাস বিচারকের রায়ের কপি

পর্ব ১১

প্রকাশিত : মে ১৯, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: আপনার সাহিত্যে আসি। ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপনার গল্প `কাননে কালা কুত্তা`। যেখানে কুতুব নামের এক সন্ত্রাসী ঘটনাচক্রে সোসাইটিতে `কুত্তা` নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু শেষমেশ আপনি `কুত্তা`র প্রতি সিম্পেথি ক্রিয়েট করেছেন। আসল কুত্তা কে?

মেহেদী: গল্পটা ২০১০-১১ র দিকে লেখা। ক্রসফায়ার নিয়ে আমি গল্প পড়তে চেয়েছি, কিন্তু পাইনি সেসময়। নিজে লিখব, তাও ভাবিনি। কিন্তু কোত্থেকে হঠাৎ কুতুব চরিত্রটি মাথায় ঢুকে আমাকে নানা প্রশ্নে ভাবিয়ে তুলেছিল। কুতুব আমাকে বলছিল, এই সোসাইটি আমাকে কুতুব থেকে কুত্তা নামে নামিয়েছে, এমনকি আমার গায়ের রং কালো দেখে কালা শব্দটি যোগ করেছে নামের সাথে। আমি সন্ত্রাসী, কিন্তু লেখক হিসাবে তুমি আমাকে নিয়ে ভেবেছ একবার? আমি কেন সন্ত্রাসী হলাম? কেন আমাকে বাগানে গুলি করে মারা হলো? আমি সেই সন্ত্রাসী কুতুবকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছি। কুতুবের গল্পটি তার স্ত্রীর জবানিতে শোনানো হয়েছে। রাষ্ট্র কি পারছে কুতুব যে কারণে কুত্তা হয়ে উঠল সে কারণগুলো নির্মূল করতে? যদি না পারে তবে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কীভাবে ভাবতে পারছে যে, কুতুবকে মেরে দিলেই সমস্যা সমাধান হবে? এক কুতুব চলে যায়, লক্ষ কুতুব তৈরি হয়। এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয় না। আমার কাছে কুতুবরা রোবট। বিভিন্ন সময়ে তাদের বানানো হয়। তারপর নিষ্ক্রিয়ও করে ফেলা হয়। সেই নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতির নাম ক্রসফায়ার। এই পদ্ধতিতে কুতুবরা নিজ দেশেই ঔপনিবেশিক আচরণের শিকার। রাষ্ট্র কি এটাকে অন্য সন্ত্রাসীদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে? পরিণতি দেখিয়ে অনিয়ম-সন্ত্রাসের পথ পরিহারের লাল বাতির সংকেত দিচ্ছে? একজন মানুষ যতই খারাপ, তার বিপরীতে তার মধ্যে ভালোত্বও আছে। বাইনারি হিসাবেই থাকে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে খারাপির জন্য এই হত্যাকাণ্ড, কিন্তু তার ভালো গুণের কি হবে? যে গুণের কারণে সে যতই সন্ত্রাসী হোক না কেন একজন ভালো পিতা, ভালো স্বামী, ভালো সন্তান। সে হয়তো ভালো নাগরিক নয় তার রাষ্ট্রের কাছে। তাহলে যারা ঋণ খেলাপি, দুর্নীতিবাজ তারাও তো ভালো নাগরিক হতে পারে না রাষ্ট্রের কাছে। তাদেরও ক্রসফায়ার আমরা চাই না। যে অস্ত্র দেখা যায় তা হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেরে ফেললাম, কিন্তু যে অস্ত্র দেখা যায় না তা হাতে ধরিয়ে দিতে পারলাম না, সেই অস্ত্র দেশকে ভয়াবহভাবে ক্ষতির সম্মুখীন করছে। টের পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে, তার মানে এই নয় সন্ত্রাসীর পক্ষে। প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিটি মানুষের রক্তের মধ্যেই আদিম প্রবৃত্তি হিসাবে খারাপ বাসনা বা ইদ (id) থাকে, তবুও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অল্পসংখ্যক মানুষ পারছে না। যারা পারছে না তারাই মানুষ নামের রোবট, তাদের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেই, অন্যের দ্বারা সে পরিচালিত। কোনো না কোনো অন্যঘটিত কারণেই সে সন্ত্রাসী হচ্ছে বা খারাপি করতে বাধ্য হচ্ছে। এইসব রোবটদের আবার মানুষ বানাতে পারলেই রাষ্ট্র নিজ কর্তব্যে সফল হবে। জনগনের এইটুকু প্রাপ্যতার জন্যই আসলে রাষ্ট্র। এইটুকু উপকার পাবার জন্যই দেশ। খারাপ জনগণ চায় যে দেশ তার এইটুকু দায়িত্ব নিয়ে তাকে ভালো পথে আনুক, আনার ব্যবস্থা করুক, সে উপায়ে সব সুবিধাদি দি, কিন্তু তার বদলে জনগণ মারা কোনো দেশমাতৃকাসুলভ নয়। সন্তান বখে গেলে মা তাকে হত্যা করে না। নিজে নিভৃতে কাঁদে। তাই দেশমাতৃকা শব্দটির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে পারা উচিত। তা না হলে এসব জনগণের জন্য নিজের দেশটাই `উপনিবেশ`! যা বৃটিশ করেছে, যা পশ্চিম পাকিস্তান করেছে তা নিজেদের সাথে নিজেরা করতে পারি না।

সরফরাজ: আপনার অধিকাংশ গল্পেই মনে হয় ইলিউশনে ভরা; কিন্তু সেটা প্রচণ্ডভাবে বাস্তবতা তৈরি করে। ভেবেছেন?

মেহেদী: আমি মনে করি বাস্তবতা থেকে আমার কমই নেয়ার আছে। যে বাস্তবতা আশপাশে দেখছি সেটা প্রধানত দুইপক্ষের জন্য দুই ধরনের মিনিং তৈরিকারী বাস্তবতা। এ দুটি বাস্তবতা থেকে নতুন বাস্তবতা খোঁজার অর্থ হলো, লেখক নিজে বিচারক হয়ে বসে থাকা। অর্থাৎ, যে বাস্তবতাই তৈরি করতে যাবেন না, লেখকের সেই বক্তব্যের সাথে একজন বিচারকের বক্তব্যের কোনো ফারাক থাকবে না। আমাদের অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস বিচারকের রায়ের কপি। একটা বাস্তবতা তুলে ধরে তা কেন ঘটল, ভেতরের সত্য কী সেটার মর্ম উদঘানের দায়িত্ব নিয়েছেন লেখক, যেন তিনি পাঠককে রায় পড়ে শোনাচ্ছেন। আমি বিচারক হতে চাই না। তাই ইলিউশন, ইউটোপিয়া, ব্ল্যাংক স্পেস উপকরণ নিয়ে থেকে আমি লিখি। তা একমাত্র পাঠকের উপলব্ধিতে তারই বাস্তবতা নির্মাণ করে, লেখকের বাস্তবতা সেখানে নেই। কারণ আমি তো রিয়েলিটির ধারে কাছেও নাই। আমার কনটেন্ট বাস্তবতাবর্জিত, কিন্তু পাঠককে একটি মাত্র বাস্তবতার মুখোমুখি করে। ব্যাপারটি আমার প্রিয় গাছ কাঠবাদামের ছায়ার মতো, ছায়ার দিকে তাকিয়ে গাছের পল্লবের ঘনত্ব টের পাওয়া যায়। যেখানে ছায়া ইলিউশন, গাছ বাস্তব। আমি ছায়ার বর্ণনা দিই। পাঠক একটা গাছের দেখা পায়।

সরফরাজ: তারমানে আপনি পাঠককেও লেখার দায়িত্ব দেন?

মেহেদী: অনেকটা সেরকমই। আমি `গোসলের পুকুরসমূহ` উপন্যাস থেকে ত্রিশ হাজার শব্দ ছেঁটে ফেলে দিয়েছি। যাতে একটা ছায়ার মতো অসম্পূর্ণতা নেমে আসে, পাঠক পড়তে গিয়ে সেই শব্দগুলো নিজে লিখবে মনে মনে, এতে আমার ছায়া থেকে একটা গাছ তৈরি হবে। সূর্য কে তবে? পাঠকের বোধই সূর্য। কিছু লেখা পড়ার জন্য পাঠকের নিশ্চই প্রস্তুতি লাগবে। যেমনটি  স্বাভাবিকভাবে সে ঘুমিয়ে থাকলেই কেবল পৃথিবীতে অনুপস্থিত থাকতে পারে। পৃথিবীতে এই অনুপস্থিতি একেক মানুষের একেক রকম, কেবল তারাই ভালো বলতে পারবে যারা ঘুমায়! পাঠকের বোধ সূর্যের আলোর মতো আমার লেখায় উপস্থিতির ভেতর যে অনুপস্থিতি তার উপর পড়বে, পাঠকের উপস্থিতিটুকুই আমার তৈরি লেখা নামক `ছায়া`।

চলবে